30 Nov 2015

বিজ্ঞান, ইতিহাস, ছাদ, কন্ডোম ও চাঁদ


#
গরম ধোঁয়া ঠেলে চায়ের মধ্যে বিস্কুট কিছুসময় ধরে চুবিয়ে রাখলেই প্রচুর নুন, দুধ, বেকিং পাউডার এর ওর থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে সাঁতরে বেড়ায় । বিক্ষিপ্তছন্দে । ছোটো কাপটার সীমাবদ্ধতা তখনই হয়ে ওঠে অপরিসীম । বিজ্ঞানকে তখনই বড্ড ঘেন্না করতে ইচ্ছে করে । বিজ্ঞানীদের গায়ে থুথু ফেলার জন্য ক্ষুদ্রমন ছটফট করে । স্টিফেন হকিংস, আইনস্টাইন, নিউটনদের তত্ত্বগুলোর উপরে কাপটাকে উল্টে গরম চা ঢেলে তছনছ করে দিতে ইচ্ছা করে । 


#
ম্যাসিডোনিয়া না মাকেদোনিয়া কোনটা বলা শোভনীয় এই ভেবে লাভ নেই । গ্রীস, যুগোস্লাভিয়া আর বুলগেরিয়ার মধ্যে কে যেন দানার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে ম্যাসিডোনিয়াকে যাতে বহুযুগ আগেকার হারানো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনবে সাদা পায়রাগুলো । পারবে কি তারা এমন জাতীয়তাবাদকে ঠোঁটে তুলে নিতে ? তুললেও হয়তো গলা দিয়ে নামাতে পারবে না, কারণ সেইসময়কার বীর আলেকজান্ডার নিজের এক পরমবন্ধুকে খুন করেছিলো । অঃ একটা কথা বলে রাখি - ছুরি উঁচিয়ে কারো বুকে তৎক্ষণাৎ বসিয়ে দিয়েছি এরকম দৃশ্য চোখের সামনে মাঝেমাঝে ভেসেও ওঠে । 


#
আমরা অনেকে ছাদে যাই । সিঁড়ির প্রতিটা ধাপে খচিত থাকে ছাদে যাওয়ার ইতিহাস । যে একলা বৃদ্ধ বা একলা বৃদ্ধা অকপটে বলে ফেলে, "আমার যা পাওয়ার বা চাওয়ার বা হওয়ার সবই পেয়েছি । এখন শুধু উপরে যাওয়া বাকি" । তাদের জন্যে বোধ হয় এইসব ছাদ নিষিদ্ধ একটা জায়গা । ছাদকেও ছাড়িয়ে যেতে হবে কিনা । ভাবতে কেমন যেন একটা লাগে । মনটাও বড়ো আকুল হয়ে ওঠে এসময় । আসলে আমি একজন ছাদপ্রেমী, অথচ আমাকে একদিন ছাদকে শেষবারের মত ছুঁতে না পেরেই চলে যেতে হবে । 


#
সত্যির চেয়ে মিথ্যা সংখ্যায় বহুগুণ বেশি । বহুগামিতা মিথ্যার একটি বড়ো চরিত্র । মিথ্যার বিশেষ কোনো সামাজিক তকমা নেই । থাকলেও সেটা হয় সেকেলে টাইপের বা আদিবিপ্লবী পচাগন্ধ গোছের । কেউ কি বুঝতে পারছে না যে সত্যির জন্মহার কমে আসছে ? ওদিকে মিথ্যার জন্মহার বাড়লেও মৃত্যু নেই বরং পপুলেশন বাড়িয়ে চলার লক্ষ্যে স্থির । আমি লুকিয়ে লুকিয়ে বানাবো মিথ্যার জন্মনিরোধক কন্ডোম যা সুযোগ বুঝে সকলের জিভ টেনে বের করে পরিয়ে দেবো । জানি না তোমরা আমাকে কী ভেবেছো । তবে জেনে রেখো নিজের জিভটাকেও বাদ দেবো না এই সুযোগতালিকা থেকে । 


