29 Apr 2014

শব্দের বানান


কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী
________________________________
পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ভাষা বাংলাভাষা কী সেই দূর্ভাগ্য নিয়ে এসেছে যে কেউ চাইলেই শব্দের বানান নিজের অভিরুচি অনুযায়ী পরিবর্তন করে নিতে পারে আর সেই স্বেচ্ছাচারী পরিবর্তনে কী শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয়ে যায় না ? আর কোনো ভাষা কী এইরূপ স্বেচ্ছাচারিতার অত্যাচার সহ্য করে ? আপাত দৃষ্টিতে মনে হতেই পারে, ই-কারের পরিবর্তে ঈ-কার আর উ-কারের পরিবর্তে ঊ-কার লিখলে কী আর ক্ষতি ! বাড়ীকে "বাড়ি" বললে কী থাকার জায়গা ছোট হয়ে যাবে? তাহলে বানান নিয়ে এত সংবেদনশীলতার অর্থ কী ? হ্যাঁ অর্থ আছে, অনেক অর্থ আছে যা অমান্য করলে অনেক অনর্থই ঘটে যেতে থাকে অগোচরে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় এই অনর্থ খুব ভালো করেই টের পেয়েছিলেন আর তাই উদ্যোগ নিয়েছিলেন বানান সমস্যার সমাধানের, প্রস্তাব করেছিলেন বানানের নিয়ম আবিস্কার করতে। কিন্তু বানানের সেই নিয়ম তখন আবিস্কার করা সম্ভব হয় নি। সেই সমস্যার সমাধানকল্পে এগিয়ে এসেছেন বাংলার দুই সাম্প্রতিক মনীষা -- কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী যারা উদ্ভাবন করেছেন সেই নিয়ম যা মেনে বাংলা বানানের নৈরাজ্য দূর হবে। নিচে পড়ুন কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর সর্বশেষ লেখা যা বাংলাভাষার জন্য এক যুগান্তকারী আবিস্কার।
বাংলাভাষার বানান-সমস্যা সমাধানের পথ (১ম খসড়া)
রবি চক্রবর্তী কলিম খান


বাংলাভাষার বানানে ব্যাপক নৈরাজ্য দেখে রবীন্দ্রনাথ তা দূর করার কথা ভাবেন ১৯৩৫ সালে । নিজেই তা দূর করবেন, এমন সময় বা উপায় নিশ্চয় তাঁর হাতে ছিল না । তাই তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস-চ্যান্সেলর শ্রীযুক্ত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন । সেই উদ্যোগের ফলস্বরূপ একটি সমিতি গঠিত হয় । বানানে নৈরাজ্য দূর করে নিয়মের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, ‘বাংলাভাষাকে বাংলাভাষা বলে স্বীকার করে তার স্বভাবসঙ্গত নিয়মগুলি উদ্ভাবন’ করা হোক ।(১) সেই সমিতি কিন্তু সেই নিয়ম ‘উদ্ভাবন’ বা আবিষ্কার করতে পারেননি । না করেই নানারকম বিধান দিয়ে তথাকথিত ‘বানান সংস্কার’-এর কাজ শুরু করে দেন । ফলে, বাংলা বানান নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায় তখন থেকেই, যা আজও সমানে চলছে এবং যত দিন যাচ্ছে বিধানের সংখ্যা ততই বেড়ে চলেছে । এদিকে শব্দার্থসন্ধান করতে গিয়ে আমাদের দুজনের সামনে বাংলাভাষার অন্তর্নিহিত নিয়ম ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’-এর মতো বেরিয়ে পড়ে ।(২) তাকে শব্দার্থের নিয়ম ভেবে পরখ করতে গিয়ে আমরা দেখি, বাংলা শব্দের বানান কীরকম থাকলে শব্দটির মাধ্যমে প্রকাশিতব্য অর্থ ঠিক থাকে, এ হল তারও নিয়ম । সেই নিয়মই যে বাংলা শব্দের বানানের রীতিনীতি নির্ধারণ করে, সে বিষয়ে আমরা ক্রমে নিঃসন্দেহ হই । বর্তমান প্রসঙ্গে সেই নিয়মটিকে সূত্রবদ্ধ করা দরকার । কিন্তু তার আগে সংস্কৃতভাষা ও বাংলাভাষার স্বরূপ ও সম্পর্কটি বুঝে নেওয়া জরুরী ।

‘সংস্কৃতভাষা’ শব্দটিই আমাদের বলে দেয়, সে এমন একটি ভাষা যাকে সংস্কার করে বানানো হয়েছে । রান্নার আগে গিন্নী-মায়েরা যেমন রান্নার নিমিত্ত প্রাপ্ত উপকরণগুলিকে বেছে সাফসুফ করে কেটে কুচিয়ে ধোয়াধুয়ি করার মাধ্যমে সংস্কার করে নিয়ে তবেই রান্না চড়িয়ে ব্যঞ্জন প্রস্তুত করেন, তেমনি নিশ্চয় নানা প্রকার প্রাপ্ত ভাষিক উপকরণকে সংস্কার করেই সংস্কৃতভাষা বানানো হয়েছিল । প্রশ্ন হল, সেই ভাষিক উপকরণগুলি কী ? সংস্কৃতকারগণ সেগুলি কোথা থেকে পেয়েছিলেন ?
ভাষিক উপকরণগুলি হল, শব্দসম্ভার (vocabulary) এবং শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়ম ; যে দুটি নিয়মকে যথাক্রমে শব্দের ভিতরে অর্থ নিষেক ও নিষ্কাশনের (‘semantic’) ও শব্দের পাশে শব্দ গাঁথবার (‘syntactic’) নিয়ম বলে মনে করা হয় । সেগুলি তাঁরা সংগ্রহ করেছিলেন তাঁদের চারপাশে প্রচলিত তৎকালের স্বাভাবিক (natural) ভাষাগুলি থেকে ; সংস্কৃতভাষা বানিয়ে ফেলার আগে তাঁরা নিজেরাও যে ভাষাগুলিতে কথাবার্তা বলতেন ।(৩) কিন্তু কথা হল, কীভাবে তাঁরা তাঁদের সেই প্রাপ্ত ভাষিক উপকরণগুলিকে সংস্কার করে সংস্কৃত ভাষা বানিয়েছিলেন ?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা যতদূর জেনেছি ও বুঝেছি তা হল, প্রতিটি স্বাভাবিক (natural) ভাষার হাতে তার নিজস্ব শব্দসম্ভার যেমন থাকে, সেই শব্দসম্ভারের সাহায্যে বাক্য গঠন করে মনোভাব লেনদেনের কাজ চালানোর জন্য তার স্বাভাবিক নিয়ম (natural law) দুটিও (শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়ম দুটিও) অবশ্যই থাকে ; কিন্তু থাকে অব্যক্তভাবে (tacitly) । সংস্কৃতকারগণ সেই অব্যক্ত (tacit) নিয়ম দুটিকে সূত্রবদ্ধ ও সুবিন্যস্ত করে ব্যক্ত (explicit) করে নিয়েছিলেন এবং তার সাহায্যে ঐ শব্দসম্ভারের প্রতিটি শব্দকে (প্রত্যেকটি শব্দের মাতৃকাবর্ণ, ক্রিয়ামূল, ক্রিয়া-পরিবার ইত্যাদি নির্ণয়পূর্বক বিন্যাস ও পরিমার্জন-শোধন করে) সংস্কার করে নিয়ে মনোভাব লেনদেনের কাজে বা বাক্যে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেছিলেন । আমাদের অনুসন্ধানলব্ধ বোধ অনুসারে (৫০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দের বেশ কয়েক শতাব্দী পূর্বেই) তৎকালের প্রচলিত ভাষাপ্রবাহগুলি থেকে উপাদান সংগ্রহ করে উপরোক্ত ব্যক্ত (explicit) শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়মে সংস্কার করে, জ্ঞানচর্চ্চার ও সমাজশাসনের ভাষা রূপে ব্যবহারের জন্য যে মানভাষা (standard language) বানানো হয়েছিল, সেটিই সংস্কৃত ভাষা । সেকারণে সংস্কৃতভাষা বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম ভাষাই বটে । স্বভাবতই ভাষাটির নিজস্ব বাহক স্বরূপ কোনো স্বাভাবিক (natural) জাতি ছিল না, যেমন অনাদিকাল থেকে বাংলাভাষাকে বহন করে নিয়ে চলেছে বাঙালী জাতি, কিংবা ইংরেজিকে বহন করে নিয়ে চলেছে ইংরেজ জাতি, সেরকম । তার মানে, নিজ ভাষা নিয়ে আবর্ত্তমান কোনো একটি জাতি আদিম কাল থেকে প্রজন্মক্রমে সংস্কৃতভাষা বহন করে স্বভাবত আবর্ত্তমান ছিল না, নেই । তবে সেকালের জ্ঞানচর্চ্চাকারী পণ্ডিত ও সমাজশাসকেরা এই ভাষা বহন ও ব্যবহার করতেন । তাছাড়া সেকালের ‘চারপাশের ভাষাগুলি’ থেকে উপাদান নিয়ে সংস্কার করে বানানো হয়েছিল বলে আশপাশের ভাষাভাষী জ্ঞানীগুণী ও ক্ষমতাবান মানুষেরা এই মানভাষা স্বরূপ সংস্কৃতভাষায় কথাবার্তা বলতে ও বুঝতে পারতেন । সেকারণেই প্রাচ্যের জাতিগুলির জ্ঞানতাত্ত্বিক অর্জনের অধিকাংশ মানসসম্পদ এই ভাষাতেই লিপিবদ্ধ পাওয়া যায় । সর্বোপরি, বিশ্বের সমস্ত ভাষার তুলনায় সংস্কৃত ভাষার মহত্তম গৌরব ঠিক এইখানে যে, ভাষাটিকে মানবভাষায় বিধৃত প্রকৃতির নিয়ম (natural law in human language) স্বরূপ শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক ব্যক্ত (explicit) নিয়ম দ্বারা সংস্কার করে নির্মাণ করে নেওয়া হয়েছিল । (সেকারণেই, এমনকি একালের কমপিউটার প্রযুক্তির বিচারেও সংস্কৃতই সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত ভাষা) । পরবর্তীকালে ঐ শব্দার্থতাত্ত্বিক নিয়মই যাস্কের নিরুক্তে এবং ঐ বৈয়াকরণিক নিয়মই পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে ।
এখন কথা হল, ঐ সংস্কৃতভাষা যখন বানানো হয়েছিল, তখন আমাদের বঙ্গবাসী-বঙ্গভাষীদের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা নিশ্চয় পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন, তাঁরা নিশ্চয় বোবা ছিলেন না । আর, তাঁরা যে ভাষাতেই কথা বলুন, সেটি নিশ্চয় আমাদের বর্তমান বাংলাভাষারই প্রাচীন রূপ, তা আপনি তাকে প্রাচীন প্রাকৃত, প্রাকৃত-অপভ্রংশ, প্রাকৃত বাঙ্গালা ইত্যাদি যে নামেই শনাক্ত করুন ।(৪) কেননা, আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের সেই প্রাচীন বাংলাই তো প্রজন্মক্রমে প্রবাহিত ও বিবর্তিত হয়ে এসে একালের বাংলাভাষায় পরিণত হয়েছে । তা আমাদের সেই প্রাচীন বাংলা থেকে সংস্কৃতকারগণ শব্দসম্ভার ও ভাষার নিয়মাদি নিয়েছিলেন কি ?

