24 Feb 2014

নষ্ট


সময়ের বিশ্রাম দরকার । একটু হলে-ও দরকার । ঘড়ির কাঁটা তিনটে একসাথে মোটা সুতো দিয়ে বেঁধে রাখা হোক । জীবনের সব জামাকাপড় এমনকি অন্তর্বাসসহ লুকিয়ে রাখা হোক । কিয়ৎকালের নগ্নতা-ই তার চলার পথ অবরোধ করবে । নিশ্চিত বাধা ।  

ঘরের কোণে রাখা ডাস্টবিন এখন সময়ের বিশ্রামঘর । সাময়িক । জীবনের সমস্ত জঞ্জাল , অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্তর , উপেক্ষিত মালগুলো বের করে সাফ করতে হবে ।  দু'তিন ফোঁটা vim দিয়ে ঘষে মেজে সময়োপযোগী করে তুলতে হবে ডাস্টবিনটাকে । সাথে একটু 

বের করে রাখা অব্যবহৃতগুলি একসাথে সাজিয়ে গুছিয়ে একটা ম্যাট্রিক্স বানাতে হবে । হেডিং-এ থাকবে ফেলা আসা সময়ের কোড , প্রতিটা কোডের আন্ডারে রাখা হবে সেই সব ডাস্টের নিজস্ব আইডেন্টিটি নাম্বার । সারিবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে । দেখতে নিশ্চয়-ই বিদঘুটে লাগবে । কিন্তু কিছু করার নেই ।

ডাস্টবিনের মুখে বিছানা বেঁধে হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম করবে সময় । আধশোয়া অবস্থায় । বিছানার তলা থেকে টপ টপ করে ক্লান্তির ফোঁটা পড়বে । যতক্ষণ বা যতদিন না পড়া থামে । 

তার চোখ থাকবে ওদিকে ম্যাট্রিক্সটার দিকে । অবাক হয়ে দেখবে । ভাববে কেন এতকিছু নষ্ট হয়ে গেলো বা করতে হলো ? 

সময় কি এতদিন ধরে নষ্ট হওয়ার জন্যে দৌড়য় ? শুধু শুধু ?

Elomelo #62


একটা পাতা শেষ করতে পারলাম না আজও
কাল আধপাতায় ঘুম

বাইরে পাতার পর পাতা
পড়ে ক্লান্ত হয়ে

মলাটে হেলান দিলে এক হয়
চোখের পাতা

Elomelo #61


এখুনি বের করো
চারটে মাত্র পেরেক
ঠুকে দাও

টাঙ্গিয়ে রাখো সোজা করে
যীশুখ্রীষ্টের মত

কে দেখবে? কে হাসবে?
কে বা পাবে কষ্ট ?
আর হ্যাঁ, সত্যিকারের কষ্ট যারা পায় সেই বাবা মা ও নেই।

চেয়ে দ্যাখো শুধু
ঢুলে পড়াটুকু

Elomelo #60


মানুষের ঘাড়ের উপরে বিষ(যুক্ত/মুক্ত) শ্বাস ফেলার আগে নিজের ঘাড় একটু চুলকে নিও।

তবে নখ যেন বিষাক্ত না হয় নাহলে ঘাড়মটকানো বিশ্বাসঘাতী এসে জুটবে

Elomelo #59


দুইয়ের পিঠে এক চাপিয়ে নিজের সাথে র-ফলায় বেঁধে ফেবু আড়ি পাতছে সকলের সাথে ।

.


পিতৃকুলে কেউ নেই তার যার ভাষা মায়ের আঁচলে চোখ মোছে


.


আমরা বাঙালী বাস করি 'এই দ্ব্যর্থবরদ বঙ্গে '


.


বাপ কা মাধ্যম বাংলা, বেটা কা মাধ্যম ইংরেজি । বাপকা বেটা বাংরেজি ।
অ্যাই, লুক অ্যাট দ্যাট বেজি


.


মা কালীর জিভ দেখে বাঙালীরা কপালে প্রণাম ঠোকে । শব্দবাজির কোনো মাতৃভাষা নেই । 


.


হ্যালো, মাই নেম ইজ আশুতোষ মুখুজ্যে । প্লীজ গেট মি আ রয়াল বাংলার বাঘ ।


.


আজ সকাল ১১টায় বিপিএস (বং পাবলিক স্কুল)-এ ভাষাদিবস উপলক্ষে পতাকা উত্তোলন করা হবে । সকলের উপস্থিতি একান্ত কাম্য ।

Elomelo #58


আমি মৃত
আমার ছেলের বাবা জীবিত

আমি মৃত
আমার স্ত্রীর স্বামী জীবিত

আমি মৃত
আমার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান জীবিত

এবং
এদের কাছে-ই
অমৃত আমি

Elomelo #57


আজকাল আমার কি হয়েছে জানি না । শুধু জানি রক্তের সারা গায়ে লেগেছে জামার দাগ

তেষ্টা



স্থির হয়ে আছে জলের ট্যাঙ্ক
কিছুটা
পুরোনো মনুমেন্টের মত

তার চোখ কিন্তু খুঁজছে
কিছু একটা

তার
পায়ের খুব কাছে ঘটে
কচি কচি খেলনার দুর্ঘটনা
হর্নের দৌরাত্ম্য একছুট দিয়েও
ধাক্কা খায় একতলায়
খোলা বারান্দার আধ ইঞ্চি নিচে

ঘন্টাখানেকের বিশ্রাম নেবে বলে
দেড়হাত দূরে তিন-চারটে বাড়ির ছাদ মিলে
গুছিয়ে রেখেছে রোদ
যে
পুড়িয়ে পুড়িয়ে এখন ক্লান্ত

রোদ-কে মাড়িয়ে
গাছের পাতায় পাতায় ভর করে
হেঁটে এসে ঢুকে পড়লো সে
জানালার ফাঁক গলে

আর খুঁজে পেলো
আমাকে

শাওয়ারের তলায় স্নানরত অবস্থায়
এতক্ষণে

পেনসিল


পেনসিলটা কোনোদিন নিজের পায়ের উপরে দাঁড়াতে পারবে না । কোনো অবলম্বন ছাড়া-ই । বুঝতে পারি । জানতাম ও বইকি ।

তাকে সবসময় হাতে ধরে থাকতে হয় । তবে শুধু বাথরুমে যাওয়ার সময় ও কোনো সাহায্য নেয় না । শুয়ে থাকে চুপটি করে । কখনো কখনো রবারকে বালিশের মত করে নেয় ।


কিন্তু পেনসিলের মুখখানি এত ভারী সুন্দর যে সাদা কাগজের জানালায় বসে থাকা মেয়েটির চোখে দোল খায় প্রেম । কালো প্রেম । অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে । তার সাথে চেষ্টা করে মেয়েটি অপরিণত ঠোঁটে হাসির একটু ছোঁয়া আনার । কিন্তু পারে না । কিছুতে-ই ।


পেনসিলের প্রতিবন্ধকতা-ই যেন মেয়েটিকে হাসতে বারণ করেছে । কিম্বা মেয়েটি তাকে কষ্ট দিতে চায় না । হয়তো ..