#
বেডরুমের জানলার বদলে বাথরুমের জানলা দিয়ে চাঁদ দেখতে বেশি ভালোবাসি । নামমাত্র বাথরুম, অথচ বাথকে রোজ রোজ পূর্ণতা দেয় দিনেরবেলার আলো । এই একঘেয়েমি কেটে যায় রাত্রিবেলায় বিছানা ছেড়ে যখন বাথরুমে ঢুকি আর চাঁদের হাসিমুখ দেখতে পাই । চাঁদ সবসময় দেখা দেয় না বলে হয়তো এই বাথরুমের একটিমাত্র খোলা কাঁচের জানলাকে আরো বেশি আবেদনময়ী লাগে । এতোটাই যে ফ্ল্যাস্ করতেও ভুলে যাই । গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বালিশের কাছে ফিরে যাই একরকমের নেশা নিয়ে ।

কাগজের এরোপ্লেন


কাগজের এরোপ্লেন । একটা নয় । দশ-বারোখানা । বানাতে বানাতে দুই পেগ ততক্ষণে শেষ । ব্লেন্ডারস্ প্রাইড নিয়ে কি আর থাকা যায় ?! তোমার প্রাইড বা কী নিয়ে শুনি আগে ? জানো না তো । হা হা হা । আমিও জানি না কীসে প্রাউড ফিল করি । পিয়ারলেস ভবনের সামনে যে অল্পঠাণ্ডার ভীষণ হাওয়া খেলে সেই হাওয়ায় কী এমন আছে ? দশটা এরোপ্লেনের মধ্যে একটা না দুটোমাত্র ওড়ে রাজভবন থেকে শহীদ মিনার অবধি । বাকীসব পায়ের কাছে টলোমলো খেয়ে পড়ে । 

টেবিলের তলায় কুড়ে পাওয়া এরকম একটা কাগজের ভাঁজ খুলে দেখি বার্ ডান্সারদের শরীরীভাষায় লেখা কিছু অজানা কাহিনী । চাইনিজের মতো ততটা অবোধ্য নয়, নর্থ ইন্ডিয়ানের মতো ততটা রিচ নয় । পেটে সয় এমন নৃত্য, প্রাণে সয় এমন নারীসৌষ্ঠব । আমরা কয়েকজন মিলে বধির, তবু আমাদের কান সোজা গিয়ে পড়ে ওদের শরীরে ।

ওদের খোলা বগল আমাদের তিরিশ মিলিলিটারের সমান । একটাও চুল নেই তাই চুমুকের পর চুমুক চলে নিশ্চিন্তমনে । আমরা ধরে নিই যে পাইলট হয়ে চালাচ্ছি । কী চালাচ্ছি হুঁশ নেই, তবে যাত্রীসংখ্যা নেহাত কম নয় । পাশের টেবিল থেকে যেন শোনা যাচ্ছে প্রকৃত পাইলটের বাউলিয়ানা । ককপিট হঠাৎ করে মাতোয়ারা হলে যা হয় । কাগজের শেষ ভাঁজটুকু না খুললে এতোকিছু ঘটতো না বইকি । 

বিল চলে আসে । কাগজের বিল । মাথার এ-পাশ ও-পাশ কাটিয়ে এরোপ্লেন ওড়ে । সেটাও কাগজের । প্রথমটার জন্যে বন্ধুরা আছে । দ্বিতীয়টার জন্যে শিল্পীহাত দুটো আছে যা কখনো থামে না । ভুল করলেও ।

23 Nov 2015

হাঁসদের হাঁটাচলা


চলো, হাঁসদের হাঁটাচলা একটু দেখে আসি । হাঁসদের পেছনের দিক থেকে আমরাও হাঁটবো আর দেখবো ওদের ওয়াকিং স্টাইল । বেশ ফ্যাশনেবল্ লাগে । সাঁতাররত হাঁসদের দেখতে যতটা মধুর, তার চেয়ে বড় আকর্ষণীয় এদের 'হাঁটি হাঁটি পায়ে পায়ে' । একটা করে পা ফেলার সাথে এদের বডি সুইং করে । 