হ্যাঁ, নিয়েছিলেন এবং ব্যাপকভাবে নিয়েছিলেন । নিয়েছিলেন বলেই একালের ভাষাবিদ দেখতে পান যে, বাংলাভাষার ৯০ শতাংশ শব্দই সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে কমবেশি মেলে ।(৫) নিয়েছিলেন বলেই আমরা আজ বাংলাভাষার ভিতরে যে শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়মকে সক্রিয় দেখি, সংস্কৃতের শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়মের সঙ্গে তা প্রায় হুবহু মিলে যায় । তার মানে, বাংলাভাষা হল আদিম কাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে আসা এমন একটি স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক (natural) ভাষা, যার প্রাচীন রূপের নিকট সংস্কৃতভাষা যথেষ্ট পরিমাণে ঋণী । তবে সেই ঋণ পরবর্তীকালে (মধ্যযুগে) বাংলাভাষা সুদসহ ফেরত নিয়ে নিয়েছে । নিয়েছে বলেই স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক (natural) ভাষা হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তীকালের বাংলাভাষার শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়ম অন্যান্য স্বাভাবিক ভাষার মতো প্রধানত অব্যক্ত (tacit) হলেও যথেষ্ট পরিমাণে ব্যক্তও (explicit-ও) বটে । ব্যাপারটি কীরকম ?
ধরা যাক, আপনার নিজের ক্ষেতের ধান কড়াই শাকসব্জি ইত্যাদি একত্রে পাক করে সপরিবারে খিচুড়ী খেয়েই আপনি দিন কাটান । আপনার প্রতিবেশী এরকম আরও কয়েকজন আছেন । একদিন কয়েকজন সরকারী কর্ম্মী এসে আপনাদের মাঝে বসবাস করতে লাগলেন এবং আপনাদের সকলের কাছ থেকে চাল ডাল শাকসব্জি নিয়ে রান্না করে খেয়ে দিনাতিপাত করতে লাগলেন । ক্রমে জানা গেল, তাঁরা আপনাদের মতো খিচুড়ী খান না, আপনাদের দেওয়া চাল ডাল শাকসব্জি ইত্যাদি দিয়ে তাঁরা পঞ্চব্যঞ্জন রান্না করে খেয়ে থাকেন । তাঁদের ভাত ডাল সুক্তো ঘণ্ট ঝাল ঝোল অম্বল সবই আলাদা আলাদা এবং তাদের একের পর এক সুবিন্যস্তভাবে সাজিয়ে যথানিয়মে ভোজন করা হয় । রান্নাবান্না, পরিবেশন ও ভোজনের পুরো কর্মকাণ্ডটাই আপনি দেখলেন, দেখেশুনে চেখে খেয়ে শিখেও গেলেন এবং সপরিবারে সেভাবেই সেই রান্নাবান্না করে আপনার পরিবারের ভোজনব্যবস্থা চালাতে লাগলেন । এরকম করলে যা হয়, বাংলাভাষার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে । সংস্কৃতভাষার নিজস্ব মাটি ছিল না, সেকারণে নিজস্ব ফসলও ছিল না । বাংলার মাটি থেকে জাত শব্দসম্ভার এবং শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক (‘বাংলাভাষার স্বভাবসঙ্গত’) নিয়মগুলি গ্রহণ করে সেগুলিকে সংস্কার করে সংস্কৃতভাষা এক নিয়মবদ্ধ সুবিন্যস্ত ভাষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল । মধ্যযুগের বাংলাভাষা তাকে আত্মসাৎ করে সংস্কৃতভাষার থেকেও সম্পদশালী হয়ে যায় । একে তো তার নিজের মাটি, নিজের স্বাভাবিক উৎপাদন, নিজের অব্যক্ত প্রযুক্তি ; এবার তার সঙ্গে জুড়ে যায় সংস্কার-কৃত ব্যক্ত প্রযুক্তি, উভয়ের সাহায্যে নিজের জ্ঞানতাত্ত্বিক অর্জন - মধ্যযুগের বাংলা রামায়ণ মহাভারত মঙ্গলকাব্য নব্যন্যায় এবং হিন্দু-মুসলিম পদকর্তাদের সৃষ্ট ও বঙ্গসমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত পদাবলী কীর্তন … ইত্যাদিতে বিধৃত বাংলাভাষাকে দেখা যাচ্ছে, সে তার নিজস্ব ‘স্বভাবসঙ্গত নিয়মগুলি’ ব্যক্তরূপে অনুসরণ করে নিজের বিপুল বিকাশ সাধনে সমর্থ হয়েছে, অজস্র নতুন শব্দ সৃষ্টি করেছে ও বিপুল মানসসম্পদ অর্জন করেছে । (যে বর্ণগুলিতে তেমন কিছু শব্দসম্ভার সংস্কৃতের ছিল না, সেই ছ, ঝ, ঠ, ড, ঢ, থ প্রভৃতি বর্ণে উপরোক্ত ব্যক্ত প্রযুক্তির সাহায্যে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে বিপুল শব্দসম্ভার মধ্যযুগের বাংলাভাষা নিজেই সৃষ্টি করে নিয়েছে । শব্দের সূচনায় থ বর্ণ আছে, এমন কোনো সংস্কৃত শব্দই ছিল না, আর ঠ বর্ণে মাত্র একটি শব্দ ছিল ‘ঠক্কুর’।)
বঙ্গদেশে ব্রিটিশ শাসন বাংলাভাষাকে তার স্বকীয়তা ত্যাগে প্ররোচিত করলেও ১৯৩৫ সালের আগে পর্যন্ত বাংলাভাষার বিকাশ রোধ করা যায়নি । বাংলাভাষীর জ্ঞানচর্চার জগতে সে রাজার মতোই বিরাজ করেছে । কার্যত স্বাধীনতা লাভের পর দিন থেকেই বাংলাভাষার দুর্দিনের সূচনা হয় । অ্যাকাডেমিতে বাংলার শিক্ষকেরা নিষ্প্রভ হয়ে যান । বাংলাভাষাকে তার স্বভাব ত্যাগ করে ইংরেজী ভাষার মতো বানিয়ে ফেলার অ্যাকাডেমিক চক্রান্ত শুরু হয়, যার ফলে বাংলাভাষীগণ তাঁদের অতীত থেকে বিচ্যুত হতে থাকেন । ফলত, বাঙালী জাতি তার স্বভাববশত যে ভাষায় তার মানসিক শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে প্রাণবন্ত থাকত, সেই ভাষা পরিত্যক্ত হতে থাকে, ইংরেজী ভাষার দ্বারা দূষিত হতে থাকে । বাঙালীর একালের অ্যাকাডেমিগুলির সেই চক্রান্ত বর্তমানে এমন চরমে পৌঁছেছে যে সাধারণ বাংলাভাষী জনসাধারণ সাংস্কৃতিক শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করেছেন ।
এখানে আমরা দেখলাম, বাংলাভাষা নিজে একটি স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক (natural) ভাষা । সংস্কৃতভাষা সৃষ্টির আগে থেকেই সে জন্মলাভ করে প্রবাহিত হয়ে আজ পর্যন্ত এসেছে । তার ভিতরের অব্যক্ত (tacit) শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়মগুলি ব্যক্ত (explicit) ভাবেও তার হাতে রয়েছে, যদিও খানিকটা ধামাচাপা পড়ে । সেগুলির মধ্যে শব্দার্থতাত্ত্বিক নিয়মগুলিকে সম্প্রতি আমরা পুনরুদ্ধার করে একালীকরণ করেছি । সেই নিয়মই বানান সমস্যা সমাধানের কাজে লাগবে । এবার তবে সেই নিয়মকে সূত্রবদ্ধ করে নেওয়ার চেষ্টা করা যাক ।

বাংলা শব্দের বানান যেমন থাকলে শব্দটির মাধ্যমে প্রকাশিতব্য অর্থ ও উচ্চারণ ঠিক থাকে, বাংলা শব্দের বানানের সেই নীতি নির্ধারণ করে যে-নিয়ম, সেই নিয়মটিকে সূত্রবদ্ধ করলে তা এইরকম দাঁড়ায় :-