18 Feb 2014

অনির্বাণ-er jonmodin


পোলাপান পোলাপান
দেয় ভেঙে খান খান
দলে বলে হৃদের তলে
অই, ওহ ওহ ওহো নির্বাণ


প্রলাপের চোটে খোলে ট্রাপ
আলাপের ফাঁকে পায় পেচ্ছাপ
যখন তখন যা তা রকমের মাথা
ফট ফট ফাটে কবিতার খাপ


দাড়ির কোলে দুমদাম দমে হাসি
গোঁফের তালে দুত্তুমিত্তি ভাসি ভাসি
চোখের পেছনে কাঁদে বোলপুরের আয়না
সামনে চুমুনীতির পাল্লায় কলকাতাবাসী


সবের তালে তালে তোলে সবাই
দিদি দাদা বৌদি বোনের ভাই
নবারুণের সাথে বসে চায়ের আড্ডায়
সামনে ভাস্করদা , ঢেঁকুর তোলে 'অই'


আয় আয় বুকে আয় অনির্বাণ
চল চল যাই চলে আমরা দু'খান
শুনছিস ? ওরে পাত্তা দিস না কেন ?
পোলাপান পোলাপান, ও পোলাপান ?

17 Feb 2014

Elomelo #56


মাথা এইমাত্র
চার ভাগে ভাগ হয়ে গেল


প্রথমভাগটি মুটছে
ক্রমশ

দ্বিতীয়ভাগটি দাপাচ্ছে
তীব্র যন্ত্রণায়

তৃতীয়ভাগটি থেকে বেরোচ্ছে
পোড়া বারুদের গন্ধ

শেষভাগটি পেছনে ফিরে কষছে
তিনভাইয়ের সম্পত্তি

ঠিকানা


চোখের ঠিকানা
ততক্ষণে পাল্টে গেছে
ভুল আস্তে আস্তে ফুটছে
একটা নয় অসংখ্য

এখন
চোখের সামনে কাউকে
ফুল বললে
সে খুঁজবে বাগান
চোখের ভিতরে

আসলে
বোকাদের ভুল পাওয়া যায় না
থাকলেও খুব বিরল
খুবই

চোখ শুধু পাল্টে যাবে

15 Feb 2014

শব্দ


শব্দকল্পদ্রুম Vs. আমি

"ঠাস্‌ ঠাস্‌ দ্রুম দ্রাম,শুনে লাগে খটকা--
ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পট্‌কা!
শাঁই শাঁই পন্‌ পন্‌, ভয়ে কান বন্ধ--
ওই বুঝি ছুটে যায় সে-ফুলের গন্ধ?
হুড়মুড় ধুপধাপ--ওকি শুনি ভাইরে!
দেখ্‌ছনা হিম পড়ে-- যেও নাকো বাইরে।
চুপ চুপ ঐ শোন্‌! ঝুপ ঝাপ্‌ ঝপা-স!
চাঁদ বুঝি ডুবে গেল? গব্‌ গব্‌ গবা-স!
খ্যাঁশ্‌ খ্যাঁশ্‌ ঘ্যাঁচ্‌ ঘ্যাঁচ্‌ , রাত কাটে ঐরে!
দুড়দাড় চুরমার--ঘুম ভাঙে কই রে!
ঘর্ঘর ভন্‌ ভন্‌ ঘোরে কত চিন্তা!
কত মন নাচ শোন্‌--ধেই ধেই ধিন্‌তা!
ঠুংঠাং ঢংঢং, কত ব্যথা বাজেরে--
ফট্‌ ফট্‌ বুক ফাটে তাই মাঝে মাঝে রে!......." 

'শব্দকল্পদ্রুম'-এর লাইনগুলি যতবার পড়ি ততবার মুখ নিশ্ পিশ্ করে বিকৃত করি । রাগে সমস্ত শিরা-উপশিরা দপ্ দপ্ করে । এত 'আবোল-তাবোল' বকতে পারেন গোল গোল চশমাধারী লোকটা ? জানি আমার এই রাগটা হিং-টিং-ছট্ গোছের । কিন্তু ফুল ফোটা, চাঁদ ডোবা, রাত কাটা, ঘুম ভাঙা, চিন্তা ঘোরার মত দৈনন্দিন পার্থিব মুভমেন্ট কিংবা মন নেচে ওঠা , ব্যথা বেজে ওঠা , বুক ফেটে যাওয়ার মত মানসিক অন্তর্বাসের গোপনীয়তা - এইসব কি সত্যি সত্যি সশব্দে হয় ? আরে বাবা, আমি ভালো-ই জানি যে রায়বাবু রসিকতা করে বিশেষ বিশেষ ক্রিয়াপদের সাথে শব্দপদগুলি তুলনা করেছেন । বাট ওয়াই ? যেটা পার্থিবভাবে অপার্থিব বা যার মধ্যে বাস্তবিক-ই কোনো শব্দধ্বনি বাজে না সেটা নিয়ে এইরকম ছেলেখেলা করলে আমার মত যারা আছে তাদের কাছে এটা বেঠিক পথের ঠিকানা । বুঝতে পারো নি নিশ্চয়ই ?

আসল বক্তব্য হচ্ছে একজন বধির মানুষের কাছে 'শব্দ'-এর সঠিক ব্যবহারিক নির্দেশ । এখানে আমি একজন জন্মবধির হয়ে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠছি কিনা তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে 'শব্দ' নিয়ে আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিচালিত জীবনভর অভিজ্ঞতাভিত্তিক কিছু মন্তব্য । রায়বাবু জীবিতকালে কোনো বধির মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছেন কিনা আমার জানা নেই, পেলেও তার ছিটেফোঁটা পাই নি তাঁর কোনো লেখার মধ্যে যতটুকু পড়েছি । সবেতে তাঁর নিজস্ব কল্পনাশক্তি এবং সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ নিয়ে পরীক্ষামূলক লেখনী । অবশ্য-ই এর মধ্যে অসাধারণত্ব খুঁজে পেতে দেড় সেকেন্ড লাগবে না কারো । কিন্তু অন্তত আমি ? হয়ত পাই । ওনার শব্দবাঁধুনি নিয়ে ছড়া লেখার ক্ষমতা যে অপরিসীম এবং তৎকালীন সমসাময়িক কবি বা লেখকদের থেকে আলাদাভাবে যে একটা স্বতন্ত্রবিশেষ শিরোপা পেয়েছেন তা নিয়ে আমার সন্দেহের একটু-ও ফাঁকফোকর নেই । তবুও যথেষ্ট শ্রদ্ধেয় মনোভাব নিয়ে আমার একটা অতি সহজ সরল প্রশ্ন - উনি যদি 'নৈঃশব্দ্য' নিয়ে একটা জলজ্যান্ত গল্প বা ছড়া লিখতেন তাহলে কি খুব একটা জমতো ?