ক্লাস এইটে পড়ার সময় বাড়ির টিভিতে কেবল্ আসে । ফ্যাশন শো বলে একটা চ্যানেল ফ্লিপ করে করে দেখতাম আর প্রায়-ই দেখি অর্ধস্বচ্ছ বা স্বচ্ছ পোশাক পরা মেয়েদের নির্বিকার মুখ নিয়ে ক্যাটওয়াক । বুঝতাম না এদের উদ্দেশ্য ঠিক কী ? বাজারে আসা নতুন নতুন ডিজাইনের জামাকাপড় গায়ে পরে শো করা নাকি জামার তলায় থাকা রক্তাভ-সাদাচামড়ায় মোড়া ঈশ্বরদত্ত ডিজাইন শো করা ? গায়ে জামা ফিট হলো কি হলো না তা নিয়ে মডেলদের বা ডিজাইনারদের কারো মাথাব্যাথা নেই । শুধু হেঁটে যাও, একটু থেমে ইচ্ছেমতো পোজ মেরো, ফিরে এসো । ব্যাস্ । তবু নিয়ম করে দেখতাম চট করে চ্যানেলগুলো ঘোরাতে ঘোরাতে । যতদূর মনে পড়ে এই বিশেষ চ্যানেলের নম্বর ছিলো নাইন্টি এইট, যদিও একবারে নয় আর আট টিপে দেখার সুযোগ পাই নি কখনো ।

হাঁটাচলার মধ্যে যে একটা স্টাইল স্টেটমেন্ট, পার্সোনালিটির কিছু পার্সেন্ট বাঁধা আছে তা অনেক পরে ফিল করতে শুরু করি । কেউ সামনের দিকে একটু ঝুঁকে ঘাড় কায়দা করে বেঁকিয়ে হাঁটে, কেউ পিঠ সোজা রেখে মাথা নিচু করে হাঁটে, কেউ আবার সবকিছুর মাঝামাঝি যার উপরে পথযাত্রীদের চোখ পড়ার চান্স সবথেকে কম । তার সাথে রয়েছে হাঁটার স্পিডের রকমারি । কারো কম, কারো আবার অস্বাভাবিক বেশি কোনো তাড়া না থাকলেও । 

ইন্টারন্যাশনাল সেলিব্রিটিদের হাঁটাচলার ধরণ কেমন একটা ঘোরলাগা । সেলিব্রিটি বলেই হয়তো তাই লাগে । ব্যারাক ওবামাকে ইয়ং মডেলদের মত করে হাঁটতে দেখে কতবার মুগ্ধ হয়েছি । তাকেই এতে মানায় । মোদীকেও দেখি তার নিজের মত করে হাঁটতে । মন্দ লাগে না । কানাডার সদ্য প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডিও যেভাবে রিপোর্টারদের প্রশ্নের পর প্রশ্নের জবাবে হাঁটার ছন্দ একইরকম রেখে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলো সেটাও বেশ ঈর্ষণীয় । চোখের অভ্যাস বলে যদি ব্যাখ্যা দিতে হয় সেটা হবে ভুল । যেমন হেঁটে হেঁটে হেঁটে হেঁটে ৩৪ বছরের গর্বচূর্ণ করার একক কৃতিত্ব যার তার সেই হাঁটাচলা আজও জঘন্য লাগে । ধীরতা নেই, ধৈর্যতা নেই, ছন্দ নেই, ছন্দপতনও নেই । মন্ত্রী মন্ত্রী ভাব, কিন্তু ছন্নছাড়া ভাব । 

তার চেয়ে চলো হাঁসদের হাঁটাচলার উপর একটু নজর দিই । নিজের খানিকটা হাঁটাও হবে যদিও কোনোদিন জানতে পারবো না কেমন করে যে হাঁটি...

শিকড়গড়া মনের সন্ধানে


বিস্তৃত শিকড়গড়া মন যার, সে কখনো কারো ক্ষতি করে না । নিজে আরো ডুবে যায় কল্পনায় । অন্তরালে চলতে থাকা একরকমের অস্তিত্বহীনতা । নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার নেশা । তলে তলে এমনকি পাতালে তার নানাবিধ ডালপালা মেলতে থাকে । মেট্রোরেলের কর্তৃপক্ষও টের পায় না এমন অভিজাত আত্মহননের গুপ্তকথা । 

নীলুর একমাত্র বোন নতিস্বীকার করে নি । দেড়বছর হলো সে কেরোসিন দিয়ে কেলো সিন ক্রিয়েট করে চলে গেছিলো । পৃথিবীর মাটির উপরেই । প্রকাশ্যে । আলো বাতাস যথেষ্ট ছিলো । দর্শকমাত্র ছিলো তার পরিবারবর্গ । তার এই চলে যাওয়াটা স্টেজের ম্যাজিসিয়ানের বিপজ্জনক খেলার একটা 'ইচ্ছাকৃত' ভুলের সমান । দারুণ একটা শো-অফ ছিলো তার সেই হলুদ-লাল-কালচে-বাদামী ভয়াবহ আগুনে অন্তর্ধানদৃশ্য । 