"যে বর্ণ বা বর্ণসমবায় দিয়ে কোনো শব্দ (গঠিত) লিখিত হয়, সেই বর্ণের বা বর্ণসমবায়ের অর্থ ও শব্দটির অভিধার্থ অভিন্ন হয়" (উদ্ধৃতি চিহ্ন লেখকদ্বয়ের) ।
এই নিয়ম অনুসরণ করে বাংলা শব্দের বানান লিখতে হবে । তাহলেই বাংলাভাষার বানানে নৈরাজ্য থাকবে না ।
যেমন, ‘তীর’ শব্দের অভিধার্থ হল কূল (নদীর পাড়) । তার সঙ্গে 'ত্ ী র্ অ' এই বর্ণগুলির অর্থের যোগফল এক হতে হবে । যদি হয়, তাহলে শব্দটি 'ত্ ী র্ অ' বা তীর বানানেই লিখতে হবে । আপনি বলবেন, তাহলে তো বর্ণমালার ৪৩টি বর্ণেরই অর্থ জানতে হবে । হ্যাঁ, জানতে হবে । জানতে হবে মাত্র ৪৩টি বর্ণের মানে । এবং শুধু জানলেই হবে না, তার ব্যবহারেও দক্ষ হতে হবে । আমরা সেই ৪৩টি অর্থ নিম্নে লিপিবদ্ধ করছি এবং তার প্রয়োগ বিষয়ে দিশানির্দেশ দেওয়ার চেষ্টা করছি । মনে রাখা দরকার, উপরোক্ত এই ‘বানান সংস্কার সূত্র’–এর সাহায্যে কোনো বাংলা শব্দের সংস্কার করে শব্দটি লিখলে সেটিকে সংস্কার-কৃত বাংলা শব্দ বা সংস্কৃত-বাংলা শব্দ বলা চলে । একেই সেকালের শব্দবিদগণ ব্যুৎপত্তিগত অর্থসম্পন্ন সংস্কৃত শব্দ নামে শনাক্ত করতেন । আমরা দুজন তাকেই ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি মান্যকারী শব্দ নামে চিহ্ণিত করেছি । করেছি এইজন্য যে, কোনো শব্দের ক্রিয়ামূল বোঝা যাক আর নাই যাক, তার বর্ণ ধরে নির্ব্বচন করলেই শব্দটির অর্থ নিষ্কাশন করা সম্ভব । এ নির্দেশ যাস্কের নিরুক্তেই রয়েছে । তা সে যাই হোক, ‘বানান সংস্কার সূত্র’ নামক এই নিয়মের ক্ষেত্রে এমন কয়েকটি শব্দার্থতাত্ত্বিক সত্য মেনে নিতে হয়, যেগুলিকে একালের অ্যাকাডেমিতে প্রচলিত পাশ্চাত্যের ভাষাতত্ত্ব সম্যকভাবে জানে না । আমরা দেখছি যে, লিপি, শব্দ, পদ, অর্থ, ধ্বনি, বর্ণ, ও বানান বলতে বাংলায় যা বোঝায় ও বোঝানো হয়, পাশ্চাত্যের ভাষাতত্ত্বে যথাক্রমে script, word, part of speech, meaning, phoneme, letter ও spelling বললে ঠিক তা বোঝায় না । কী বোঝায়, সে প্রসঙ্গেই আমরা যাব । কেননা, ঐ বিষয়গুলিতে বাংলা ও ইংরেজীর বোধের পার্থক্যের বিষয়ে ঠিকঠাক জানা না থাকলে উপরোক্ত সূত্রটিকে ভুল বুঝবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে । এই তুলনামূলক আলোচনায় প্রতিটি বিচার্য বাংলা শব্দের ক্রিযাভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ শুরুতেই বন্ধনীর মধ্যে দিয়ে তার পরে আমরা আলোচনায় এগোব । সর্বদা মনে রাখতে হবে, আমরা ভাষার লিখিত রূপ নিয়ে কথাবার্তা বলছি ।
লিপি :
(‘লিপ বা কালি লেপন করা সক্রিয় যাহাতে বা যে সক্রিয়তায়’, অথবা, ‘কালি দিয়ে লিপে বা লিখে যা করা হয়’) । প্রাচীন কাল থেকে মানুষ তো অর্থপূর্ণ শব্দ গেঁথে বাক্য বানিয়ে কথাবার্তা বলে আসছিল । তাতে কোনোরকম বানান সমস্যা দেখা দেয়নি । সমস্যা দেখা দেয় সেই বার্তাকে লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে । লোকে যখন কোনো শব্দ বলে, তা সে ‘পদ’ বলুক আর ‘leg’ বলুক, শ্রোতা কেবল একপ্রকার আওয়াজই (উচ্চারণই) শোনে না, তার অর্থটাও বুঝতে পারে । তার মানে, মানুষের ভাষার শব্দ মাত্রেই একটি দ্বৈতাদ্বৈত (two in one) সত্তা । সমস্যা দেখা দিল, সেই দ্বৈতাদ্বৈত সত্তাকে লিপিতে বদলে নিতে গিয়ে । একটি মানুষের দুটো পায়ের মতো লিপির প্রতিটি এককের (বর্ণের, বানানের) আওয়াজ ও অর্থ এই দুই পা-কে লিপিতে ধরে রাখা যাবে কীভাবে ? নিজ নিজ ভাষার শব্দকে লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে আদিম মানবজাতিগুলি এই সমস্যায় পড়েছিল । আমাদের অনুসন্ধান জানায়, এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে প্রাচীন মানবজাতির ভাষাগুলি প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত হয়ে যায় । ইংরেজী প্রভৃতি পাশ্চাত্যের ভাষাগোষ্ঠীগুলি যে লিপিতে লিখতে শুরু করে, তা আওয়াজ (উচ্চারণ) ধরে রাখতে সক্ষম হয়, কিন্তু অর্থ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় । লিখিত শব্দের অর্থটিকে তাঁদের বুঝে নিতে হয় আরোপিত প্রথারূপে, যার সঙ্গে লিপিবাহিত উচ্চারণের নাকি সম্পর্ক নাই । ফলত আজও লিখিত ইংরেজী ভাষাকে কাজ চালাতে হয় এমন একরকম খঞ্জ লিপি নিয়ে, যার একটি পা আস্ত থাকলেও অন্য পা-টি নেই, তার বদলে আছে বৈশাখী (ক্রাচ) । এই ধরনের নানান লিপিকে পাশ্চাত্যের ভাষাবিদগণ সংজ্ঞায়িত করেন phonetic script ব’লে । চীনাগোষ্ঠীর ভাষাগুলি আবার এমন লিপিতে লিখতে শুরু করে, যা অর্থ (idea) ধরে রাখতে সমর্থ হয়, কিন্তু আওয়াজ ধরে রাখতে পারে না । ফল হয় এই যে, চীনের এক প্রদেশের মানুষ অন্য কোনো প্রদেশের মানুষকে চিঠিপত্র লিখে পাঠালে, পত্রপ্রাপক বার্তাটি বুঝে নিতে পারে বটে; কিন্তু পত্রপ্রেরক যদি তার চিঠিতে লেখা সেই বাক্যগুলি উচ্চারণ করে প্রাপককে বলতে শুরু করে, সে তার কিছুই বুঝতে পারে না । প্রাপক উচ্চারণ করে চিঠিটি পড়লে প্রেরকেরও একই দশা হয় । তার মানে, চিঠির লিপি অর্থ বহন করে নিয়ে যেতে সক্ষম, কিন্তু আওয়াজ বহন করে না । সেই কারণে চীনা লিপিকে ideographic script ব’লে চিহ্ণিত করা হয়েছে । তার মানে, ইংরেজী প্রভৃতি লিপিগুলির যদি বাঁ পা খোঁড়া হয়, তো চীনা লিপির ডান পা খোঁড়া । এদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃত বাংলা প্রভৃতি ভাষাগুলি যে লিপির ব্যবহার শুরু করে, তা একই সঙ্গে শব্দের আওয়াজ ও অর্থকে ধরে রাখতে সমর্থ হয় । হয় বলেই লিখিত ‘পদ’ যেমন আমরা উচ্চারণ করতে পারি, তেমনি তার ভিতরের ‘পালন দান করে যে’ অর্থটিও বুঝতে পারি । সেই অর্থকেই ‘পদ’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বা ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ বলে । তদ্রূপ অর্থ ধারণ করে বলেই শব্দটি পদাঘাতের পদ, পদাধিকারীর পদ, পদোন্নতির পদ, পদচ্যুতির পদ, গানের পদ, ভোজনের পদ, বাক্যের পদ, ধর্মের পদ … ইত্যাদি যে কোনো প্রকার পদকে বোঝাতে পারে । তবে তার কোন অর্থটি বোঝা হবে, তা ঠিক হয়, বাক্যের প্রেক্ষাপট অনুসারে । সুতরাং, বাংলাভাষায় যখন আপনি কোনো শব্দকে লিপিবদ্ধ করতে যাচ্ছেন, আপনাকে মনে রাখতে হবে, আপনি শব্দটির আওয়াজ ও অর্থ দুটিকেই লিখছেন । কেননা, আমাদের লিপির দ্বৈতাদ্বৈত (two in one) চরিত্র কমবেশি অক্ষুণ্ণ আছে, দুটো পা-ই রয়েছে, আজও । পাশ্চাত্যের ভাষাবিদগণ এবং তাঁদের শিক্ষায় অত্যন্ত প্রভাবিত ভারতবর্ষীয় ভাষাবিদগণ আমাদের লিপির এই স্বভাবকে বুঝতেই পারলেন না । পারতেন, যদি না তাঁদের অর্থবহনের দায়িত্বহীন phonetic script-এর তত্ত্বে তাঁরা সম্পূর্ণ নিমগ্ন (conditioned) থাকতেন । সেকারণে আজ আমরা আমাদের লিপিকে আখ্যাত করছি phonetic-cum-ideographic script বা phono-ideographic script. এরপরও আপনি বলতে পারেন, উচ্চারণকে ধারণ করাই যদি ইংরেজী লিপির যোগ্যতা হয়, তবে gnat, know, knife প্রভৃতি লিখিত ইংরেজী শব্দ তাদের উচ্চারণকে যথাযথ ভাবে ধারণ করে না কেন ? করে না কারণ, ইংরেজী শব্দেও যে এককালে অর্থ নিহিত থাকত, ঐ ধরনের লিখিত শব্দগুলি তারই রেশ টেনে নিয়ে চলেছে আজও । তার মানে, আমরা যে বাংলাভাষায় কথা বলি, তার আদি রূপ ও ইংরেজী ভাষার আদি রূপ যে একই ছিল, এই ধরনের ইংরেজী শব্দগুলি তারই স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে । আমাদের ‘জ্ঞ’ (জ্ + ঞ) ও ইংরেজীর know (gnow) তার স্পষ্ট উদাহরণ । যাই হোক, আমরা যদি লিপিবাহিত আওয়াজ ও অর্থকে যথাক্রমে লিপির দেহ ও মন বলি, তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইংরেজী লিপির দেহ আছে মন নেই, চীনা লিপির মন আছে দেহ নেই, আর বাংলা লিপির দেহ-মন দুই-ই আছে । বাংলা শব্দ লিখবার সময় কথাটি ভোলা চলবে না ।

শব্দ :
(‘শব দান করে যে’ বা ‘মনোভাবের শব দান করে যে’ কিংবা ‘ঘটনা বা ক্রিয়া অতীত হইলেও তাহার যে মৃতদেহ আওয়াজ রূপে চাউর হইয়া থাকে’) । ইংরেজিতে যাকে word বলে, বাংলায় তাকে শব্দ বললে শব্দের অর্থকে সঙ্কুচিত করে ফেলা হয় । কেননা, বাংলায় মানুষের মুখনিঃসৃত ভাষিক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে যেমন শব্দ বলে, বাহ্যজগতের যে কোনো আওয়াজকেও (sound-কেও) শব্দ বলে । বাংলায় ভাষিক শব্দের ভিতরে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ (meaning) ও অর্থপূর্ণ ধ্বনি (meaningful sound) বা উচ্চারণ উভয়ই থাকে, বাহ্যিক শব্দের ভিতরেও আওয়াজের (sound-এর) উৎস-স্থলের ঘটে যাওয়া (মেঝেতে চামচ পড়ার মতো) ঘটনার বা ক্রিয়ার সংবাদও (অর্থও) থাকে । বাংলায় ‘শব্দ’ বাক্যের অংশ নয়, বাক্যের অংশ হল ‘সক্রিয়-শব্দ’ যাকে ‘পদ’ বলা হয় । ইংরেজির word–এর ভিতরের বর্ণগুলি বিশেষ আওয়াজ (sound) ধরে রাখে বটে, কিন্তু কোনো প্রকার অর্থ (meaning) আবশ্যিকভাবে ধারণ করে না বলেই পাশ্চাত্যের ভাষাতাত্ত্বিকগণ ঘোষণা করে রেখেছেন । যখন কিনা বাংলা ভাষার প্রতিটি শব্দই উচ্চারণের পাশাপাশি আপন গর্ভে তার অর্থ ধারণ করে রাখে । সেকারণে লিখিত বাংলাভাষার শব্দ মাত্রেই অর্থধারী আওয়াজের লিপিবদ্ধ রূপই বটে । সুতরাং বাংলাভাষায় শব্দকে লিপিবদ্ধ করতে গেলে, তার অর্থ ও আওয়াজ দুইই যেন লিখিত শব্দটির ভিতরে থাকে, সে কথা মনে রাখতে হবে ।

পদ :
(‘পালন বা প্রাপণ দান করে যে’, বা ‘যাহা দ্বারা জীব মানুষ সংস্থা সমাজ বাক্য গান ভোজন মূলধন … প্রভৃতি এক বা একাধিক পদীগণ হাঁটে’) । বাক্যে ব্যবহৃত শব্দকে পদ বলে । তার মানে, সক্রিয়-শব্দকে পদ বলা হয় । কেননা, মানুষ যার উপর নির্ভর করে হাঁটে, তাকে যেমন তার পদ বা পা বলে, তেমনি বাংলার বাক্য তার যে অংশগুলির উপর নির্ভর করে হাঁটে সেগুলিকে সেই বাক্যের পদ বা পা বলে । ইংরেজিতে একে part of speech বলা হয় । প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে দুটি তো আসলে একই কথা । কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, বাংলার লিখিত বাক্যের পদ যেন একটি মন-প্রাণবান জীবন্ত মানবদেহের প্রত্যঙ্গগুলি । তার প্রতিটি প্রত্যঙ্গই সমগ্র বাক্যশরীরের সঙ্গে বাস্তবিক ও মানসিক ভাবে যুক্ত, পৃথক করে নিলে প্রত্যঙ্গটির বা পদের অর্থ ক্ষুণ্ণ হয়ে যায় । বাংলায় বাক্য গঠনকালে প্রতিটি শব্দকে সক্রিয় সজীব করে নিতে হয় । যেমন, ‘আমি’ ‘বিদ্যালয়’ ‘যা’ এই তিনটি শব্দকে বাক্যে পরিণত করতে গেলে বিভক্তি-প্রত্যয়াদি যুক্ত হয়ে শব্দগুলি হয়ে যায় ‘আমি বিদ্যালয়ে যাই’। ‘বিদ্যালয়’তে এ বিভক্তি, যা-এ ই বিভক্তি এবং এমনকি ‘আমি’তে শূন্য বিভক্তি জুড়ে তাদের একত্র করে একটি দেহমন-সম্পন্ন বাক্যে পরিণত করা হয়েছে । ইংরেজীর বাক্য গঠন কালে প্রতিটি শব্দকে সক্রিয় সজীব করার উপায় নাই । তাতে বিভিন্ন নিষ্ক্রিয় শব্দকে আংটা বা নাটবল্টু দিয়ে জুড়ে নিয়ে একটি রোবোটের ন্যায় দেহসম্বল বাক্য বানানো হয়, যে বাক্যদেহটি সচল হয় বাইরের কারও নির্দেশে । ইংরেজী বাক্যের I, school, go এই শব্দগুলিকে অদলবদল করে জুড়ে নিয়ে বানানো হয় ‘I go to school’. যেন তিনটি নিষ্ক্রিয় মরা প্রত্যঙ্গকে to নামক আংটা দিয়ে জুড়ে নেওয়া হল । তার মানে বাংলা ভাষায় বাক্য গঠন কালে শব্দের পাশে শব্দ গাঁথার প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ও প্রাণবন্ত ; যান্ত্রিকতা যেটুকু দেখা যায়, তা আধুনিকতার দূষণ । আর, ইংরেজী ভাষার বাক্য গঠন কালে শব্দের পাশে শব্দ গাঁথার প্রক্রিয়াটি যান্ত্রিক, সজীবতা যেটুকু দেখা যায়, তা প্রাচীন উত্তরাধিকারের রেশ । বাংলার লিখিত বাক্যের পদ সজীব সপ্রাণ দেহমনধারী বাক্যের জীবন্ত অংশ । আর ইংরেজীর লিখিত বাক্যের part of speech হল মন-প্রাণহীন রোবোটের বিচ্ছিন্ন হাত পা মাথা ইত্যাদি । লিপিবদ্ধ করার সময় বাংলা ও ইংরেজী বাক্যের অংশগুলির এই পার্থক্য মনে রাখতে হবে ।