নাহ, জমতো না । কারণ শব্দের মধ্যে যে একটা নিঃশব্দের বীজ লুকিয়ে থাকে সেটা একমাত্র আমার মত যারা তারা উপযুক্ত জমিতে, হয়তো বা নিষিদ্ধ জমিতে রোপণ করতে সক্ষম হবে, তা বলা-ই বাহুল্য । এই নিঃশব্দের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে যে চারাগাছটি  বড় হতে থাকে আমাদের জীবনযাত্রার সাথে তাল রেখে , সেই চারাগাছের শব্দবহুল আবহাওয়াতে বেড়ে ওঠাটা কেমন যেন সবার দৃষ্টির অগোচরে পড়ে যায় । এইকথা ভাবলে-ই এখনো অফিসে কাজ করাকালীন বুক ফাটে আমার , অবশ্যই সশব্দে নয় । কালি-পটকার মত ফট্ ফট্ করে ফাটলে-ই তো আমার চাকরী সেই কবে হয়ে যেতো ঘচাং ফু । যাই হোক, এই বুকফাটার সাথে সাথে চোখের বাঁধ ভেঙে ( তাও ঝন্ ঝন্ করে নয়, নইলে চোখের বাঁধ সশব্দে ভাঙার সুবাদে বিশ্বরেকর্ডে আমার নামে নিশ্চিত বুকড্ ) ভিতরের সমস্ত কান্না বেরিয়ে আসে দুই গাল বেয়ে । শব্দহীন এক কষ্ট । নিঃশব্দের ব্যথা কোনো শব্দ বা সাউন্ড দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না । অবর্ণনীয় এই যন্ত্রণা আমার নিজের আকাশ বাতাস ধুলিকণার সাথে এক অদ্ভূত শান্ত সুতোয় সুন্দরভাবে বাঁধা । সেই সুতোর কাল্পনিক তারটি ধরে আলতো করে টান মারলে হয়তো শুধু তোমরা শুনতে পাবে একটা মিষ্টিসুর - রিং রিং রিং ।

শব্দের সাথে লুকোচুরি

যখন পূর্ণাঙ্গ ভ্রূণ ছিলাম আমি , তখনো অন্ধকার নোনা সমুদ্রগহ্বরে ভাসছিলাম । টের পেতাম বন্ধ গোলাকৃতি দেয়ালের সাথে মৃদু আদু ধাক্কা । দেখতে পেতাম জল আর জলের মধ্যে ভেসে থাকা কতকগুলো না-জানা জৈবিকবস্তু । জিভে এসে ঠেকতো নানা স্বাদ-বিস্বাদ । নাকভরে শুঁকতাম গন্ধময় জঠররাজ্য । কিন্তু স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞের বা গর্ভধারিণীর কারো গুরুগম্ভীর আলোচনা কানে এসে পৌঁছাতো না । কখনো-ই না । দেখতে দেখতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় এলো একসময় । কিন্তু আমি স্বীয় দোষগুনে চুপচাপ  ছিলাম ভিতরে । বাইরে বেরোনোর জন্যে দোনোমোনো করছিলাম কিন্তু অবাধ্য ডাক্তারবাবু আমার ঘাড় ধরে টেনে বের করে আনলো । বাধ্য হয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে দেখা দিলাম জন্মদাত্রীকে, জন্মদাত্রীর পরম পতিদেব এবং তাদের নিকটাত্মীয়দের সামনে । আমার তলপেটের তলায় কচি পাদুটির মাঝের ঝুলন্ত পুঁচকে জিনিসটার দিকে একবার না দুবার নির্দেশ করলো ধোপদুরস্ত ধড়াচুড়ো পরা হারামী ডাক্তারবাবু । কিন্তু দেখি সবার মুখে এক অনাবিল আনন্দের হাসি । শব্দহীন হাসি ।

প্রথম কালীপূজার আগে দেখে যেতাম আমার উপর আদরযত্নের বাহার । সাথে দেখতাম সবার ঠোঁটদুটি অনবরত নড়ে যাচ্ছে, চোখ নাচানাচি করে যাচ্ছে আমার দিকে তাকিয়ে । ঠোঁটনাড়া কবে যে থামবে সেটা ভেবে ভেবে ঘুমিয়ে পড়তাম মাঝে মাঝে । এইভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জীবনের সেই প্রথম কালীপূজার ভরদুপুরে । কখন যে ভাঙলো ঘুম জানি না কিন্তু দেখলাম আমায় ঘিরে চারজোড়া চোখ, সাথে উদ্বিগ্ন মুখের অস্বস্তিকর ভিড় । মাথাভর্তি কাঁচাপাকা চুলের যে লোকটি ছিলো আমার মাথার কাছে তাকে দেখলাম ঘন ঘন দুই হাত মিলে জোড়-বিজোড় করছে , একবার কানের দোরগোড়ায় এসে দুই আঙ্গুলের ডিগবাজির খেল দেখালো । আমি যেন অপরাধের মুখ করে ছিলাম আর চোখদুটি ঘোরাছিলাম দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে । আমার অপরাধ ওদের কাছে যেন অবাক বিস্ময়বস্তু ।

একদিন ঘুম ভেঙে দেখলাম আমার সামনে বসে আছে জন্মদাত্রী । তার পিপের মত ফুলে যাওয়া চোখদুটি থেকে জল গলগল করে বেরিয়ে পড়ছে । ঠোঁটদুটি কেঁপে কেঁপে উঠছিলো । তার পিঠে হাত রেখে বুলিয়েছিল তার পাশে বসে থাকা সুদর্শন পতিদেব । আমি আবার চোখবুজে ঘুমিয়ে পড়লাম । এতো কান্নার রোল বেজে উঠেছিলো চারপাশে তখন আর সেই শব্দসমুদ্রের বুকে আমি নির্বিকার ঘুমন্ত শিশু । নিঃশব্দপুরের বাসিন্দা এক দোষী রাজপুত্র । কিন্তু সেদিনে ঠিক কি হয়েছিলো অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম ।