কি ভয়াবহ ! কি ভয়াবহ ! ঈর্ষা করা একধরণের হীনমন্যতা । এতে পৃথিবীর বাকি কারো কিছু গো-কাম হয় না । 

নীলু একদিন বলেছিলো মন খারাপ করা নাকি একপ্রকারের আরামপ্রিয়তা । গোয়ায় সমুদ্রের ধারে অচেনাদের ভিড়ে একলা ডাবে স্ট্র । দুই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে মনখারাপের অ্যান্টিজেনিক সুড়ুৎসুড়ুৎ স্যালাইনের বিলাসিতা ।

ফুড়ুৎপাখির মত সুখ ! বহুদিনের পুরোনো মাকড়শার জাল কেটে বেরিয়ে আসতে পারার সুখ । এমন সুখের মকটেল বিনা পয়সায় পাওয়া যায় । প্রস্তুতিপর্ব ও রেসিপি ছাড়া ।

আমি আহত হই এসব বুঝতে বুঝতে । অতিরিক্ত জ্ঞানাহত হওয়া মোটেই সুখকর নয় । স্টারমার্কে ফের চলে যাই । চলে যাই অসংখ্য শিকড়গড়া একটিমাত্র মনের সন্ধানে, যেখানে বাস্তবজ্ঞানের প্রবেশাধিকার নেই ।

16 Nov 2015

বিচির ছিরি


কার যেন মন্ত্রে তিনবার কেঁপে উঠলো । শীত শীত আর শীত । সারা গায়ে সে ভালো করে ছায়া জড়িয়ে নিলো । ছায়ার তলায় আমি ও তোমার গত তিনরাত্রি ।

পাহাড় কেটে দিচ্ছে অসংখ্য পা । হাতগুলো আকাশের দিকে । চাঁদের গায়ে আঙুলের ছোঁয়া লাগে । মাটিমাখা নখের হালকা খোঁচা পেয়ে রক্ত ঝরে । আজকের তারিখটা মুছে দিয়ে নতুন বাঁক নিলো সে ।

পেডোফিলরা হাসে । শিশুরা হাসে । ছায়াও হাসতে হাসতে খুলে পড়ে যায় তার গা থেকে । একগ্লাস জল খাবো বলে সে । সামনে নদী থাকতেই বাড়ি কেন ? স্টিলের গ্লাসগুলো ভেসে ওঠে । জিজ্ঞাসু চোখের সামনে, পিপাসু মনের অনেক রাতে ।

আমাকে পাগল ভেবে চুপটি করে বসে থেকো না । জোরে জোরে বলো যে আমি একটা সুস্থ পাগল । যাতে গোটারাত শুনতে পায় তোমার গলা ও আমার পাগলামির কিছু ধাতবশব্দ । দুটো স্টিলের গ্লাস একসাথে ঠুকে দিলে যেরকম শোনায় ।

এতক্ষণে চাঁদের আলো পেলো নদীর বুক । শীতের সেই বিচ্ছিরি মন্ত্র তবুও থামে নি । চাঁদের গায়ে ঝিন্নির দাগ লেগে গেলেও বোঝা যায় সে কতখানি বিচির ছিরি ।

'দুনিয়া এক হও' দু'দলে ভাগ হয়ে আসছে


যেখানে স্বপ্ন অধরা মনে হয়, সেখানে কেউ আদৌ সেই স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিতে পেরেছে ?

যেখানে বিপদসংকুল অঞ্চলে যাওয়া বারণ, সেখানে মানুষের দুঃসাহসিকতা কেউ আদৌ আশা করতে পেরেছে ?

যেখানে শব্দবাজির নিষিদ্ধতা নিয়ে কড়াকড়ি, সেখানে পটকা ফাটার বাড়াবাড়ি নিয়ে কেউ আদৌ থামাতে পেরেছে ?