অর্থ :
(‘অর বা পুনরাবর্তন থাকে যাহাতে বা যে বিকল্পে’, কিংবা ‘সামাজিক মানুষ যে পুনরাবৃত্তি-যোগ্য জ্ঞান-ধন লাভের চেষ্টা করিয়া থাকে’) । বাংলাভাষায় লিখিত শব্দের ভিতরে তার অর্থ থাকে । সেই অর্থকে সেকালে ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বা অভিধার্থ বলা হত, আমরা তাকে একালীকরণ করে তার নাম দিয়েছি ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক (ধ্বনিভিত্তিক) অর্থ । দেহের ভিতরে প্রাণ-মন-আত্মা থাকার মতো শব্দের ভিতরে নিহিত থাকে বলে, একে আপনি শব্দের নিহিতার্থও বলতে পারেন । এই অর্থের সঙ্গে স্বভাবতই শব্দের দৈহিক সম্পর্ক বর্তমান থাকে । এই অভিধার্থের উপর নির্ভর করেই তার লক্ষণার্থ ও ব্যঞ্জনার্থগুলি সক্রিয় হয়ে থাকে । সেকারণে বাংলাভাষার শব্দ বা পদকে লিপিবদ্ধ করার সময় তার অভিধার্থকেই শব্দের অন্তর্ভুক্ত করে রাখা হয়ে থাকে, লক্ষণার্থ বা ব্যঞ্জনার্থকে নয় । ওদিকে ইংরেজী ভাষার লিখিত শব্দের ভিতরে সেরকম কোনো meaning থাকে না, আরোপিত প্রথারূপী অর্থকে বা arbitrary meaning-কে বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় । সেই প্রথারূপী আরবিট্রারি অর্থের উপর নির্ভর করে বিকশিত হয় তার metonymy, metaphor, contextual meaning প্রভৃতি যা আসলে বাংলাভাষার লক্ষণার্থ ও ব্যঞ্জনার্থেরই অধঃপতিত রূপ । তাই বাংলাভাষার বাক্য বা শব্দ যখন লিপিবদ্ধ করা হয়, তার বানানের ভিতরে অবশ্য অবশ্যই শব্দের অভিধার্থটিকে নিষেক করে রাখা হয়, রাখতে হয়, রাখতে হবে । লিখিত বাংলাভাষায় এই রীতি বহু প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে ।

ধ্বনি :
(‘ধারণ-বহন সক্রিয় যাহাতে’, অথবা ‘যাহা কোনো এক প্রকার ধারণা বা অর্থ বহনকারী আওয়াজ রূপে উচ্চারিত হইতেছে’) । ধ্বনি শব্দটির অভিধার্থ হল, ‘ধারণা বহনের সক্রিয়ন যাহাতে’ । কার্যত এ হল ধারণা বহনের সক্রিয়তা । তার মানে, বাংলাভাষার ধ্বনি হল এমন এক আওয়াজ-ধারী সত্তা যা ধারণা (অর্থ) বহনের কাজে সক্রিয় রয়েছে । সেখানে ইংরেজী ভাষায় রয়েছে phoneme । সে হল উচ্চারণের একক, যার কাঁধে অর্থের বোঝা নাই, কিন্তু আওয়াজের বোঝা আছে । সুতরাং বাংলার ধ্বনি আর ইংরেজীর phoneme আদৌ এক ব্যাপার নয় ।

বর্ণ :
(‘ক্রিয়ার আধার রূপে স্বভাবত বরেণ্য যে’) । বাংলাভাষায় রয়েছে ৪৩টি মাতৃকাবর্ণ । তাদের প্রত্যেকের সুনির্দিষ্ট বহুরৈখিক অর্থ আছে । সেই ৪৩টি বর্ণে গড়ে উঠেছে (দাশবংশ, ঘোষবংশ ইত্যাদির মতো) ক-বংশ, খ-বংশ প্রভৃতির মতো ৪৩টি শব্দবংশ । এরূপ প্রত্যেকটি শব্দবংশ থেকে জাত হয়েছে অজস্র শব্দ-পরিবার, প্রত্যেকটি পরিবারের আবার রয়েছে দুশো-পাঁচশো শব্দ-সদস্য । এইভাবে ৪৩টি শব্দবংশ থেকেই বাংলাভাষার বিশাল শব্দসম্ভার সৃষ্টি হয়েছে । মনে রাখা দরকার, শব্দ-পরিবারের শব্দ-সদস্যদের মধ্যে থেকেই অনেককে বাক্যের কর্মী রূপে খাটার জন্য ডেকে কাজে লাগানো হয় । তাদেরকেই পদ বলে । ইংরেজী ভাষায় letter-এর সে গৌরব নাই, অর্থ তো letter-দের নাই-ই, শুধুমাত্র a আর i এর অর্থ ছাড়া । ইংরেজীর সেই letter-এর সংখ্যা এমনিতেই মাত্র ২৬টি । ত-বর্গটি তার নাই বললেই চলে । তাছাড়া ইংরেজীর শব্দবংশ, শব্দ-পরিবার, শব্দসদস্য স্মৃতিভ্রষ্ট ও অস্পষ্টভাবে থাকলেও ইংরেজী ভাষাবিদগণ তাদের উদ্ধার করে সংস্কার করে একালীকরণ করতে পারেননি আজও । সংস্কৃতকারগণের অর্জিত শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক প্রযুক্তির সহায়তায় ও বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় বাংলাভাষায় বর্ণমালাকে এমন সুবিন্যস্ত করে সাজিয়ে রাখা আছে, যার সঙ্গে কেবল মেনডেলিয়েভ টেবিলেরই তুলনা করা যায় । আদিম বাংলা ভাষায় তখনও পর্যন্ত ছ ঝ ঠ ঢ থ প্রভৃতি বর্ণে বলতে গেলে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র শব্দ সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু বর্ণমালায় একেবারে অঙ্ক কষে প্রত্যেক শব্দবংশের জন্য ঘর ছেড়ে রাখা হয়েছে । তাঁরা জানতেন, এই ঘরের শব্দগুলি জন্মাবে পরে । যে কোনো বাংলা অভিধান দেখলেই বোঝা সম্ভব, ঐ বর্ণগুলিতে পরবর্তী কালে কী পরিমাণে কত নতুন নতুন শব্দ জন্মেছে ।

স্বভাবতই বাংলা ভাষার উপরোক্ত ৪৩টি বর্ণেরই আওয়াজ ও অর্থ দুইই আছে । কিন্তু মানবমনের গভীরে এক রহস্যময় প্রক্রিয়ায় এই আওয়াজ ও অর্থ প্রস্তুত হয় বলেই তাকে উদ্ধার করা কঠিন । সেই কারণে বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণের অর্থ দুর্বোধ্য সন্দেহ নাই । এর কারণ হল, একক ধ্বনি বা বর্ণকে নিয়ে মানবমনের গভীরে যে অর্থময় ধ্বনির বিবর্তন (meaningful-phonemic evolution) চলে, উপরিতলে মানবের মুখের উচ্চারিত ভাষায় তাকে প্রকাশ করা সহজ কাজ নয় । যেমন ‘চালক’, ‘পালক’ প্রভৃতি শব্দের ক্ষেত্রে ‘ক’ বর্ণের ‘করে যে’ অর্থটি সুস্পষ্ট ও প্রকট, অধিকাংশ বর্ণের অর্থ কিন্তু তত প্রকট নয় ; কারও কারও অর্থ অস্পষ্ট, কারও বা খুবই অস্পষ্ট ও রহস্যময় । সেরকম বর্ণগুলির (ধ্বনিগুলির) অর্থ অনুভব করা গেলেও ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন । কিন্তু করা যায়, করতে হয়, করতে হয়েছে, একেবারে নিখুঁতভাবে না হলেও । আজ আমরা নিঃসন্দেহ যে, অ থেকে হ পর্যন্ত বর্ণমালার সমস্ত বর্ণের অর্থ আছে ; সেজন্যেই তাদের নিয়ে গড়ে ওঠা শব্দেরও অর্থ আছে এবং সেই অর্থের প্রচলনও আছে । শুধুমাত্র তাই নয়, তার ঐতিহাসিক সত্যতা যেমন রয়েছে, তেমনি নিত্যতাও বর্তমান রয়েছে । নিত্যতা আছে বলেই আজও বাংলার মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষেরা আওয়াজ ও অর্থবান নব নব শব্দ সৃষ্টি করে চলেছেন । ‘টপকা-ঝোল’, ‘পুঁচকে-ঝলক’, ‘পাগলু’ প্রভৃতি তার টাটকা উদাহরণ । ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির সাহায্যে সেই সব নব নব শব্দগুলিকে সংস্কার করে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল । প্রয়োজন ছিল, আমাদের পূর্বসূরীগণ আমাদের শব্দসম্ভার নিয়ে যে কাজ করে গিয়েছিলেন, নানান কারণে যার উপর শ্যাওলা জমে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল, সেগুলিকেও উদ্ধার করা ও একালীকরণ করা । আমাদের শব্দার্থকোষগুলিতে আমরা তা সাধ্যমতো করেছি, একেবারে নিখুঁতভাবে ও সম্পূর্ণভাবে করে ফেলেছি এমন দাবি আমরা করি না । শব্দতত্ত্ববিদগণ অনেকে মিলে হাত লাগালে তবেই কাজটি সম্পূর্ণ ও নিখুঁত হতে পারে । এখন তাহলে বাংলাভাষার মাতৃকাবর্ণগুলির অর্থ যেরূপ পাওয়া গেছে, সেগুলি উপস্থাপন করা দরকার । কেননা, বানান সংস্কার করার জন্য ঐ অর্থগুলি লাগবে । নিম্নে বানান ও spelling-এর তুলনামূলক আলোচনা করে তার পরই আমরা সেই অর্থ সরবরাহ করে তার প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করব ।
বানান :
(‘শব্দ বানাকরণ বা নির্মাণ চলমান যাহাতে’, অথবা, ‘নিয়মানুসারে বর্ণের সহিত বর্ণ যোগ করিয়া শব্দ বানানো বা নির্মাণকরণ করা চলমান যাহাতে’) । বাংলায় যাকে বানান বলা হয়, ইংরেজীতে তাকে spelling বলা হয়ে থাকে । বাংলায় ‘বানান’ মানে হল, যে এক বা একাধিক বর্ণের ইট দিয়ে একটি শব্দ বানানো হয়, সেই ইটগুলির কথা বলা । ইংরেজীতে spelling মানে হল, শব্দ ভাঙলে যে বর্ণের ইট বা ইটগুলি পাওয়া যায়, যেন সেই ইটগুলির কথা বলা । একই কথা হলেও বাংলায় বলা হয় শব্দ গড়তে কী কী লাগছে তার কথা, যখন কিনা ভাঙলে কী কী পাওয়া য

25 Apr 2014

Elomelo #72


পরমের উপর চরম
চরমের উপর করম
করমের উপর গরম

হারিয়ে যায় নরম,
খালি ছ্যাঁকায় খড়ম!

