9 Nov 2015

গোলাপের রং হলুদ হতে পারে


নুলিয়ার গায়ের রং কালো হলেও লোহার মত শক্তপোক্ত শরীরের সাথে নিজের পুরুষসদৃশ শরীরকে সমর্পণ করে লেপ্টে থাকার কামনাবাসনাক্ষুধা পরিমলের মত কাল্পনিক চরিত্রের মধ্যে থাকা কতখানি যে সত্য, কতটুকু বা স্বাভাবিক সেটা আঁচ করতে শুরু করলাম । 

না, ভুল ভেবেছো । এখানে লেখক স্বপ্নময়দার সৃষ্টিচরিত্র পরিমলের সাথে আমার কোনো মিল নেই । আমি নিজে নুলিয়ার জায়গায় থেকে সদ্য আলাপ হওয়া এক গে বন্ধুর ফিলিং বোঝার চেষ্টা করছি কিছুদিন যাবৎ । বন্ধুটি একবারও বলে নি, "অ্যাই আম আ প্রাউড গে" । একবারও মুখ ফুটে উচ্চারণ করে নি, "আমি পুরুষ হয়ে জন্মালেও মনেপ্রাণে সম্পূর্ণ নারী" । অথচ তার চালচলন বলে দেয় আমাদের থেকে আলাদা । মেয়েলি গোছের বলতে যা যা উপলক্ষণ সবই তার মধ্যে উপস্থিত । আমি এমন নই যে এলজিবিটি-এর অন্দরমহল নিয়ে বিশেষ উৎসাহিত, বরং সামনে এরকম কাউকে দেখলে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকানো আমার বরাবরের অভ্যাস । স্পষ্টত অস্বস্তিজনক অভ্যাস যাকে বলে । বিবেকে লাগলো কিনা সেদিকেও মন সায় দেয় নি । গত শুক্রবার মুকবধিরদের একটা ক্লাবের নতুন সদস্য হবার সুবাদে ওখানকার পুরোনো সদস্যদের সাথে আলাপচারিতায় ব্যস্ত ছিলাম । তাদের মধ্যে একজন মুকবধিরের চলাফেরা, আচারআচরণ যেন স্বাভাবিক ঠেকছিলো না বেশ কিছুক্ষণ ধরে । চেহারায় একটু রোগাপাতলা এবং ছোটোখাটো । আরেকটু খেয়াল করতেই যা সন্দেহের উদয় হলো সেটা অমূলক কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্যে একজনকে ডেকে জানতে চাইলাম । যা অনুমান করেছিলাম সেটাই । একটু হলেও ব্যাপারটা রীতিমতো ধাক্কা দিয়েছিলো আমাকে ।

মুকবধিরদের জন্য আলাদা সামাজিক স্বীকৃতি । অন্ধজনদের জন্য আলাদা সমাজগঠন । অ্যাসিডাক্রান্ত মহিলাদের জন্য আলাদা দলবদ্ধ সংগঠন । সন্তানদের উপেক্ষা পেয়ে বৃদ্ধবৃদ্ধাদের জন্য আলাদা পৃথিবী । মৃগীরোগীদের জন্য আলাদা আলোবাতাস । যৌনকর্মীদের জন্য আলাদা ঝড়বৃষ্টি । এই আলাদা আলাদা সমাজের কথা আমরা আকছার জেনে থাকি নিউজে বা সোশ্যালমিডিয়ার সৌজন্যে । এলজিবিটি-এর তেমনি আলাদা গ্রুপও আছে মূল-সমাজের অলিগলিতে তা খোঁজার সাধ্যবহির্ভূত আমরাই বেশিরভাগ । আবার একরকমের দল নিজেদের ছাড়া সম্পূর্ণ অন্যরকমের দল বা তাদের যাবতীয় সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ । করতেই বা যাবে কেন ?! এটাই সমাজের বহুচ্ছিদ্রময় ছবি । কিন্তু টু-ইন-ওয়ান ? দুটো ভিন্ন সমস্যা যদি একজন মানুষের মধ্যে থাকে ? আমার দেখা ক্লাবের সেই বন্ধুর মধ্যে দুটো রকমের জিনিস বর্তমান - মুকবধির প্লাস গে । এই পৃথিবীতেও অবশ্যই এরকম সম্ভব । হেলেন কেলার একইসাথে অন্ধ ও মুকবধির । আমার মামাবাড়ির এক প্রতিবেশীর ছেলে একইসাথে মৃগীরুগী প্লাস অর্থোপেডিক্যালি প্রতিবন্ধী । এরকম জোড়া জোড়া সমস্যা নিয়ে জীবনে চলতে থাকার মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয় যতই অন্তরালে পড়ে সচেতনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক । 