যেখানে খোলাপোশাক যৌনকামনা জাগায়, সেখানে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কাপড়ে ঢাকা মহিলাদের টার্গেট করার সম্ভাবনা কেউ আদৌ কল্পনা করতে পেরেছে ?

যেখানে স্কুলের ছাদে যাওয়ার ন্যূনতম রাস্তাও বন্ধ, সেখানে কিশোরকিশোরীদের আবেগবুদ্ধির জোরে নিজেদের ছাদে যাবার রাস্তা বের করা কেউ আদৌ আঁচ করতে পেরেছে ?

যেখানে প্রাণীহত্যা আইনত অপরাধ বলে নিষেধাজ্ঞা জারি হচ্ছে, সেখানে রবিবাসরীয় মাংস পরমতৃপ্তিতে চিবিয়ে খাওয়ার বদলে কেউ আদৌ মুখ ফুটে বলতে পেরেছে ?

যেখানে ক্লাইমেট নিয়ন্ত্রণ করার পন্থা নেওয়ার কতকগুলো নিয়ম বের করা হয়েছিলো, সেখানে গ্লোবাল টেম্পারেচার তিল তিল করে বাড়তে থাকায় কেউ আদৌ খবরে জানার আগে নড়েচড়ে বসতে পেরেছে ?

যেখানে গেরুয়া-সাদা-সবুজ নিয়ে যে মানুষের প্রকাশ্যে ব্যঙ্গবিদ্রূপ, সেখানে নীল-সাদা-লাল গরাদে সেই একই মানুষের বন্দী থাকার স্বাভাবিকতা-অস্বাভাবিকতার প্রশ্নের সঠিক উত্তর কেউ আদৌ দিতে পেরেছে ?

যেখানে থামাতে পারা ও থামতে জানা এই দুটোর মধ্যে চিরকালীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সেখানে গাদাগুচ্ছের আবেগের ডিম পেড়ে মেন্টালিটির বিচিত্র রঙের বলগুলো নিয়ে অবচেতনে জাগলিং করার অভ্যাস নিয়ে কেউ আদৌ সচেতন হতে পেরেছে ?

"কেউ আদৌ পেরেছে ?" এটা বোধ হয় আর প্রশ্ন হয়ে থাকবে না । পেরেছে কোথাও না কোথাও, কিন্তু সেগুলো অনেকাংশে ইম্প্রোভাইজেশন থেকে ঘটে এসেছে ।

পৃথিবী এমনিতেই প্রাকৃতিকভাবে শেষের দিকে এগোচ্ছে যেটা সারা বিশ্বজুড়ে মানুষদের সচেতনতার অভাবে বা নিজেদের অ্যাকশনপ্ল্যান নিয়ে ভুলভ্রান্তির সৌজন্যে । তার সাথে উগ্রপন্থী ইসলামদের রাজত্বের ভবিষ্যৎ খুব সুন্দর ছন্দে পা মিলিয়ে হাঁটছে এতে আশ্চর্য হবার কী বা আছে ! পৃথিবীর প্রাকৃতিক ধ্বংসের সাথে সাথে আইসিস-এর মতো জঙ্গি সংগঠনদের লম্বা লম্বা কর্মসূচীর শেষতম কাজটি যেন একই দিনে একই মুহূর্তে সম্পাদিত হয়ে যাক, সেই আশা রেখে চলা যাক ।

এভাবে 'দুনিয়া এক হও' দু'দলে ভাগ হয়ে আসছে । সে দশটা বছর লাগুক কি একশোটা বছর লাগুক ।

11 Nov 2015

পরীক্ষার্থী ও শিখা


জীবনের সবথেকে বড়ো ধৈর্যের পরীক্ষায় বসলাম ।

খোলা আকাশের নীচে কালচে ধোঁয়াটে ছাদ । এই একলা পরীক্ষার্থীকে ঘিরে কাছেদূরে এ-বাড়ির গা ও-বাড়ির গা । এ-ছাদের পাঁচিল ও-ছাদের পাঁচিল । এ-চিলেকোঠার ঘর ও-চিলেকোঠার ঘর । প্রায় সবেতে-ই আস্তানা গেড়ে বসেছে টুনির ঝলমলে পরিবার । এমন উৎসবমুখর পরীক্ষাগারে দিব্যি হাওয়া । চামড়াশুকানো ঠাণ্ডা । কোনাকুনি একটা সিমেন্টের বেঞ্চের তলায় মোমবাতি । মাথায় তার নিভুনিভু জ্বলন্ত, শিখা উন্মত্ত ।