ভুল


টকটকে লাল । রক্তবর্ণ লাল । লাল রঙের রাজকীয় দাপট প্রায় সর্বত্র-ই দৃশ্যমান । বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক যুদ্ধবিগ্রহ বা হানাহানি থেকে শুরু করে গোলবাড়িতে কনের শাড়ি । তবে লাল রং দৈনন্দিনতার মূলধারায় কখনো সখনো প্রতীকী হয়ে ওঠে । কার প্রতীক ? কিসের বা প্রতীক ? সি.পি.এম. এর ? নিকুচি করেছে । আমার পুরোনো সেই ধুলোমাখা স্কুলখাতায় লালকালিতে কাটা বড়ো সড়ো ক্রসচিহ্ন ( X ) সমেত ভুলাবলীর কথা বলছি । যা কিনা পোস্ট-মডার্নাইজড্ যুগে আমার বর্তমান ল্যাপটপস্ক্রীনে ফুটে ওঠা লাল অক্ষরযুক্ত  'Authentication Failed' এর সমার্থক । কিন্তু এই ধরণের অসতর্কতাজনিত ভুলের উৎপত্তি নিয়ে ব্যাখ্যা করা আমার মত নিতান্ত সাধারণ দ্বিপদ প্রাণীর পক্ষে সম্ভব নয়, বরং এড়িয়ে যাওয়া ভালো । নইলে ভুল নিয়ে আরো ভুল ব্যাখ্যা বেরোতে পারে যে 'ভুল'কে zoom in করলে-ই ভয়ানক লাগবে, zoom out করলে-ও চুকচুক করবে ভুলটা ।  

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই । অবশ্য-ই অতি সতর্কতা সহকারে ।  তার আগে একটি প্রশ্ন হলো - 'ভুল'-এর সত্যি এরকম কোনো Unit of Measurement ( UoM ) আছে নাকি ভুল একটি নিরাকার মানবসৃষ্টি যাকে আমরা নিজেদের দৃষ্টিসীমা দিয়ে আকার দিই ? যেকোনো একটা 'ভুল'কে ছোটো বা বড়, সামান্য বা মারাত্মক ইত্যাদি বিশেষণ দিয়ে স্লাইডার দিয়ে মেপে বসি, কেন ? আসলে 'মানুষ মাত্রে-ই ভুল করে' - এই বহুপ্রচলিত সাধুবাদ আমাদের সবার মুখে এখনো নির্ভুলভাবে সচল ।  কিন্তু এই চিরাচরিত পর্দার পেছনে যে একটা অতিনাটকীয় মঞ্চ আছে এবং সেই মঞ্চে ঠাঁই করে থাকা 'মানুষ' নামের ছাপমারা আঠালো নায়কের খলনায়কীয় বিবেক বা খলনায়কের নায়কীয় রিটেক চলে সেটা হয়তো অনেকের দৃষ্টির গোচরে পড়ে না, বা পড়তে-ই দেয় না মানুষ স্বয়ং । কারণ ওই মঞ্চটা এতো সূক্ষ্ণভাবে পরিকল্পিত এবং হাতসাফাইয়ের মত সুপরিচালিত যে পুরোটা-ই ম্যাজিক শো-এর মত হয়ে যায় । বস্তুতঃ ম্যাজিশিয়ানরা স্টেজে যে ম্যাজিক দেখায়, তার আড়ালে কত কূটকৌশল থাকে, যা আমরা চোখে দেখে বুঝতে পারি না । কিন্তু আমরা জানি এর পেছনে কোন কৌশল আছে, তাই কোন ম্যাজিক দেখে অভিভূত হলেও আমরা বলি- “এর পেছনে কোন মারাত্মক চালাকি আছে নিশ্চয়ই” । বাস্তবেও ঠিক তাই অর্থাৎ মানুষের একটা সহজাত প্রবণতা আছে যে সে যা দেখে সেটাই বিশ্বাস করে । “আমি নিজের চোখে দেখেছি” - বাক্যটা নিজের কথাকে জাস্টিফাই করার একটা কমন হাতিয়ার। । ফলস্বরূপ এখানে চলে আসে সেই স্লাইডার । 

অনেকের নিশ্চয় জানা আছে প্রফেসর আইজ্যাক আজিমোভ ( নামের বিশুদ্ধ বাংলা বানান সঠিক জানা নেই বলে অনিচ্ছাকৃত ভুল বানানের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী ) - এর বিখ্যাত বই 'দি রিলেটিভিটি অফ রং' (The Relativity of Wrong) - এর কথা । এখানে উনি বলে গেছেন - 'ভুল'-এর নির্দিষ্ট কোনো মাত্রা নেই । অর্থাৎ আসলে বিজ্ঞান হল স্বতঃলব্ধ জ্ঞান । একটা গাড়ির চাকা কীভাবে বানালে গাড়িটা দ্রুত চলবে সেটার জন্য মানুষ তার নিজের জ্ঞানবুদ্ধি ও যুক্তি ব্যবহার করে নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় । যেহেতু স্বতঃলব্ধ জ্ঞান মানসিকতার সাথে পরিবর্তন হয়, তাই বিজ্ঞানের পরিবর্তনশীলতা চলমান । মানুষের স্বতঃলব্ধ জ্ঞান অপরিপূর্ণ । উপরোন্ত চর্মচক্ষে যা বোঝা যায় তার বাইরে কোন মত গেলে স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে বাধ্য যে সেটা 'ভুল', তাই মেনে নিতে কষ্ট হয়।

আবার সামান্যতম একটি ভুলের জন্যে মারাত্মক রকমের যে পরিণাম হতে পারে সেটা অনেকে-ই অক্ষরে অক্ষরে মানে । অনেকে নিজেদের অবিশ্বাসকে বিজ্ঞান দিয়ে ঢাকতে চায়। তারা না বোঝে বিজ্ঞান, না বোঝে ধর্ম, না বোঝে দর্শন। এদের সাথে খুব বেশি যুক্তিতর্কে লিপ্ত হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তারা প্রথমে নিজেদের অবিশ্বাসের পক্ষে যুক্তি দিতে চাইবে। সাধারণতঃ এদের কুযুক্তি বেশিক্ষণ ধোপে টেকে না। তারপর তারা ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসে এবং অপ্রাসঙ্গিক কথা টেনে গালিগালাজ করে একে অন্যকে ট্র্যাক থেকে সরাতে চেষ্টা করে । বাঙালিদের মধ্যে এই ধরণের 'ক্র্যাব মেন্টালিটি' (Crab Mentality) এক এক সময়ে এমন লাগামছাড়া হয়ে যায় যে 'ভুল'-এর বাস্তবিক অস্তিত্বটুকু-ও ভুলে যায় ।


সবশেষে উল্লেখ করি - অস্কার ওয়াইল্ড উবাচ 
"Whenever people agree with me I always feel I must be wrong" - এটা আমি আজ-ও মেনে চলার চেষ্টা করি । 

21 Apr 2014

Elomelo #71


ল্যাম্পপোস্টটি ল্যাম্পচ্যূত হলো । শুধু পোস্টটা থেকে গেলো । জাস্ট ফালতু ।

নিশ্চাপ


'চাপ' যে দৈনন্দিনতার প্রতীক সেটা আমরা সকলে-ই মানি । প্রাকৃতিক আবহাওয়া থেকে শুরু করে কেন্দ্রিক নাওয়াপাওয়া - সবটাতে চাপের উপস্থিতি লক্ষণীয় ।

'নিম্নচাপের বলয় তৈরী করা', 'রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া' , 'কাজের চাপ কমে যাওয়া' (যদিও উল্টোটা প্রায়-ই হয়) ইত্যাদি কতরকম চাপ হয় তার তালিকা বের করা বেশ চাপের কাজ । তার উপর কথায় কথায় চাপের শাপান্ত করার অভ্যাস বহুকালব্যাপী ।

"আর বলিস না, যা চাপে আছি না ... ", "আরে চাপ নিও না ...", "ওকে শালা আর একটু চাপ দে তো ...", এমনকি মুখের চাপজনিত ঘাম রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে "না না চাপ নিচ্ছি কোথায়? কুল্ আছি ভাই ..." বলে স্বকীয় দৃশ্যমান 'চাপ'টাকে চাপাচাপি করার চেষ্টাকরণের চিত্র আমাদের বহুদিনের চেনা ।

কিন্তু প্রকৃত চাপ বলতে উপরে ভাসমান কাল্পনিক শূন্যতাধারক বা কক্ষচ্যুত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বা জীবনের চলমান রেখার আকস্মিক ফুলস্টপে সম্ভাব্য পরিবর্তককে বোঝায় কিনা সেটা আমার মত একজন রেগুলার চাপখেকোর মনে প্রশ্নসূচক ছুঁচ ফোটায় । সেটা অবশ্য-ই অপ্রাসঙ্গিক ।

খালি মনে হয় এই 'চাপ'টা প্রকৃতপক্ষে চ্যাপ্টা করতে অক্ষম, বরং কন্ট্রোলারের মত একটা সুপরিকল্পিত কাজ করে । যথেষ্ট কারণ আছে বোঝানোর জন্যে কিন্তু সবিস্তারে ব্যাখ্যা করার যে চাপ তা কাটিয়ে ওঠা মুশকিল । এমনকি নিম্নচাপের খবর দিয়ে শেষে কবে যে কাটবে সেটা সঠিকভাবে বলতে ব্যর্থ স্বয়ং আবহবিদ ।

যাইহোক, চাপসৃষ্টি থেকে চাপমুক্ত হওয়ার নানাবিধ পদ্ধতি আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ধৈর্যবান হওয়ার পাহারপ্রমাণ চাপ নেওয়া নাহলে ফাঁক বুঝে বারে ঢুকে কয়েক পেগ খেয়ে ক্ষণিকের জন্য চাপমুক্তির স্বাদবোধ আস্বাদন করা ।

ও হ্যাঁ, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রেড ওয়াইনের অবদান বহুপ্রচলিত । ড্রিংক করে চাপমোচন করো ।

সুতরাং চাপকালীন নিশ্চিন্তে থাকার বদলে 'নিশ্চাপে' থাকার চেষ্টা করতে পিছপা হও না ।

15 Apr 2014

বর্ষবাবু


কিছুটা অশুভ সংকেতময়, খানিকটা পুরাতন ত্রুটিপূর্ণ চেহারা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে হতাশাবাদী বর্ষবাবু । সাথে ব্যাগভর্তি অনিশ্চয়তা ।

তবুও প্রতিবারের মত ভালো কিছু একটা হবে এই আশায় মাঝপথে দাঁড়িয়ে পড়ে সে । দাঁড়ানোর ভঙ্গি তার অনেকটা-ই ব্যর্থ বাংলা সিনেমার নায়কসুলভ ।

সৌজন্যচর্চিত মনটুকু পড়ে আছে বলে ব্যাগটির ভিতরে থাকা রেকর্ডার থেকে মাঝেমাঝে বেজে ওঠে যান্ত্রিকবার্তা -