জানতে পেরেছিলাম যে কোনো এক ই.এন.টি. স্পেশালিস্ট পরীক্ষা করে ঘোষণা করেছিলো - আমি বড় অপরাধী আর অপরাধ হলো শব্দকে খুন করেছিলাম সেই ভ্রূণ থাকাকালীন । এ যেন ভ্রুণহত্যার বদলে শব্দহত্যা । আমার ভ্রূণ তো তখন মেরে ফেললে ভালো হতো তাহলে পাহাড়প্রমাণ দোষের ভার এখনো যে বয়ে বেড়াচ্ছি সেটা অন্তত থাকতো না, কিন্তু শেষ অবধি তা হয় নি আর শেষে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে ছাড়লো ভদ্রলোকটি ।

কিন্তু আমি বলবো আমি কিছু করি নি । নির্দোষ আমি । এ অন্যায় কাজ করতে পারি না কখনো-ই ।  বরং আমার ব্যক্তিগত ধারণা - শব্দ স্বয়ং লুকোচুরি খেলাচ্ছলে আমাকে জব্দ করে পালিয়ে গেছে চিরকালের জন্যে, কিম্বা আমার অভিধানিক জীবন থেকে 'শব্দ' নামক যে সার্বজনীন প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত শব্দ, সেই শব্দটি কেউ এসে চুরি করে অন্তরালে লুকিয়ে রেখেছে অনন্তকালের জন্য । আমার সাথে শব্দের নিঃশব্দ নিষ্ঠুর লুকো-চুরি । এই চুরি হয়ে যাওয়া বা লুকিয়ে থাকা শব্দ কোনোদিন কি ফিরে আসবে আমার কাছে ? একদিন হয়তো দেখবো আমার মাথায় কে একজন চাঁটি মেরে দেবে আর চমকে ফিরে দেখবো পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সহাস্য শব্দ । সে আর সম্ভব নয় । এটি জীবনের প্রথম ও শেষ ধাপ্পা-না-দেওয়া ঠগবাজ । শব্দহীন চিরপ্রতারক ।  এক মারাত্মক ধাপ্পাবাজ । আমার সাথে এমন এক বিশ্বাসঘাতকতা করলো শব্দের লুকোচুরি সেটা একটু একটু করে উপলব্ধি করতে শুরু করি সেদিন থেকে ।

'মা' শব্দের মাধুর্য

বধিরতাজনিত কারণে বাইরের জগতের সাথে আমার যোগাযোগ কখনো শব্দনির্ভর হয়ে ওঠে নি । হওয়ার কথাও নয় । যোগাযোগ কেবল চারটি ইন্দ্রিযযোগে হয় যতটুকু সম্ভব আমার সীমিত ক্ষমতার মধ্যে । তার বাইরে না । মানুষের সংস্পর্শ বলতে আমি সবার আগে পেয়েছি আমার জন্মদাত্রীকে মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমে আর তার হাতে লালন-পালনে । সে মাঝে মাঝে আমার চোখে চোখ রেখে নিজের ঠোঁট নাড়িয়ে থাকতো আর আমার ঠোঁটে আঙ্গুল ছূঁয়ে মুখে হাসি আনতো । এতে তাকে ভারী সুন্দর দেখাতো নাহলে হয়তো আমি ঠোঁট ফাঁক করে খিল খিল করে হেসে উঠতাম না । এইভাবে দিনের পর দিন , মাসের পর মাস , বছরের পর বছর কাটতে থাকলো ।

কিন্তু তখনো জানতাম না শব্দজগতের প্রত্যেকটা জিনিসের একটা করে নিজস্ব নাম আছে যা শব্দ দিয়ে আমরা সাধারণ মানুষ চিনি বা জানি । এমনকি তখনো জানতাম না সামনের সুন্দরী মানুষটি আমার 'মা' বা জানা তো দূরের কথা , 'মা' বলে শব্দটার যে অস্তিত্ব আছে সেটা আমার ধারণায় ছিলো না । 

একদিন যখন আমার বয়স ৫ কি ৬ বছর তখন খেলাচ্ছলে মা তার বড় বড় চোখ ফেলে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো আর আমিও তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম চোখ বড় বড় করে । মা এবার তার ঠোঁটদুটি নাড়াতে শুরু করলো আস্তে আস্তে । আমি দেখলাম তার বন্ধ ঠোঁটদুটি বার বার ফাঁক করে কিছুক্ষণের জন্যে আবার চেপে ধরলো ঠোঁটদুটি পরস্পরের কাছে এনে । তা দেখাদেখি আমিও আপনা আপনি নিজের ঠোঁটদুটি ঠিক সেইভাবে নাড়িয়ে ফাঁক করতে শুরু করলাম আবার বন্ধ করলাম ।

এইভাবে কয়েকবার করার পরে দেখলাম মা হঠাৎ আমায় তার বুকে জড়িয়ে নিলো । আমি মায়ের বুকের গন্ধে বুঁদ হয়ে গেছিলাম এক অদ্ভূত ভালোলাগায় । সেদিন ছিলো আমার মুখ ফুটে বলা প্রথম একটা শব্দ এবং সশব্দে বলা 'মা' তাও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলা প্রথম 'মা' । জীবনের প্রথম মাধুর্যের স্পর্শ পাই 'মা' শব্দের মধ্যে কারণ যতবার মা বলি ততবার মা আমাকে জড়িয়ে ধরতো তার বুকে ।

বাকি শব্দগুলি শেখাও ছিলো সম্পূর্ণ 'মা'-নির্ভর । একেকটা শব্দ শিখতে লাগলাম মায়ের অপরিসীম ধৈর্যের সামনে আর জানতে পারলাম আমাদের চারপাশের জগতের পরিচিতি প্রাথমিক শব্দের ব্যবহারে । 