ছবিতে বুক উঁচু । হলদেটে ক্লিভেজ - কোমর বেঁকানো । পুরো সেডিউজড্ । একনিমেষে খুলে ফেললাম । বেরিয়ে এলো কতকগুলো বারুদকাঠি । চুমকির মত ঝিকিমিকি সবকটাই । একটা বাছলাম । মোমবাতির দিকে এগোলাম । নিরীহ কামানের মত তাক করা হলো । শিখার মুখ খালি এদিক ওদিক করছে, "প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও, পায়ে পড়ি" । তাও শিখাকে হ্যারাস করে যাচ্ছি । তার মুখে কাঠি খুঁচিয়ে মলেস্ট করে যাচ্ছি । একবার ভাবি তার মুখখানা হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরি তাহলে শুভকাজটা সেরে নিতে পারবো । না, সারামুখে শুধু আগুন । পুড়ে যাবে হাত । অগত্যা খুঁচিয়ে দিতে থাকি তার অস্থির মুখে । মাঝেমধ্যে এদিক ওদিক তাকাই । পাক খাওয়া খ্যাঁক হাওয়া, উত্তর না জানা অসহায় আমি আর একগুঁয়ে জেদী শিখা । ত্রিকোণ ক্যাওস । প্রেমের এক বারুদ-ও লক্ষণ নেই । 

কোমর টনটন করছিলো । হাঁটুর ডিম পচে যাচ্ছিলো । চোখের তারা গলে গিয়ে খসে পড়ে যাবে এমন ট্রানজিশন । শিখা কখন যে আমার দিকে তাকাবে ? ততক্ষণে শিখার বয়স একমিনিটের হিসেবে একটা বছর ধরলে পনেরো-ষোলো মিনিটে ষোড়শী হয়ে গেছে । কোন যে শাস্ত্রের একটা শ্লোকে বলা আছে - ষোড়শী রমণ সর্বব্যাধিহর । শাস্ত্রের এমন বচন কি মিথ্যা হয় ? কাঠির প্রথমাংশ শুধু কালো হয়ে গেলো ।

আকাশের দিকে নিরুপায় মুখ তুলি । রকেটগুলো উড়ছে । ফেটে ফোয়ারার মত লাল-সবুজ-সোনালী হয়ে আকাশের কোষ্ঠ প্রকোষ্ঠ ভরে দিয়ে মিলে যাচ্ছে । হঠাৎ দেখি হাওয়া নেই । কেবল আমি আর শিখা । আর কেউ নেই এই একলা ছাদে । সাথে সাথে শিখা স্থির হয়ে আমার দিকে তাকালো । তারা ফুটলো অবশেষে । 

সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে সহনশীলতা একান্ত কাম্য । তৃতীয় কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি কোনোমতে গ্রাহ্য নয় । এটাই রি-উপলব্ধি করলাম পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে ।

9 Nov 2015

গোলাপের রং হলুদ হতে পারে


নুলিয়ার গায়ের রং কালো হলেও লোহার মত শক্তপোক্ত শরীরের সাথে নিজের পুরুষসদৃশ শরীরকে সমর্পণ করে লেপ্টে থাকার কামনাবাসনাক্ষুধা পরিমলের মত কাল্পনিক চরিত্রের মধ্যে থাকা কতখানি যে সত্য, কতটুকু বা স্বাভাবিক সেটা আঁচ করতে শুরু করলাম । 