"সকলে ভালো না থেকে নিদেনপক্ষে চেষ্টা করো বাংলাকে ভালোভাবে টিকিয়ে রাখার"

14 Apr 2014

কোবিতার কিচ্ছু বুঝিনা / Piyush Kanti Banerjee


এই বেলা কানেকানে এক্টা সোত্তিকথা স্বীকার কোরে নিই - কোবিতার বিন্দুবিসোর্গোও আমি বুঝিনা। অথোচো বোঝার চেষ্টা কোরিনি এমোনও নয়। এই মাগ্যিগন্ডার বাজারেও ট্যাঁকের(পড়ুন পকেট) টাকা খসিয়ে বোইপত্তোর কিনলাম। আগে রাত জেগে মদোনদেবের আরাধোনা কোর্তাম, তার জায়গায় সারোস্বত সাধোনায় ব্রোতী হোলাম। রোবীন্দ্রোনাথ ফোবীন্দ্রোনাথ পোড়ে লাভ নেই জান্তাম, জীবনানন্দো, শঙ্খো ঘোষ, বিনয় ফিনয় পোড়ে তেমোন কিছু হওয়ার নয়, আর সুনীল ফুনীল তো হালের বাজারীদের কোবি, ওর যে দাদা খালিপুরে চাকরি কোরে, সেতো এক্টা আস্তো …ইত্যাদিইত্যাদি

কাজেকাজেই ফিলিপাইনের কোবিদের কোবিতার অনুবাদ পোড়লাম, ম্যাডাগাস্কারের কোবিদের কোবিতা পোড়লাম, হনোলুলুর গনোসোঙ্গীত, জাভা, গ্রীস, নাইজেরিয়ার মেঠো কোবি, চিলির কেঠো কোবি, ন্যুডিস্ট কলোনির হেটো কোবি …সক্কোলের কোবিতা পোড়লাম। চোমকে যাওয়ার কিছু নেই. ওনুবাদই পোড়েছি। ওতোগুলো ভাষা জানলে দোভাষীর কাজ কোর্তুম, পকেটে দেদার ডলার আস্তো, এই কোবিতা ফোবিতা নিয়ে ঝাঁট জ্বলানো ভাট বোক্তে আস্তাম কি মোর্তে!

তা অনেক্কিছু শিখলাম টিখলাম। শ্লা কি বড়োবড়ো আওয়াজ! ম্যাজিক রিয়ালিজম, হাইপার রিয়ালিটি,
পোড়ি আর গা শিরশির কোরে ওঠে। যেটা পোড়ি সেটাই ফাটাফাটি লাগে। কদিন রকে, মোড়ে, ফেসবুকের দেয়ালে সেইটা নিয়েই বুকনিবাজি করে বেড়াই। যেটা জানি সেটা নিয়ে বোলি, যেটা জানিনা সেটা নিয়ে বেশী কোরে বোলি। কেউ ট্যাঁফোঁ কোর্লেই গলা চড়াই। কেউ বেশী ওস্তাদী মাড়ালে স্যাট কোরে কালটি নিয়ে উইকি থেকে দেখে নিয়ে আবার বাওয়াল। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে চোলছিল বৈপ্লোবীক পোস্ট , যেমোন ধোরুন -

শক্তি চাটুজ্জে পোড়লেই আমার হাগা পাই।
জয় গোঁসাই এর লেখা পাতলা ডিমের ঝোলের মতো।
নীরেন্দ্রনাথ চোক্কোতি বোলে কেউ একজন কোবিতা লেখে শুনলাম।
তার নিজে বিভিন্ন স্মাইলির কারুকাজ! !

আবার কখনো সখোনো বানান কোরা কঠিন এমন সোব কোবিদের এক আধটা লাইন থেকে কোট কোরা।
ফাটিয়ে কোবিতাও লিখছিলাম। মোম্বাতি মিছিলের সমোয় এট্টু ধর্ষোণ আর বাকি সমোয় ফুচকার মোধ্যে তেঁতুলজলের মতো দর্শোন গুঁজে দিচ্ছিলাম।

কেউ খাচ্ছিলো, কেউকেউ মোনেমোনে খিস্তি দিচ্ছিলো। সাম্নে এসে দুর্ছাই বোল্বে এমোন হিম্মোত্‍ কোনো শ্লা এর নেই। বোল্লেই বোলতাম - নিশান্তোকুমারের কোবিতা পোড়েছেন? চীনের দার্শোনিক কোবি লিপাং চ্যাএর?ডাডাইস্ট মুভমেন্টের কথা শুনেছেন? পাস্টিচে কাকে বলে জানেন? ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি?হিস্টোরিওগ্রাফিক মেটাফিকশন?

ব্যস! সামনেওয়ালার বাত্তি গুল। ল্যাজ পেছোনে গুঁজে কাঁইকাঁই কোর্ছে, এটাই তো হিট কোরার মোক্ষোম টাইম, বাপ। ভক্তো আর বোন্ধুদের ডেকে এনে এমন দিলাম , এ জন্মে আর খারাপ বলার সাহোস পাবেনা।

আর সমালোচনা? সেটাতে যে আমার মাস্টারী ছিলো, এতো আমার হেভভি শোত্তুরেও স্বীকার কোর্বে।
বেশ গুছিয়ে লিখতুম, পয়েন্ট ধোরেধোরে।

১/ বহুপ্রচলিত শব্দ কোবিতাটিকে অতি ছাপোষা কোরে দিয়েছি। প্রেম, মা, কষ্ট, উপোস ইত্যাদির পরিবোর্তে যদি - গেম, পা, লষ্ট(এটার অবশ্য কোন মানে নেই কিন্তু মানেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, স্থানকালপাত্রভেদে একটা অর্থো আপনি কোরে নিতেই পারেন),হুপোস ইত্যাদি বসালে কোবিতাটি ইউনিক হতো।

২/ ওতি শুস্ক কাষ্ঠের ন্যায়। ভালোলাগার মতো মাংস বা ছালচামড়া না থাক্লে কোবিতা হয়!(এটা ছোট কোবিতার ক্ষেত্রে )

অতিরিক্ত মেদ। ফলে নান্দনিক হয়ে ওঠেনি।(বড়ো কোবিতার ক্ষেত্রে)

৩/ ছন্দে গোলমাল আছে মনে হলো।(এখানে চুপিচুপি বলে রাখি , এ সম্পর্কে "মেরা কোই আইডিয়া নেহি হে। যেটা বোলি সেটা পিওর উল্লুক বনাইং, চেপে ধোর্লে হুঁহাঁ কোরে কাটিয়ে দেবো। না ধোর্লে লোকে তো জানবে যে আমি ছন্দোটন্দো বুঝিটুঝি আর কি )

এগুলো ছাড়াও - আপনিও কোবিতা লিখছেন?
কোদিন বাড়িতে বোসে আঁক কাটুন।
ইত্যাদি কটা কমেন্টস পেস্ট করার জন্যে রেডি রাখতাম।

আর ছিলো মিউচুয়াল শেয়ারিং …মানে আমি দাদারটা শেয়ার কোর্লে দাদা আমার্টা শেয়ার দেবে …এই ফোর্মুলাও সুপার্হিট ছিলো।

কিন্তু যাইকোরিনা ক্যানো মানুষ তো রে বাবা!
লজ্জাঘেন্না বোলে এক্টা বোস্তু তো আছে নাকি?নিজেই বুঝতে পার্ছি, সাপলুডুর খেলায় চোড়তেচোড়তে একশো'র ঘরে পৌঁছাবার ঠিক আগেই সড়াত্‍ কোরে নিজে নেমে গেলুম।

কেন? সেটাই বল্বো বোলে অ্যাতো ভ্যানতারা, বস।
কোবিতা তো আবেগের ছড়াছোড়ি নয় বরোং পাক্কা সায়েন্টিফিক এক্সপেরিমেন্ট। কাজেকাজেই শব্দোগুলোর মানুষের উপোর যেমোন প্রোভাব পড়ে, কুকুর ছাগল হিপো ডলফিন এমন কি আমাদের পোষা হুলো'টার উপোরও তেম্নি প্রোভাব পোর্বে ভেবে একটা আপাদমস্তক আধুনিক কোবিতার প্রোথোম লাইন্টা যেই পোড়েছি, শ্লা, ওঁয়াও ঘ্যাঁক বোলে দাঁত ফাঁত বের কোরে তেড়ে এলো গো!

কি নেমকহারাম! কি হাড়হারামি! কি অনাধুনিক বিকৃত রুচির বেড়াল, ভাবুন।

মাইরি বোলছি, হেভভি হেল্পলেস লাগছে। না পার্ছি তেড়ে খিস্তোতে, না পারছি কটা পোস্ট মডার্ন থিওরি আওড়ে শ্লা হুলোটাকে জব্দ কোর্তে!

সাধেই কি বোলছি কোবিতার কিচ্ছু বুঝিনা! এতোদিন লম্ফোঝম্ফো কোরাই সার হোলো! এক্টা ওশিক্ষিতো হুলোকে খুশি করার মোতো একটা কোবিতাও লিখতে পার্লাম না গো।

শেম শেম! !!!

10 Apr 2014

Elomelo #70


প্রত্যেক পুরুষমানুষের মধ্যে একটা নারীসত্তা লুকিয়ে থাকে । সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মত ।

9 Apr 2014

কাঁকড়া বিছার দল / Milan Chattopadhay


সময়টা নব্বুইয়ের দশকের শেষ দিক । আমাদের প্রাচীন মফঃস্বলের ঠিক মাঝামাঝি একটি বিখ্যাত স্কুলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কিছু পাগলাটে কিশোর । সুমন ইতিমধ্যেই এসে গেছেন তাঁর নিষিদ্ধ ইস্তেহার নিয়ে, নচিকেতা'র নীলাঞ্জনা আসলে কে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে হয়রাণ কিশোর অঞ্জনের স্যামসান আর ডেলাইলায় ডুবে যাচ্ছে । বিকেল হলেই বড়বাজার মাঠে গান নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে এবং অবশ্যই অধরা প্রেম নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে । টিউশুনির টাকায় শখের গোল্ডফ্লেকের কাউণ্টার নিয়ে রীতিমত চাপানউতোর চলাকালীন ই.এফ. সি -র আবিস্কার, অর্থটা হল - ইমারজেন্সি ফাস্ট কাউণ্টার । চুটিয়ে ক্রিকেট, খেপ খেলতে গিয়ে দুপিস আলু আর পাউরুটিতে পার্ক স্ট্রিটের মহার্ঘ খানার থেকেও বেশী স্বাদ ।
আমাদের ছোট্ট শহরে বাইকের প্রাদুর্ভাব তখন নেই বললেই চলে, এমনকি সকলের সাইকেলও ছিল না । বড়বাজার মাঠে সাইকেল নিয়ে গেলেও সবসময় খেয়াল রাখতে হত চাকার ফুলের দিকে ! একটু অন্যমনস্ক হলেই তাতে অগ্নিসংযোগ করে পরস্পরের আনন্দ কোন ক্রিকেট খেলায় ম্যান অফ দ্য ম্যাচের থেকে কম ছিল না ।