শব্দবিভ্রাটের চেনা অচেনা গণ্ডি 

একদিন অফিসমুখী গাড়ি ড্রাইভ করছিলাম । সায়েন্স সিটির কাছে ট্রাফিকজ্যামে কুড়িমিনিট যাবৎ আটকে ছিলাম আর অভ্যাসবশত আমার চোখ চলে গেছিলো ডানপাশের রাস্তা যার উপর দিয়ে গাড়িগুলো চলে উল্টোমুখে । হঠাৎ দেখলাম উল্টোমুখী রাস্তাটার ওইধারে একজনকে ঘিরে জনাকয়েক লোক দাঁড়িয়ে আছে আর লোকটি ইশারায় কথা বলার চেষ্টা করছিলো , ঘন ঘন মাথা নাড়ছিলো , সাথে হাতদুটি সমান তালে নাড়িয়ে যাচ্ছিলো । দেখে মনে হচ্ছিলো লোকটা রীতিমত অসহায় এবং ব্যক্তিটি একজন যে বধির ওনার এইরূপ আচরণ থেকে আমার অনুমান করতে একমিনিটও লাগে নি । ওনাকে ঘিরে ধরা দুই-তিনজনকে দেখলাম মাঝে মাঝে পেটে হাত রেখে হাসতে হাসতে এর ওর গায়ে পড়ছিলো ।
 
উল্লিখিত ঘটনাটির নিরিখে কেবল একটা কথা অন্তত আমার মনে খোঁচা মেরে দেয় - দুর্বোধ্য শব্দে কথা বলার চেষ্টা বা হাত নেড়ে কথা বলার মধ্যে যে একটা সূক্ষ্ম বিভাজনরেখা থাকে যা আমাদের মত বধিরদের আলাদা করে margin করে রাখে । এই marginalize করার ব্যাপারে আমার বিশেষ কিছু বলার নেই। আমার ৩১ বছরের এই জীবনে বেশ কয়েকবার marginalization এর লক্ষ্যবস্তু হয়ে এসেছি সেটা নিশ্চয় আলাদা করে বলার দরকার হবে না কারণ এটাই আজকের দুনিয়াতেও, আজকের যুগেও, আজকের প্রজন্মেও বহাল তবিয়তে চলছে ।


একটা ঘটনা বলি যেখানে আমার আর আমার স্কুলের খুব কাছের বন্ধুর মধ্যে নিম্নলিখিত কথোপকথন ছিল -

  বন্ধু - "এই সোম , কি রে ? কি খবর ?" (চোখ নাচিয়ে , ডান হাত উল্টে বার দুয়েক নাড়িয়ে )

  আমি - "ভালই আছি রে রাম (নাম পরিবর্তিত ) , তুই ?"

   বন্ধু - "বেশ আছি । আচ্ছা কাল তোর ছোটো পিসির সাথে দেখা হলো । .. দাঁড়া হিসি করে আসি , খুব পেয়েছে .." (তর্জনী তুলে আকাশের দিকে উঁচিয়ে 'কাল' বুঝিয়ে পিসি আর হিসি একসাথে এত দ্রুত গতিতে বলে ফেলেছিলো , শেষে কড়ে আঙুল তুললো )

  আমি (পুরো হতভম্ব হয়ে ) - "কি বললি পিসি হিসি করেছে ?" 

  বন্ধু (আমার শব্দের উচ্চারণ এমনিতে অত স্পষ্ট নয়, তাই সে কি বুঝলো কে জানে) মাথা কোনরকমে উপরে নিচে নাড়িয়ে হন হন করে হেঁটে চলে গেলো ।

  পাশের একজন বন্ধু আমাদের কথোপকথন ততক্ষণে সব শুনেছিলো কান পেতে আর ক্লাসের বাকি কয়েকজনকে ডেকে ঘোষণা করে দিলো - "সোমের পিসি হিসি করেছে ।" 

ব্যস্ শুরু হয়ে গেলো আমাকে নিয়ে চরম পর্যায়ের খিল্লি । পরে রাম ক্লাসে ঢুকে সব শুনে হেসে লুটোপুটি । তখনি ব্যাপারটা মিটমাট করিয়ে নেয় - পুরোটাই নাকি আমার শব্দ বোঝার সমস্যাজনিত কেলেঙ্কারি সেটা বলে ।

প্রসঙ্গতঃ ওই বন্ধুকে কোনো দোষ দেওয়া যায় না কারণ পেচ্ছাপ পেলে লোকে তার চারপাশটা বইয়ের মত উল্টে চাপা দিয়ে নিজেরটাকে ক্ষনিকের জন্যে উন্মুক্ত করে । এমনকি পার্কে বসে প্রেম করতে করতে একবার চমৎকার হিসি পেলে তো লোকে প্রেমের প-এর র-ফলা খুঁজে পায় না যা অতি জাগতিক । 

বাকি যারা খিল্লি করেছিল তাদের তো খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই, বসে বসে হাতের নখ খুঁটছিলো , খাতায় আঁকিবুঁকি আঁকছিলো । ভালো কিছু সিনেমা বা অ্যাকশন-থ্রিলার সিন না দেখলে ওদের সারাটা দিন যেন মাটি । যে কান পেতে সব শুনেছিলো তার সবাইকে খোঁচা মারার মারার বদঅভ্যাস ছিল এখন জানি না বদলে গেছে কিনা ।


গোটা ব্যাপারটার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলতে পারি যে আমরা মানুষ যতদিন না রেললাইন থেকে ট্রেন সরে যাওয়ার মত বা রাস্তায় চলা একটা মেয়ের শাড়ির আঁচল হঠাৎ বুক থেকে নেমে যাওয়ার মত আচমকা ঘটনা দেখছি বা খবর শুনছি ততদিন আমরা যেন নিজেদের খোলের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকি, আর যে মুহূর্তে অমুক ঘটবে সেই মুহূর্তে নিছক "শরীর আর মন চর্চা" করার জন্যে লেগে পড়ি । উপরন্তু লক্ষ্যবস্তু যদি প্রতি ২০-৫০ জনের থেকে সামান্য ( এমনকি অতি সামান্য ) আলাদা হয় তাহলে কে আর আটকাবে । এই "শরীর আর মন" চর্চার আরেক নাম marginalization যার মধ্যে কোনো sick-mindedness নেই , আছে শুধু সাময়িক আগুনের ফুলকি । এই মাপকাঠিতে বন্ধুত্বের কোনো সংজ্ঞা হয় না কারণ চর্চা থামলেই সবকিছু আবার আগের মত ।


কিন্তু বন্ধুমহলের বাইরে অচেনামহলে একই ঘটনা ঘটলে marginalization এর হৃদয়হীনতার দরজা খুলে যায় এবং নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা এবং শারীরিক নির্যাতন - একের পর এক প্রবিষ্ট হয় ।

  এই ক্ষেত্রে আমরা অনেকসময় ভাবি বা প্রশ্ন করি - এই marginalization এর নির্লজ্জ দিক থামাতে পারি কি ? 