সেই মেয়েলি পুরুষবন্ধুর সাথে আমার চোখাচোখি হতেই আমি অস্বস্তিজনক অভ্যাসে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম । কিন্তু সে স্মার্টভঙ্গীতে এগিয়ে আমার সামনে হাজির হলো আর সাইন লাঙ্গোয়েজে জানালো, "সোমদা, আমি তোমার নাম অনেক শুনেছি । তুমি আমাদের গর্ব ।" আমি বিনয়ী সেজে কিছু বলার আগে কোত্থেকে এক দাদাটাইপের মুকবধির এসে সোজা তার মাথায় চাঁটি মেরে চা আর বিস্কুট আনার নির্দেশ দিলো । ব্যবহারের মধ্যে একটা হ্যাটা, একটা ঘেন্না, একটা অপমান এবং একটা দুর্বলের উপরে শক্তির আস্ফালন সবমিলিয়ে খুব প্রকটিত হয়ে আমার চোখে আর মনে এসে আঘাত এনেছিলো । সদ্য সদস্য হয়েছিলাম বলেই কিছু বলতে গিয়েও আটকে গেছিলো আমার । পরে সুযোগ পেয়ে ওর কাছে গিয়ে নাম বাড়ি সব জিজ্ঞেস করলাম । হাতের মুদ্রায় যেটুকু বোঝার তা বুঝে নিয়ে যেই বন্ধুসুলভ হাসিটা দিলাম করমর্দন করতে করতে । সে হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ ধরে নিজের শরীরকে আমার শরীরের সাথে লেপ্টে ছিলো । আমি ছাড়াবার চেষ্টা করতে গিয়েও পারিনি । 

বলতে দ্বিধা নেই যে কলেজজীবনে প্রথম প্রেমিকার প্রথম আলিঙ্গন, পরবর্তীকালে নানা আবেগের পাল্লায় পড়ে মেয়েবন্ধুদের নরম তুলতুলে শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা, বর্তমানে বৌয়ের শরীরী আদর - এগুলো পেয়ে এসেছি । কিন্তু এই একমাত্র 'গে'বন্ধুর ওইরকম আকস্মিক আমাকে জড়িয়ে ধরে তার মাথা আমার বুকে রাখার মেয়েলিপনা খুব একটা 'আলাদা'ও নয় । অস্বস্তির সাথে সাথে বেশ রিয়্যালাইজ করছিলাম ওর শরীরীভাষায় বেজে উঠেছিলো কোনো এক পুরুষপ্রেমিক খোঁজার আর্তি, সে এক সম্পূর্ণ নারীসুলভ বেদনা । সে ছিলো এক অনন্যসুন্দর অনুভূতি । আমার চোখে কখন যে জল এসে গেছিলো জানি না তবু কোথায় গিয়ে সংবরণ করেছিলাম ।

স্বপ্নময়দার লেখায় পড়েছিলাম একজন সমকামীর সপ্রতিভ উক্তি -"গোলাপের রং হলুদ হতে পারে । সাদাও হতে পারে ।"

No comments:

Post a Comment