না, ভুল ভেবেছো । এখানে লেখক স্বপ্নময়দার সৃষ্টিচরিত্র পরিমলের সাথে আমার কোনো মিল নেই । আমি নিজে নুলিয়ার জায়গায় থেকে সদ্য আলাপ হওয়া এক গে বন্ধুর ফিলিং বোঝার চেষ্টা করছি কিছুদিন যাবৎ । বন্ধুটি একবারও বলে নি, "অ্যাই আম আ প্রাউড গে" । একবারও মুখ ফুটে উচ্চারণ করে নি, "আমি পুরুষ হয়ে জন্মালেও মনেপ্রাণে সম্পূর্ণ নারী" । অথচ তার চালচলন বলে দেয় আমাদের থেকে আলাদা । মেয়েলি গোছের বলতে যা যা উপলক্ষণ সবই তার মধ্যে উপস্থিত । আমি এমন নই যে এলজিবিটি-এর অন্দরমহল নিয়ে বিশেষ উৎসাহিত, বরং সামনে এরকম কাউকে দেখলে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকানো আমার বরাবরের অভ্যাস । স্পষ্টত অস্বস্তিজনক অভ্যাস যাকে বলে । বিবেকে লাগলো কিনা সেদিকেও মন সায় দেয় নি । গত শুক্রবার মুকবধিরদের একটা ক্লাবের নতুন সদস্য হবার সুবাদে ওখানকার পুরোনো সদস্যদের সাথে আলাপচারিতায় ব্যস্ত ছিলাম । তাদের মধ্যে একজন মুকবধিরের চলাফেরা, আচারআচরণ যেন স্বাভাবিক ঠেকছিলো না বেশ কিছুক্ষণ ধরে । চেহারায় একটু রোগাপাতলা এবং ছোটোখাটো । আরেকটু খেয়াল করতেই যা সন্দেহের উদয় হলো সেটা অমূলক কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্যে একজনকে ডেকে জানতে চাইলাম । যা অনুমান করেছিলাম সেটাই । একটু হলেও ব্যাপারটা রীতিমতো ধাক্কা দিয়েছিলো আমাকে ।

মুকবধিরদের জন্য আলাদা সামাজিক স্বীকৃতি । অন্ধজনদের জন্য আলাদা সমাজগঠন । অ্যাসিডাক্রান্ত মহিলাদের জন্য আলাদা দলবদ্ধ সংগঠন । সন্তানদের উপেক্ষা পেয়ে বৃদ্ধবৃদ্ধাদের জন্য আলাদা পৃথিবী । মৃগীরোগীদের জন্য আলাদা আলোবাতাস । যৌনকর্মীদের জন্য আলাদা ঝড়বৃষ্টি । এই আলাদা আলাদা সমাজের কথা আমরা আকছার জেনে থাকি নিউজে বা সোশ্যালমিডিয়ার সৌজন্যে । এলজিবিটি-এর তেমনি আলাদা গ্রুপও আছে মূল-সমাজের অলিগলিতে তা খোঁজার সাধ্যবহির্ভূত আমরাই বেশিরভাগ । আবার একরকমের দল নিজেদের ছাড়া সম্পূর্ণ অন্যরকমের দল বা তাদের যাবতীয় সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ । করতেই বা যাবে কেন ?! এটাই সমাজের বহুচ্ছিদ্রময় ছবি । কিন্তু টু-ইন-ওয়ান ? দুটো ভিন্ন সমস্যা যদি একজন মানুষের মধ্যে থাকে ? আমার দেখা ক্লাবের সেই বন্ধুর মধ্যে দুটো রকমের জিনিস বর্তমান - মুকবধির প্লাস গে । এই পৃথিবীতেও অবশ্যই এরকম সম্ভব । হেলেন কেলার একইসাথে অন্ধ ও মুকবধির । আমার মামাবাড়ির এক প্রতিবেশীর ছেলে একইসাথে মৃগীরুগী প্লাস অর্থোপেডিক্যালি প্রতিবন্ধী । এরকম জোড়া জোড়া সমস্যা নিয়ে জীবনে চলতে থাকার মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয় যতই অন্তরালে পড়ে সচেতনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক । 

সেই মেয়েলি পুরুষবন্ধুর সাথে আমার চোখাচোখি হতেই আমি অস্বস্তিজনক অভ্যাসে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম । কিন্তু সে স্মার্টভঙ্গীতে এগিয়ে আমার সামনে হাজির হলো আর সাইন লাঙ্গোয়েজে জানালো, "সোমদা, আমি তোমার নাম অনেক শুনেছি । তুমি আমাদের গর্ব ।" আমি বিনয়ী সেজে কিছু বলার আগে কোত্থেকে এক দাদাটাইপের মুকবধির এসে সোজা তার মাথায় চাঁটি মেরে চা আর বিস্কুট আনার নির্দেশ দিলো । ব্যবহারের মধ্যে একটা হ্যাটা, একটা ঘেন্না, একটা অপমান এবং একটা দুর্বলের উপরে শক্তির আস্ফালন সবমিলিয়ে খুব প্রকটিত হয়ে আমার চোখে আর মনে এসে আঘাত এনেছিলো । সদ্য সদস্য হয়েছিলাম বলেই কিছু বলতে গিয়েও আটকে গেছিলো আমার । পরে সুযোগ পেয়ে ওর কাছে গিয়ে নাম বাড়ি সব জিজ্ঞেস করলাম । হাতের মুদ্রায় যেটুকু বোঝার তা বুঝে নিয়ে যেই বন্ধুসুলভ হাসিটা দিলাম করমর্দন করতে করতে । সে হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ ধরে নিজের শরীরকে আমার শরীরের সাথে লেপ্টে ছিলো । আমি ছাড়াবার চেষ্টা করতে গিয়েও পারিনি । 