তার আগে একটা ব্যাপার বলে রাখি সেটা হল আমরা নিজেরা যেমন marginalization এর শিকার হই, তেমন মেতে উঠি অন্য কারো হলে । সুতরাং এইরকম দুমুখো হয়ে আমরা যদি marginalization এর মুণ্ডুপাত করতে যাই সেটা আগাগোড়া বৃথা যাবে, আবার একটা মুণ্ডু কাটা পড়লেও নতুন আরেকটা মুণ্ডু গজিয়ে উঠবে, সেটা বলাই বাহুল্য । এটা চিরকাল চলবে । এমন কি আমরা কেউ marginalization-শূন্য দুনিয়া কল্পনা করি না , দুঃস্বপ্নেও না । কারণ marginalization একধরনের ছোয়াঁচে যা একতরফা কখনও হয় না । ঠিক একপ্রকার দেওয়া-নেওয়া । আমি করলে/হলে সেও করবে/হবে ।

আর হৃদয়হীনতার যে কথাটা আসছে সেটা marginalization এর অন্তিম পর্যায় । কয়েকমাস আগে আমরা জানলাম জনৈক ভদ্রলোক হুইলচেয়ারে বসে শব্দবাজি ফাটানোর প্রতিবাদ করতে গিয়েই নিজে শিকার হলেন । কি লাভ হল ? তাই আমার অন্তত মনে হয় নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা না করে চুপচাপ মুখ বুজে মেনে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ । শিকার হতে হতে শিকার করতে যাওয়ার একটা স্বাভাবিক রীতি চালু হয়ে আছে আমাদের সবার মধ্যে, এর কোনো হেরফের হবে না । এবং এটা বন্ধুদের মধ্যে করা/হওয়া সবচেয়ে নিরাপদ । 




প্রেমের শব্দহীন যাত্রা 

বইতে অনেক বড় ছোট লেখকের লেখা পড়ে জানতে পেরেছি যে প্রেমের কিছু কিছু শব্দ আছে । তবে সে শব্দ একমাত্রিক নয় । "খল খল করে হাসছে মেয়েটি" , "ফিক করে হেসে ফেললো অর্জুন" , "চিঠি পড়া শেষ করে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠে বিছানায় গড়াগড়ি খেলো সে" , "উঃ লাগছে । এই একটু আস্তে ... " , "আহা , বড় সুন্দর দেখতে লাগছে তোমায়", "ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আর বললো যে সে আর কোনোদিন... " ইত্যাদি ইত্যাদি বহুমাত্রিক শব্দ নিয়ে ন্যাকা প্রেমের অবাধ যাতায়াত দেখতে পাই আমাদের ভিতরে আর বাইরে । মাঝে মাঝে শব্দের 'শ'-এর মাথায় মাত্রা না থাকার মত হয়ে যায় মাতৃহীন প্রেম । তখন ন্যাকামিতে মোড়া নিজস্ব শব্দ বলে আর কিছু থাকে না প্রেমের , শুরু হয়ে যায় মা-কে হারানোর মত অসহায়তা, বিষাদমাখা বিষণ্নতা আর প্রায় পাগল-পাগল ছন্নছাড়া জীবনের নিঃশব্দ ছ্যাঁকা । সেইসময় শুরু হয়ে যায় এক অদ্ভূত মায়াজাল যা আপনাআপনি বুনতে থাকে কোনোরকম শব্দোচ্চারণ ছাড়া-ই । সেই নিরিখে দেখলে বস্তুতঃ বলা যেতে পারে প্রেমের একপিঠে যেমন আছে শব্দবহুল মাত্রা , অপরপিঠ দিয়ে তেমনি পোহানো হয় নিঃশব্দের শোকতাপে ।

কিন্তু আমার ব্যক্তিগত জীবনে যা প্রেম এসেছে বা আসে তার সবগুলো একমাত্রিক কিম্বা শূন্যমাত্রিক শব্দে হয়েছে বললে বুদ্ধিজীবীদের বিতর্কিত খোঁচা খাওয়ার ভয় অন্ততঃ থাকে না । নিঃশব্দের বাসিন্দা হয়ে আমার জীবনে আসা প্রেম আবার কী ধরনের হতে পারে তা নিয়ে বরং অনেকের অপার কৌতুহল থাকা-ই স্বাভাবিক । আমার বা আমার মত যারা আছে তাদের জীবনের খাতা খুঁজলে নিশ্চয়-ই খুঁজে পাওয়া যাবে কত না-জানা প্রেমকাহিনী । এটুকু-ই বলতে পারি যে পড়াশুনায় মেধাবী হওয়ার সুবাদে একাধিক প্রেমের প্রস্তাব এসেছে আমার ব্যক্তিগত জীবনে । কিন্তু প্রেমটা কেমন ছিল ? শব্দহীন না শব্দবহুল ? একমাত্রিক বা শূন্যমাত্রিক নাকি অন্য পাঁচটা স্বাভাবিক প্রেমের মত বহুমাত্রিক ? এইসব অবান্তর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বরং শুধু বলবো আমার জীবনের প্রথম ব্যর্থ প্রেম এবং তার সাথে জড়িত শব্দের অলংকারের কথা ।

তার আগে একটা কথা বলতে চাই প্রেম শুধু মানসিক নয় , শারীরিকভাবেও হয় । হতে পারে শারীরিক প্রেমের সেরকম শব্দ হয় না দু-একটা উঃ আঃ-ব্যঞ্জক শব্দ ছাড়া যেমন ঠোঁটে ঠোঁট রেখে গভীরচুম্বন এঁকে দেওয়া , গলায় কাঁধে বুকে নাক হালকা ঘষে ঘষে গরম গরম শ্বাস ফেলা , শরীরের বিভিন্ন গোপন অঙ্গে হাত রেখে উষ্ণ-নাতিশীতোষ্ণ প্রেম করার সময় কিসের আবার আওয়াজ করতে হয় তা আমার নিজের সত্যি কোনো ধারণা নেই বা জানার দরকার পড়েও নি কোনোদিন । এখানে সশব্দ প্রেমের চেয়ে শব্দহীন অথচ স্পর্শময় প্রেম অনেক বেশি তাৎপর্যবাহী । অন্ততঃ আমার কাছে ।

কিন্তু শরীরের আগে পড়ে মন যেটা না থাকলে প্রেমের ফুল ফোটে না । নাঃ রায়বাবুর ভাষায় ফট ফট শব্দে ফটাস করে নয় । এটি নিতান্ত ফালতু জিনিস নয় । এটা অত্যন্ত সিরিয়াস কেস । ফুল ফোটানোর জন্য লাগে নিয়মিত মনের পরোক্ষ চর্চা ।

যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকালীন একই ক্যাম্পাসে পড়া একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম একসময়ে, কিন্তু পাল্টাপ্রেম পাই নি মেয়েটির দিক থেকে । আমি একদিন একটা ছোটো কাগজে লিখেছিলাম মাত্র তিন লাইন -

'আমি তোমাকে ভালোবাসি ।

ইতি
সোম' 

পরদিন সেই মেয়েটির বাড়ির লেটারবক্সে ফেলে দিয়েছিলাম । আর দিনের পর দিন অপেক্ষা করে যাচ্ছিলাম কবে উত্তর আসবে সেই আশায় । কিন্তু সমস্ত আশা গুঁড়িযে দিলো স্বয়ং মেয়েটি । কিভাবে ? পাড়ার এক দিদির মাধ্যমে জানায় যে সে কিনা আমাকে দাদার মত দেখে । যাহ শালা ! নিঃশব্দ প্রেম নিবেদনের পরিবর্তে পেলাম 'দাদা'সুলভ প্রত্যাখ্যান । এই 'দাদা' নামক শব্দে আমার তখন ভীষণ আপত্তি ছিলো । রাগে দুঃখে ভেঙে পড়েছিলাম দাদাগিরির গুগলি খেয়ে । এমন সশব্দে কেঁদেছিলাম সেদিন বাথরুমে যে দেওয়ালে থাকা তিনটে টিকটিকি ঘাড় ঘুরিয়ে করুণ চোখে দেখছিলো আমাকে । ওরা আমার কান্নার শব্দের ঢেউয়ের ধাক্কায় হিমশিম খাচ্ছিলো আর আমি নিজেই নিজের কান্নার শব্দ শুনতে পাই না বলে যেন আরো সজোরে কাঁদতে থাকছিলাম । 

এইভাবে যে কতক্ষণ কান্নার শব্দের মধ্যে দিয়ে নিজের নৈঃশব্দ্য পাক খেয়ে খেয়ে উঠছিলো তা আমার জানা ছিলো না । কিন্তু সেদিন শুধু বুঝতে পারলাম জীবনের প্রথম প্রেমের ব্যর্থতা ।  সেই প্রেমে ছিলো না কোনো শব্দসুচক ঘাত-প্রতিঘাত । ছিলো একরাশ অভিমান । সাথে সাক্ষী ছিলো কেবল কান্নার শব্দ আর সেই শব্দে বিহ্বল টিকটিকির দল । যেন শব্দ করে করে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল বার বার, অথচ আমি কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না সান্ত্বনা । বলা ভালো যে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার সঠিক শব্দ আমার জানা ছিলো না । এইভাবে শুরু হয়েছিলো আমার নিঃশব্দ প্রেমের প্রথম যাত্রা । সফরসঙ্গী নিজের অশ্রুত কান্নার শব্দ । 

শব্দছকের সাদাকালো ঘুঁটি

চার্লি চ্যাপলিন অভিনীত জনপ্রিয় ট্রাম্পচরিত্র আমার অতিপ্রিয় । সবার যেমন হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায় , আমারও তাই হয় ওই সাদাকালো নির্বাক ছবির সিরিজ দেখতে দেখতে । অমন একজন যদি কোনোরকম শব্দসৃষ্টি ছাড়া নিঃশব্দে হাসিবৃষ্টি ছড়াতে ওস্তাদ হয় , তার মত ভবঘুরে হয়ে সবার হৃদমাঝারে মণিমানিক্য হয়ে থাকার স্বপ্ন দেখা আমার পক্ষে অস্বাভাবিক ছিলো না । কিন্তু আমি বা অন্যকেউ তার জায়গা কেড়ে নিতে পারবে না বাস্তবে । এমনকি আমি সাইলেন্স-এর লাইসেন্সধারী হলেও সম্ভব নয় । তবুও মাঝে সাঝে আমি সেজে থাকি কথা-না-বলা একটা পুতুল । নিজের অজান্তে । বুঝতে পারি না আমি নিজে-ই একটা জলজ্যান্ত কেতাদুরস্ত পুতুল যে মুখে সবসময় হাসির দ্যুতি ছড়ায় সময়ে-অসময়ে-দুঃসময়ে , চোখের মণি ঘোরায় চরকির মত , মাথামুণ্ডু-বোঝে-না এমন মুণ্ডু নাড়ায় যখন তখন । শুধু বুঝতে পারি সবার হাসির পাত্র হয়ে যাই । এতে আমার মন সাদা আর কালো দুই খণ্ডে খণ্ডিত হয়ে থাকে দিনের শেষে ।

সাদা পর্দা সরিয়ে দেখতে পাই চোখের সামনে ধূ ধু কালো বালি । কখনো বা কালো চাদরের আড়ালে লুকিয়ে থাকে আমার সাদা কঙ্কাল । হয়তো জীবনের সাদা পাতলা ঠোঁটে অচেনা কেউ এসে এঁকে দিয়ে যায় মনখারাপের কালো রঙ । সময়ের কালচে নদী বয়ে নিয়ে যায় পুরোনো সাদাটে অ্যালবাম । তার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেয় ছেঁড়া কাঁটা সাদাকালো অভিমানী স্টিকার । স্টিকারে আমার দ্বিমাত্রিক নির্বাক সাদাকালো ছবি অথচ এই ছবি কিছু একটা বলতে চায় । একটা না অসংখ্য অক্ষরপোকা কিলবিল করতে চায় একটা খোলসের মধ্যে যা একটা বিস্ফোরক । একদিন না একদিন ফেটে যাবে দারুণ দারুণ একটা শব্দে । সজোরে ফাটবে । ফেটে চুরমার হয়ে যাবে আমার ভিতরখানি । ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে কতকগুলো টুকরো । প্রতিটা টুকরো আমার বলা শব্দটুকরো ।  