সেই পাগলাটে কিশোরদের দলে যারা ছিল আজ তারা প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত । কেউ এঞ্জিনিয়ার, কেউ উকিল, কেউ কেন্দ্রীয় সরকারী চাকুরে,কেউ শিক্ষক, কেউ শিল্পী, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ ম্যানেজমেন্টের মানুষ আবার কেউ ব্যর্থ কবি । এই দলে অনেকেই ছিল, তবে আলাদা করে যাদের নাম করতেই হয় তারা হল - সম্বুদ্ধ, সুপ্র, বিড়ি, অর্ণব, গিরি, মাইতি, বিপ্লব, বাবান, সঞ্জয়, বদনাম - ইত্যাদি ইত্যাদি ( সব্বাই আছিস বস, নাম করলাম না বলে খার খাস না ) । আমাদের প্রিয় নদী চূর্ণীর ধারেই ছিল আমাদের স্কুল - পালচৌধুরী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় । তখন হেড মাস্টার ছিলেন - হিমাংশু বাবু । অংক পাগল লোক, কিছুটা খ্যাপাটে কিন্তু ভালো মানুষ । স্কুলে ঢোকার সময় থেকেই আমাদের যাবতীয় কেলো শুরু হয়ে যেত । প্রেয়ার লাইনেও যা বজায় থাকত । ফাঁক পেলেই আমরা দুটো খেলাই খেলতাম - ফুটবল আর ক্রিকেট । টীম করে ফুটবলে আমি কোনোদিন জুত্‌ করতে পারিনি, ওটায় বিপ্লব, তারাশঙ্কর, সুপ্র, সম্বুদ্ধই যাবতীয় সময় বল পায়ে রাখত । একটা ক্যাম্বিস বল বা কাগজ দিয়ে বল বানিয়ে আমরা প্রায় সকলেই মারাদোনা, পেলে হওয়ার চেষ্টা করতাম । আর খেলা হত ক্রিকেট । হলঘর থেকে বেঞ্চের পায়া ভেঙে ব্যাট বানিয়ে ক্রিকেট খেলায় আমি বেশ পারঙ্গম ছিলুম । একবার স্যার চলে আসার পরেও আমি একমনে শ্যাডো করায় বেশ নাকাল হতে হয়েছিল । স্কুল বসার প্রথমার্ধে এসব হলেও টিফিনের পর আমরা পালানোর তালেই থাকতাম । সিক্সথ পিরিয়ডে হেড স্যার নিজেই আসতেন ক্লাস নিতে । আমাদের ঘরটা ছিল রাস্তার পাশেই, তাতে ছিল বিরাট বিরাট জানলা এবং গ্রীলহীন । আমাদের মধ্যে সবথেকে বেশী স্বার্থত্যাগ করতো অমিতাভ মাইতি । বিজ্ঞান বিভাগের অন্যতম সেরা এই ছাত্রটি বিরাট লম্বা ( ৬ ফুট ৩ ) হওয়ায় পালাতে সক্ষম হত না বলে ওকেই দায়িত্ব দেওয়া হত ম্যানেজমেন্টের । একটি সিরিয়াস ও কঠিন ক্যালকুলাস ওকে আগে থেকেই দেখে আসতে হত যাতে হেড স্যারকে ওই অংকের ফাঁদে ফেলা যায় । হতও তাই । সেই অংক নিয়ে স্যার এমনই ডুবতেন যে আমরা যে কখন জানলা গলে, পাঁচিল টপকে পালাচ্ছি - তা ধরতেও পারতেন না । ক্লাস থেকে বেরোনোর পর সবথেকে বড় ঝামেলা ছিল স্কুলের বাইরে যাওয়া । আমাদের দারোয়ান ছিল মঙ্গল'দা, ও কিছুতেই আমাদের বেরোতে দিত না । ফলে আমাদের পাঁচিল ডিঙোতে হত । খুবই উঁচু পাঁচিল বলে সাইকেল নিয়ে টপকানো কঠিন ছিল । তবে আমাদের স্যার মনোজবাবু ছিলেন খুবই মাইডিয়ার, তিনি আমাদের রাস্তার ঠিক কোন জায়গা দিলে নামলে সুবিধে হবে বলে দিতেন । আর সাইকেল পার করার দায়িত্ব নিত - বিপ্লব, সুপ্র, শম্ভু আর তারা । এভাবে একসময় পুরো ক্লাস ফাঁকা হয়ে যেত একদম শেষে স্যার পিছন ফিরে দেখতেন - বেবাক খালি সব আমরা ইস্কুল থেকে বেরিয়েই বাবানদের বাড়ি থেকে ব্যাট, বল নিয়ে চলে যেতাম আরও বেশ কিছুটা দূরে থানার পিছনের মাঠে । সেই মাঠের নাম ছিল 'নীচের মাঠ' । পাশেই চূর্ণী, নদীর ধারে আমাদের ক্রিকেট খেলার সেসব স্মৃতি কোনোদিন মুছে যাবে না । খেলা শেষে নদীতে হাত-পা ধুয়ে আমরা আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরতাম । পরে সেসব খেলা নিয়েও লিখবো ।
পরদিন স্কুলে গেলেই আমাদের চরম ধমক খেতে হত । হেড স্যারের হাত থেকে তখন নানা কথা বলে রেহাই পেতাম এবং পুনরায় একই কাজ করতাম । হেডস্যার আমাদের ওপর মারাত্মক রেগে নাম দিয়েছিলেন - কাঁকড়া বিছার দল । রাণাঘাটের ইতিহাসে আমাদের এই দল তাদের বন্ধুত্ব, প্রাণময়তা, দুষ্টুমি, সমমর্মিতা ও অধীত বিদ্যার পারদর্শিতার জন্য চিরকাল একটা বিশেষ জায়গায় থাকবে । এমন অসামান্য বন্ধুত্ব আজকের দিনে বিরলই নয় দুর্লভ ।
তোদের বন্ধু হতে পেরে আমি গর্বিত রে । কোনোদিন তোদের ভুলতে পারব না । শুধু আমাদের একজন আর ফিরে আসবে না কোনোদিন । সুপ্রতীপ - বছর বারো আগে ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে আমাদের এই প্রাণোচ্ছল বন্ধুটি চলে গেছে - আন ভুবনের পারে ।
কাঁকড়া বিছার দল থেকে একটি বিছে হারিয়ে গেছে । বড্ড মনে পড়ে তোকে ভাই, বড্ড মনে পড়ে । তবে চিন্তা নেই, অলকানন্দার তীরে আবার আমরা একদিন একসাথে হব, আবার চুটিয়ে ক্রিকেট খেলবো ! সে জগতে যে চিরবসন্ত রে । সেই পুরনো কিশোরবেলার পড়ন্ত বিকেলের মায়াবী আলোয় আবার তুই ডানদিকে ঝাঁপিয়ে ক্যাচ নিবি আর আমি চেঁচিয়ে বলে উঠবো - হ্যাউজ দ্যাট ।

8 Apr 2014

হাইকু লেখার উপর কিছু তথ্য



আরশাদ উল্লাহ

হাইকু কবিতা নিয়ে অনেক লেখক অনেক রকম আলোচনা করেছেন। তাদের অনেকেরই মন্তব্য ছিল যে
হাইকু হল ১৭ টি syllable এর কবিতা যা তিনটি লাইনে লিখা হয়। তাদের ধারনা প্রথম লাইনে ৫ টি,
দ্বৈতীয় লাইনে ৭ টি ও তৃতীয় লাইনে ৫ টি সিলেবল থাকে। এ কথা জেনে অনেকেই হাইকু লিখতে গিয়ে সিলেবল খুঁজাখুঁজি শুরু করেন। কিন্তু Willium J. Higginson তাঁর লেখা বই The HAIKU HANDBOOK টিতে অনেক গবেষণা করে লিখেছেন যে জাপানী হাইকু পাশ্চাত্য দেশে লিখা হাইকু থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ, জাপানী হাইকু তাদের ট্রেডিশন্যাল ধারায় ৫-৭-৫ পদ্ধতিতে লিখে এবং তাদের লিখা হাইকুতে সিলেবল নেই। জাপানী হাইকুতে 'অনজি' থাকে সিলেবল নয়।
উদাহরণ হিসাবে তিনি যেমন দেখিয়েছেন তা নিম্নরূপঃ

English syllable: a, o্‌ two, wrought
Japanese onji: a (আ); n (ণ); ka (কা); shi (শি); tsu (ৎচু), ইত্যাদি।

উপরের ইংলিশ সিলেবল এ, অন, টু, রট, উচ্চারণ করতে প্রলম্বিত স্বর বুঝা যায়। আবার জাপানী হাইকুতে যে সব বর্ণকে 'অন্‌জি' বলা হয়েছে সেগুলির উচ্চারণ “আ, ণ, কা, সি, ৎচু/তু”, ইত্যাদি। এগুলি কিন্তু জাপানী ৪৮ টি 'হিরাগানা' বর্ণের পাঁচটি বর্ণ। সুতরাং বর্ণ গণনায় ৫-৭-৫ টি বর্ণ মিলে মোট ১৭ টি বর্ণ হয়। এগুলিকে 'অঞ্জি' বলা হয়। বাংলা ব্যাঞ্জন বর্ণে অনেক অনজি আছে, যেমন, খ, ঘ, চ, থ, ঝ, ঠ, ইত্যাদি। তাই বাংলাতে হুবহু জাপানী পদ্ধতিতে মোট সতের বর্ণে হাইকু লিখা সম্ভব। অর্থাৎ যে অক্ষরে বেশি চাপ দিয়ে উচ্চারণ করতে হয় এমন অঞ্জি এর ও প্রয়োগে হাইকু লিখলে ভাল হাইকু হবে। যেমন, খ ও থ ধ্বনিতে চাপ দিতে হত।
আমার কথা হল বাংলাতে হাইকু লিখতে হলে জাপানী হাইকুর নিয়মাবলি মেনে লিখাই উত্তম। আমরা যদি ইংলিশ হাইকুর ধারা মতো লিখি তাহলে বড় বিভ্রান্তিতে পড়তে হবে।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে ইংলিশ এবং জাপানী হাইকুর এক অনুবাদ অনুষ্ঠান করেছিল নিউ ইয়র্কের Japan Society, Inc. সে অনুষ্ঠানে ইংলিশ হাইকু কবি ও লেখক Willium J. Higginson উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাঁর বইটিতে অনুষ্ঠানটির উপর ব্যাক্ষা দিয়ে লিখেছেন যে সেখানে ২৮ টি হাইকু কবিতা আবৃত্তি করা হয়েছিল। ইংরেজীতে যিনি অনুবাদ করেছেন তিনিও একজন হাইকু কবি ছিলেন। তিনি অনুবাদ হাইকু পাঠ করার সময়ে কম সিলেবল ব্যবহার করেন। কিন্তু বিস্ময়ের কথা হল ইংরেজীতে অনুবাদ করা হাইকুটি জাপানী হাইকুর তুলনায় পড়তে ৬০% দীর্ঘ সময় নেয়। সময়ের ব্যাপারটি হয়তো আবৃতি যিনি করেছেন তার উপর নির্ভর করেছে। সে যাই হোক, আবৃতি অনুষ্ঠান শেষে হিজ্ঞিন্‌সন জাপানী হাইকু লেখক ও ইংলিশ হাইকু লেখকের সাথে কথা বলে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করাতে উভয়ে উত্তর দিয়েছেন যে তারা নিয়মাবলী অনুসারেই হাইকু পাঠ করেছেন। অথচ আবৃতির সময়ের ব্যাপারটি বিবেচনা করলে বেশ ব্যতিক্রম আছে তা বুঝা গিয়েছে।
বাংলা হাইকুতে কিন্তু ইংলিশ হাইকুর মতো অধিক সময় নিবেনা। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি যে বাংলা ও জাপানী হাইকু আবৃতি করলে একই সময়ে শেষ হয়।
নিম্নে দু'টি জাপানী হাইকু কবিতার ইংলিশ ও বাংলা করেছি। যেহেতু জাপানী ভাষা জানি সেহেতু জাপানী ভাষা থেকে অনুবাদ করা হয়েছে। ইংলিশে অনুবাদ করেছেন হিজ্ঞিন্‌সন।
এ হাইকুটি লিখেছেন কবি বাশোঃ
furuike ya old pond........ জ্বলা পুকুর
kawazu tobikamu a frog leaps in বেঙ্গের লাফালাফি,
mizuno oto water's sound জলের শব্দ.........

