9 Apr 2014

কাঁকড়া বিছার দল / Milan Chattopadhay


সময়টা নব্বুইয়ের দশকের শেষ দিক । আমাদের প্রাচীন মফঃস্বলের ঠিক মাঝামাঝি একটি বিখ্যাত স্কুলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কিছু পাগলাটে কিশোর । সুমন ইতিমধ্যেই এসে গেছেন তাঁর নিষিদ্ধ ইস্তেহার নিয়ে, নচিকেতা'র নীলাঞ্জনা আসলে কে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে হয়রাণ কিশোর অঞ্জনের স্যামসান আর ডেলাইলায় ডুবে যাচ্ছে । বিকেল হলেই বড়বাজার মাঠে গান নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে এবং অবশ্যই অধরা প্রেম নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে । টিউশুনির টাকায় শখের গোল্ডফ্লেকের কাউণ্টার নিয়ে রীতিমত চাপানউতোর চলাকালীন ই.এফ. সি -র আবিস্কার, অর্থটা হল - ইমারজেন্সি ফাস্ট কাউণ্টার । চুটিয়ে ক্রিকেট, খেপ খেলতে গিয়ে দুপিস আলু আর পাউরুটিতে পার্ক স্ট্রিটের মহার্ঘ খানার থেকেও বেশী স্বাদ ।
আমাদের ছোট্ট শহরে বাইকের প্রাদুর্ভাব তখন নেই বললেই চলে, এমনকি সকলের সাইকেলও ছিল না । বড়বাজার মাঠে সাইকেল নিয়ে গেলেও সবসময় খেয়াল রাখতে হত চাকার ফুলের দিকে ! একটু অন্যমনস্ক হলেই তাতে অগ্নিসংযোগ করে পরস্পরের আনন্দ কোন ক্রিকেট খেলায় ম্যান অফ দ্য ম্যাচের থেকে কম ছিল না ।