বলতে দ্বিধা নেই যে কলেজজীবনে প্রথম প্রেমিকার প্রথম আলিঙ্গন, পরবর্তীকালে নানা আবেগের পাল্লায় পড়ে মেয়েবন্ধুদের নরম তুলতুলে শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা, বর্তমানে বৌয়ের শরীরী আদর - এগুলো পেয়ে এসেছি । কিন্তু এই একমাত্র 'গে'বন্ধুর ওইরকম আকস্মিক আমাকে জড়িয়ে ধরে তার মাথা আমার বুকে রাখার মেয়েলিপনা খুব একটা 'আলাদা'ও নয় । অস্বস্তির সাথে সাথে বেশ রিয়্যালাইজ করছিলাম ওর শরীরীভাষায় বেজে উঠেছিলো কোনো এক পুরুষপ্রেমিক খোঁজার আর্তি, সে এক সম্পূর্ণ নারীসুলভ বেদনা । সে ছিলো এক অনন্যসুন্দর অনুভূতি । আমার চোখে কখন যে জল এসে গেছিলো জানি না তবু কোথায় গিয়ে সংবরণ করেছিলাম ।

স্বপ্নময়দার লেখায় পড়েছিলাম একজন সমকামীর সপ্রতিভ উক্তি -"গোলাপের রং হলুদ হতে পারে । সাদাও হতে পারে ।"

2 Nov 2015

কতবার যে কুলকুচি করেছি


শুধু শুধু 'মাস্টার'-আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেলো । ব্রিজটা এখন 'আপনি'তে উঠে ক্রমদীর্ঘমান ।

ঝিঙেপোস্ত দিয়ে ভাত মেখে মুখে পুরে দিতেই বুঝতে পারলাম আমার এমন নিজের খুঁটিকে আঁকড়ে ধরে রাখার প্রবৃত্তির যতটা সামাজিক কারণ আছে, তার চেয়েও বেশি রয়েছে স্বজাগতিক কারণ । তবুও আমারটা খুবই ক্ষুদ্র দেখায় তার বিচারবুদ্ধিতে । উল্টে ব্রিজটার দীর্ঘতা তার হাতে ।

পুঁটিমাছের মুড়ো চিবোতে চিবোতে চোখ বুজলাম । সে হয়তো জানবে না এমন বনসাই-বোধ আমার ছোটোবেলা থেকে নিত্যসঙ্গী । এমন লিলিপুট-দর্শন আমার মায়ের পেটের রক্ত থেকে আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাহিত হয়ে আসছে । 

অবশেষে দুটো খালি বাটিসহ একটা গুচ্ছকাঁটাসুদ্ধু বাটি একে একে তুলে থালায় রাখতে রাখতে খেয়াল করলাম ব্রিজটা পার করার সাধ্য আমার থাকলেও সেই সুযোগটুকু দেবে না, যতদিন না আমার জগতের ভিতরদেশ তার মানচিত্রে জায়গা পাচ্ছে । আমার 'ভুল'টাকে শোধরানোর জন্যে আমি নেই, কারণ আমি নিজেই ভীষণ 'মিসটেক'প্রবণ । 

নিজের মুখ ধুয়ে ফেললাম, তার রাগ মুছে ফেলতে পারি নি । পারবো কিনা জানি না, তবে আর জোর নেই ব্রিজটাকে ভেঙে চুরমার করে ফেলার ।

সে নিশ্চয়ই জানে কতবার যে কুলকুচি করেছি ।