এ হাইকুটি লিখেছেন কবি ইস্‌সাঃ
utsukushiki a really lovely অতি সুন্দর
tako agarikeri kite has risen above ঘুড়ি উড়ে উপরে,
kojiki goya a begger's hut ভিখারি ঘর.........

হাইকু দুটিতে 'কমা' দিয়েছি এ জন্য যে প্রথম বারটি বর্ণ বা অক্ষর বোধগম্য। একটি ঘুড়ি উপড়ে উড়ছে; তারপর 'ভিখারি ঘর' কথাটি লেখা। তাতে বুঝা যাচ্ছে যে উপরের ১২ টি অক্ষরে যে বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে নিচের পাঁচটি অক্ষরে লেখা কথাতে সামঞ্জস্য নেই মনে হচ্ছে। এটাও এক রহস্য, কারণ হাইকুতে অনেক কিছু উহ্য থাকে যা বুঝে নিতে হয়। পূর্ণাংগ বাক্য না হলেও হাইকু হয়। 'ভিখারি ঘর'
কবির চোখে পড়েছে প্রথমে, তারপর লক্ষ করেছেন অতি সুন্দর রঙ্গিন ঘুড়ি যার উপরে উড়ছে। এখন চিন্তা করলে সবার নিকট কবিতাটির ভাব পরীষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু সে ভাব কিন্তু বড় গভীর অর্থ বহন করছে। তা হলো একজন ভিখারির নড়বড়ে ঘরের উপর উপরে রঙ্গিন উড়ন্ত ঘুড়ি দেখে কবি অবাক। তাই সে ভাবটি হাইকুতে প্রকাশ করেছেন। এখন বাকি রইল 'সময়' কি করে দেখালেন? আমার আগের লেখাতেও উল্লেখ করেছি যে সময় প্রকাশ করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ একটি সীজন উল্লেখের মাধ্যমে। তা না হলে সঠিক হাইকু হবেনা। এ হাইকুতে ঘুড়ি উড়াবার সময়টি বুঝে নিলেই হবে। শীত প্রধান দেশে বসন্ত কালে অর্থাৎ মার্চ মাসে শিশু দিবসে ঘুড়ি উড়ায়। তবে আমার কথা এখানে শেষ হয়নি। শেষের লাইনটি যদি ভিখারি(র) ঘর হতো তা হলে আরো পূর্ণাংগ বাক্য হতো। কিন্তু 'র' বাদ দিয়েছি। এই বাদ দেওয়ার প্রথাও জাপানী হাইকুতে রয়েছে। তাকে বলে 'কিরেইজি' অর্থাৎ কাটা বা বাদ দেওয়া অক্ষর। 'র' বাদ দিয়ে পাঁচটি অক্ষরে মিলানো হয়েছে। তাতে কিন্তু হাইকুটি অসম্পূর্ণ হয়নি। ট্রেডিশন্যাল জাপানী হাইকুতে দু'টি 'rhythmical unit' বা সমান তাল বা মাত্রা থাকে। উপরে 'কমা' লক্ষ করলে তা বোধগম্য হবে। উপরে বারটি অক্ষরে বা অন্‌জিতে ও নিচে পাঁচটি অক্ষর বা অনজিতে লিখা হয়েছে। আবার উপরে পাঁচটি লিখে নিচে বারটি অক্ষরেও হাইকু লিখার প্রথা আছে। কমা দিতেই হবে এমন কোন নিয়ম নেই। পাঠককে বুঝার জন্যে কমা দিয়েছি।

যারা হাইকুতে আগ্রহি তাদের মনে রাখতে হবে যে ট্রেডিশন্যাল হাইকুর সৃষ্টি হয়েছে অসম্পূর্ণ দীর্ঘ কবিতার স্তবক থেকে। তাই হাইকুতে সমান তাল বা মাত্রাও অসম্পূর্ণ থাকে। হাইকুতে সাধারণ ব্যাকারণ নীতি বর্জন করা হয়। তাতে অসম্পূর্ণ বাক্য থাকে এবং জটিল ক্রিয়াও বর্জন করা হয়।
হাইকুর লিখতে আরো কিছু কথা স্মরণ রাখা উচিত। তা হল বাংলাতে হাইকু লিখতে ৫-৭-৫ অক্ষরেই লিখতে হবে ও যুক্তাক্ষর একটি গণনা করা হবে। ইংরেজী, জার্মন ও ইটালিয়ান ভাষাতে হাইকু লিখতে হলে 'সিলেবল' এ লিখা হয়। বাংলাতে যথাপোযুক্ত অক্ষর যুক্ত করে মাত্রা বা তালের সাথে মিল রেখে লিখতে হবে। একটি কথা মনে রাখতে হবে যে হাইকু লিখা সহজ নয়। একটি পারফেক্ট হাইকু লিখতে হলে অনেক ভাবতে হয়। আর সেটি যথার্থ হাইকু হল কিনা তা পড়েই বুঝা যাবে। আমি আবার বলছি বাংলা হাইকু বাংলা ভাষাতে জাপানী হাইকুর অনুকরনে লিখা সম্ভব। নিম্নের প্রথম অনুবাদ হাইকুটি কবি মাতচুও বাশোর লিখা আর দ্বিতীয়টি আমার নিজের লিখা হাইকু।
“নিষ্প্রাণ ঘোড়া,
শকুনের ছায়ায়
উড়ন্ত মাছি......”

“গ্রীষ্মের মশা
রক্ত খেকো পতঙ্গ,
নির্ভীক যুদ্ধা......”

কবি রিন্‌কা অনোর অনুবাদ তিনটি হাইকুঃ
“ডিনার শেষে
লোকটি যুদ্ধে যাবে,
কোষে জোনাকি......”

“বর্ষাবরষণ
মনে হচ্ছে গৃহিনী
পিছে দাঁড়ানো …...”

বরফ পথ,
কৃত্রিম পায়ে হেঁটে
গির্জাতে কুঠো......



রেফারেন্সঃ
=======================
The HAIKU HAND BOOK
How to write, share, and Teach Haiku,
by William J. Higginson with Penny Harter
Kodansha International; Tokyo. 323 pp.

=======================
MATSUO BASHO
The Narrow Road to the Deep North and
Other Travel Sketches
Translated by Nobuyuki Yusa
Penguin books 167 pp.

7 Apr 2014

রাগ করো আর সুখে থাকো


রাগ জিনিসটা বড়ো ভালো, উপাদেয় আর সৌন্দর্যবিজ্ঞানগত ভাবে ভীষণ উপকারী । নারীরূপে আলোকিত রাগ কোন পুরুষমানুষ চায় না? আবার রাগ যে পৌরুষব্যঞ্জক তা নারীমহলে ফিসফিসানির সূত্রপাত ।

তবে রাগামি করতে হলে চট করে বা দুম করে নয়, নাহলে রাগের কার্যক্রিয়া ভুস্ করে ফুরিয়ে যাবে । শুরুতে মাথাটা ভালো করে রাগশ্যাম্পু দিয়ে মাখিয়ে নিতে হয়, যাতে প্রচুর রাগফেনা তৈরী হয় । এতে মন ও শরীর দুটোতেই ভালো-ই কাঁপুনি আসে । কেঁপে কেঁপে খেপে ওঠার জন্যে ভালোতর প্রোডাক্ট বাজারে পাওয়া যাবে না । জনপ্রিয়তাকরণে এর ভূমিকা এক এবং অদ্বিতীয় ।

বুকে বুক ঠেকে রাগবিনিময় সামাজিক নিয়মের মধ্যে অবিলম্বে ফেলা হোক । বছরে যতবার কোলাকুলি হয়, তার চেয়েও এটা অনেকবেশি সংখ্যায় বাড়ানো খুব জরুরী । সাথে সাতপুরুষের জাত তুলে সমস্ত গুরুত্বসম্পন্নকথা লেনদেন করে সম্পর্কে চিড় ধরিয়ে দেওয়ার মত রাউণ্ড রাখতে হবে । একের পর এক ঘামক্লান্তকারী ব্যস্ততা থামিয়ে সেই সামাজিকোৎসবে মেতে ওঠা বিধিবদ্ধ করা উচিৎ । এতে পরিবেশ আরো জমজমাট হয়ে ওঠে ।

বিনারাগে সময় কাটে বেকার রক্তহীনতায় । বরং রাগ বয়ে আনে সময়োচিত রক্তপ্রবাহ । রাগ তাই মানুষের প্রাণ । প্রাণপণে প্রাণবধ করে প্রাণভর শান্তিলাভের যে মারাত্মক বীজ লুকিয়ে থাকে মনের এককোণে তা মানুষের পরিচিতিকে সুস্থায়িত্বদান করতে ওস্তাদ ।

সুতরাং থাকছে খুন করা বা মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে দেওয়া বা যেকোনো পরিকল্পনামাফিক অপরাধমূলক কাজ করার মত ওয়ান্-টাইম অ্যাচিভমেন্ট যা দিয়ে সমাজকল্যাণের নামে ঘরের শ্রীত্ব লাভ করা যায় ।

এর অন্য বিকল্প ভাবতে যাওয়া-ই দুঃখের নামান্তর ।

রাগ করো আর সুখে থাকো ।

১লা এপ্রিল


শুধু আজ কেন? ফুল এপ্রিল ধরে চলবে, না?

এত গরম যে এপ্রিল স্টুপিড বা এপ্রিল ইডিয়ট বললে বিদ্যুৎ পর্যন্ত ও চমকাবেন না ।



Elomelo #69


দুমদাম ঘামঘুম
৩১ বছরী হাফপ্যান্ট হিসিতুল্য ভেজা

তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে জামা-ই নিজে সারারাত ঘর-কান্নায় ব্যস্ত ছিলো

3 Apr 2014

কবিতার শেষে Morality


আচ্ছা, কবিতার মানে শেষ দুটো বা শেষ স্তবক শুধু ভালো হতে-ই হবে ? প্রায়শ দেখি  বেশিরভাগ কবিতায় শুধু শেষ কথাটি বা স্তবকটি নাড়িয়ে দেয় , কাঁপিয়ে দেয় , চমকে দেয় , মাথা নুইয়ে দিতে বাধ্য করে লাস্ট অবধি অথচ আগের লাইন গুলো নিয়ে কোনো উচ্চমধ্যনিম্নবাচ্য হয় না । বিন্দুমাত্রও না ।  

কবিতা যখন লিখতে বসা হয় তখন লাইনের পর লাইন সাজিয়ে দেওয়া হয় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে । শেষে এসে যখন ছেড়ে দেওয়ার সময় আসে তখন কি শুধু ঐটুকুন সময়ে সর্বস্ব ঢেলে দেওয়া হয় মনোগ্রায়ী করে তোলার জন্যে ? শুধু ফিনিশিং টাচে এতো দার্শনিক বা ইন্টেলেকচুয়াল বা চমকপ্রদ হয় কেন ? একটা সোজা রাস্তায় হাঁটার পর শেষ প্রান্তরে এসে মন কি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক নিতে শুরু করে যা পেরিয়ে আসা রাস্তায় ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ ?
তবে এটা ঠিক পুরো চেহারা জুড়ে চাকচিক্য আনা দুঃসাধ্য দু একটা ব্যতিক্রম থাকে অবশ্য-ই । কিন্তু বক্তব্যের শেষে কেন কাইন্ড অফ "Morality" বা "Conclusion" এসে উঁকি মেরে যায় ? এটা-ই ভাবাচ্ছে । 

2 Apr 2014

Elomelo #68


শুধু আজ কেন? ফুল এপ্রিল ধরে চলবে, না?
এত গরম যে এপ্রিল স্টুপিড বা এপ্রিল ইডিয়ট বললে বিদ্যুৎ পর্যন্ত ও চমকাবেন না ।