সেই পাগলাটে কিশোরদের দলে যারা ছিল আজ তারা প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত । কেউ এঞ্জিনিয়ার, কেউ উকিল, কেউ কেন্দ্রীয় সরকারী চাকুরে,কেউ শিক্ষক, কেউ শিল্পী, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ ম্যানেজমেন্টের মানুষ আবার কেউ ব্যর্থ কবি । এই দলে অনেকেই ছিল, তবে আলাদা করে যাদের নাম করতেই হয় তারা হল - সম্বুদ্ধ, সুপ্র, বিড়ি, অর্ণব, গিরি, মাইতি, বিপ্লব, বাবান, সঞ্জয়, বদনাম - ইত্যাদি ইত্যাদি ( সব্বাই আছিস বস, নাম করলাম না বলে খার খাস না ) । আমাদের প্রিয় নদী চূর্ণীর ধারেই ছিল আমাদের স্কুল - পালচৌধুরী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় । তখন হেড মাস্টার ছিলেন - হিমাংশু বাবু । অংক পাগল লোক, কিছুটা খ্যাপাটে কিন্তু ভালো মানুষ । স্কুলে ঢোকার সময় থেকেই আমাদের যাবতীয় কেলো শুরু হয়ে যেত । প্রেয়ার লাইনেও যা বজায় থাকত । ফাঁক পেলেই আমরা দুটো খেলাই খেলতাম - ফুটবল আর ক্রিকেট । টীম করে ফুটবলে আমি কোনোদিন জুত্‌ করতে পারিনি, ওটায় বিপ্লব, তারাশঙ্কর, সুপ্র, সম্বুদ্ধই যাবতীয় সময় বল পায়ে রাখত । একটা ক্যাম্বিস বল বা কাগজ দিয়ে বল বানিয়ে আমরা প্রায় সকলেই মারাদোনা, পেলে হওয়ার চেষ্টা করতাম । আর খেলা হত ক্রিকেট । হলঘর থেকে বেঞ্চের পায়া ভেঙে ব্যাট বানিয়ে ক্রিকেট খেলায় আমি বেশ পারঙ্গম ছিলুম । একবার স্যার চলে আসার পরেও আমি একমনে শ্যাডো করায় বেশ নাকাল হতে হয়েছিল । স্কুল বসার প্রথমার্ধে এসব হলেও টিফিনের পর আমরা পালানোর তালেই থাকতাম । সিক্সথ পিরিয়ডে হেড স্যার নিজেই আসতেন ক্লাস নিতে । আমাদের ঘরটা ছিল রাস্তার পাশেই, তাতে ছিল বিরাট বিরাট জানলা এবং গ্রীলহীন । আমাদের মধ্যে সবথেকে বেশী স্বার্থত্যাগ করতো অমিতাভ মাইতি । বিজ্ঞান বিভাগের অন্যতম সেরা এই ছাত্রটি বিরাট লম্বা ( ৬ ফুট ৩ ) হওয়ায় পালাতে সক্ষম হত না বলে ওকেই দায়িত্ব দেওয়া হত ম্যানেজমেন্টের । একটি সিরিয়াস ও কঠিন ক্যালকুলাস ওকে আগে থেকেই দেখে আসতে হত যাতে হেড স্যারকে ওই অংকের ফাঁদে ফেলা যায় । হতও তাই । সেই অংক নিয়ে স্যার এমনই ডুবতেন যে আমরা যে কখন জানলা গলে, পাঁচিল টপকে পালাচ্ছি - তা ধরতেও পারতেন না । ক্লাস থেকে বেরোনোর পর সবথেকে বড় ঝামেলা ছিল স্কুলের বাইরে যাওয়া । আমাদের দারোয়ান ছিল মঙ্গল'দা, ও কিছুতেই আমাদের বেরোতে দিত না । ফলে আমাদের পাঁচিল ডিঙোতে হত । খুবই উঁচু পাঁচিল বলে সাইকেল নিয়ে টপকানো কঠিন ছিল । তবে আমাদের স্যার মনোজবাবু ছিলেন খুবই মাইডিয়ার, তিনি আমাদের রাস্তার ঠিক কোন জায়গা দিলে নামলে সুবিধে হবে বলে দিতেন । আর সাইকেল পার করার দায়িত্ব নিত - বিপ্লব, সুপ্র, শম্ভু আর তারা । এভাবে একসময় পুরো ক্লাস ফাঁকা হয়ে যেত একদম শেষে স্যার পিছন ফিরে দেখতেন - বেবাক খালি সব আমরা ইস্কুল থেকে বেরিয়েই বাবানদের বাড়ি থেকে ব্যাট, বল নিয়ে চলে যেতাম আরও বেশ কিছুটা দূরে থানার পিছনের মাঠে । সেই মাঠের নাম ছিল 'নীচের মাঠ' । পাশেই চূর্ণী, নদীর ধারে আমাদের ক্রিকেট খেলার সেসব স্মৃতি কোনোদিন মুছে যাবে না । খেলা শেষে নদীতে হাত-পা ধুয়ে আমরা আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরতাম । পরে সেসব খেলা নিয়েও লিখবো ।
পরদিন স্কুলে গেলেই আমাদের চরম ধমক খেতে হত । হেড স্যারের হাত থেকে তখন নানা কথা বলে রেহাই পেতাম এবং পুনরায় একই কাজ করতাম । হেডস্যার আমাদের ওপর মারাত্মক রেগে নাম দিয়েছিলেন - কাঁকড়া বিছার দল । রাণাঘাটের ইতিহাসে আমাদের এই দল তাদের বন্ধুত্ব, প্রাণময়তা, দুষ্টুমি, সমমর্মিতা ও অধীত বিদ্যার পারদর্শিতার জন্য চিরকাল একটা বিশেষ জায়গায় থাকবে । এমন অসামান্য বন্ধুত্ব আজকের দিনে বিরলই নয় দুর্লভ ।
তোদের বন্ধু হতে পেরে আমি গর্বিত রে । কোনোদিন তোদের ভুলতে পারব না । শুধু আমাদের একজন আর ফিরে আসবে না কোনোদিন । সুপ্রতীপ - বছর বারো আগে ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে আমাদের এই প্রাণোচ্ছল বন্ধুটি চলে গেছে - আন ভুবনের পারে ।
কাঁকড়া বিছার দল থেকে একটি বিছে হারিয়ে গেছে । বড্ড মনে পড়ে তোকে ভাই, বড্ড মনে পড়ে । তবে চিন্তা নেই, অলকানন্দার তীরে আবার আমরা একদিন একসাথে হব, আবার চুটিয়ে ক্রিকেট খেলবো ! সে জগতে যে চিরবসন্ত রে । সেই পুরনো কিশোরবেলার পড়ন্ত বিকেলের মায়াবী আলোয় আবার তুই ডানদিকে ঝাঁপিয়ে ক্যাচ নিবি আর আমি চেঁচিয়ে বলে উঠবো - হ্যাউজ দ্যাট ।

No comments:

Post a Comment