স্কুলের ক্লাসে কালো ব্ল্যাকবোর্ডে সাদা চক দিয়ে যেসব লেখা হয় সেগুলো দিয়ে আমার পড়া তৈরী হয় । স্কুলটিচারের মুখে আওড়ানো সব শব্দ আমার বধির কানের পর্দায় ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতো । খাতায় লিখে রাখতাম বোর্ডের গায়ে লেখা সীমিত শব্দগুলো আর চোখ মাঝে মাঝে বোর্ড থেকে সরে গিয়ে পড়তো দূরের পৃথিবীতে । আমার খাতায় লেখা শব্দগুলি যেন জীবন্ত হয়ে উঠতো , অবাক হয়ে দেখতাম শব্দরা সারি বেঁধে পায়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতো । ঠিক যেন সৈনিকের মত । একেকরূপ একেকজনের । খাতা থেকে বেঞ্চিতে , বেঞ্চি থেকে বেঞ্চির পা বেয়ে মেঝেতে , মেঝের উপর দিয়ে হেঁটে দেওয়ালের পা , পায়ে উঠে দেওয়ালের গা বেয়ে জানালার কোলে উঠে পড়তো । শব্দসৈনিকের যে সারি কোলে প্রথম পড়তো সেই সারির মুখগুলো একেক করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতো আমাকে আর হাত তুলে নাড়াতো । তারপর লাফ মেরে অদৃশ্য হয়ে যেতো এইভাবে একটার পর একটা শব্দের মালা । দূরের সেই পৃথিবীতে হয়তো এরা বিচরণ করে এই ভাবতে ভাবতে কখন আনমনা হয়ে যেতাম শেষে আমার কানের লতিতে পড়তো একটা রামটোকা । সম্বিৎ ফিরে ঘুরে দেখতাম রক্তবর্ণ চোখ পাকিয়ে স্কুলটিচারের ঠোঁটদুটি ক্রমাগত নাড়িয়ে যেতো । সাথে থু থু ছিটকে বেরিয়ে আমার মুখে গালে কপালে পড়তো । অনেক সহ্য করে তার দিকে তাকিয়ে হজম করতাম ওই অসহ্য ঠোঁটনাড়া । তার বকুনির কিছু বোধগম্য-ই হতো না আমার , শুধু বুঝতে পারতাম আমার ওই দূরের পৃথিবী আসলে সাদাকালো-ই । 

শব্দছক নামে ধাঁধালো এই নিঃশব্দ জীবনে দাঁড়িয়ে আমি চোখের সামনে যা দেখি , যা অনুভব করি , যা শুঁকি , যা জিভে এসে ঠেকে - তার সবগুলো নিজেদের মধ্যে দাবার সাদা-কালো ঘুঁটি সাজিয়ে রাখে আর নিজ নিজ গুণে যুদ্ধ করতো । কেউ হারতো না , কেউ কাউকে হারাতো না । এক অবিরত যুদ্ধ । যা আমাকে নিয়ে যায় এক অজানা গন্তব্যে যেখানে হয়তো শুনতে পাবো FM Radio-তে বেজে ওঠা প্রিয় গানটির সুর । 

কিন্তু , জানি না গানটি কি ?

13 Feb 2014

বক্তব্য #3


Sumantra Maiti আর আকাশের কথোপকথন পড়ে আমার একটা-ই কথা মনে পড়ে গেছিলো যেটা অবশ্য-ই আমার ব্যক্তিগত জীবনে হয়েছিলো ।

এখানে বলে রাখি আমি একজন জন্মবধির , তাই স্বাভাবিকভাবে আমার উচ্চারণ (Articulation) অশিক্ষিত লোকের মত শোনায়, তবুও চেষ্টা করি টু সাম এক্সটেন্ট যাতে যার সাথে সামনাসামনি (ফেবু বা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক - এর বাইরে) কথা বলি সে কিছুটা হলেও বুঝতে পারে ।

আমি যখন 'পাখি' বলি আর একজন শ্রোতার কানে সেটা 'প্যাকি' শোনায় , তাহলে কি সেই শ্রোতা আমাকে থামিয়ে বলবে -
" 'প্যাকি' আবার কি ওটা তো 'পাখি' হবে ? " - আসলে শ্রোতা বুঝতে পারছে যে আমি স্পষ্টতঃ পাখির কথা বলছি আর শ্রোতা শুধু উচ্চারণ নিয়ে খোঁচা মারলো । এটা তো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং অনর্থক তর্কবিতর্কের সূত্রপাত ছাড়া-ই আর কিছু নয় ।

আর এই ক্ষেত্রে আমি বলি - 'Articulation'-এর উপরে কোনো বিধিসম্মত বা যুক্তিসম্মত নিয়ম নেই যে প্রত্যেকের স্পিচ একদম একরকম-ই শোনাবে । এমনকি সুমন্ত্র আর আকাশের একই শব্দের (বিশেষ কিছু শব্দ) উচ্চারণ পুরোপুরি একই না হওয়া স্বাভাবিক যদি মুখোমুখি বলে (না লিখে), সে ব্যাপারে আমি পুরো নিশ্চিত । মানুষের নিজস্ব যে স্টাইল বা উচ্চারণভিত্তিক শব্দের উপরে মুখের ভিতরের অংশগুলির (কন্ঠ, তালু, মূর্ধা , দন্ত আর ওষ্ঠ) সাথে জিভের সংযোগস্থাপনের যে কন্ট্রোল আছে সেটা-ই তো যুক্তির বাইরে । সর্বোপরি মানুষের গলা দিয়ে মানুষকে চেনা যায় , তাই না ?

তবে হয়তো এখানে প্রশ্ন উঠবে এটার সাথে লেখার সময়ে বানানগত পরিবর্তনের কি সম্পর্ক ?

আছে নিশ্চয়-ই । গলার স্বর যদি মানুষভেদে ভিন্ন ভিন্ন এবং সেটা মানুষের পরিচিতির একটা ইউনিক পিস হয় তাহলে লেখার ক্ষেত্রে তাই সমানভাবে প্রযোজ্য । কেউ যদি ইংরাজি শব্দ 'মেসেজ'-টা 'ম্যাসেজ' বলে চালাতে চায় তাতে অসুবিধা কোথায় যদি আমরা শব্দটার আগে-পরে কথাগুলোর রেশ ধরে একটা সামগ্রিক অর্থ ধরতে পারি ?

খালি শব্দের উচ্চারণের পরিবর্তন দিয়ে লেখাটার বা লেখকের প্রতি কটাক্ষ করার কোনো কারণ দেখি না আমি । তবে বাংলা শব্দের বানান যদি খোদ বাংলার মুখে কালি মেখে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে কেউ যেমন 'স্বপ্ন' কে 'শপনো' বলে চালায় অবশ্যই এটা নিয়ে যুক্তিবিবাদ চলা-ই অতিপ্রাসঙ্গিক , যা ইংরাজি শব্দের ক্ষেত্রে কখনো-ই না যেহেতু এটা নিজ নিজ স্টাইলের (Articulation) প্রোডাক্টমাত্র । (ব্যক্তিগত মত)

11 Feb 2014

# ব্যাঘ্রাচার্য্য বৃহল্লাঙ্গুলের ভাষণ


একদা সুন্দরবন-মধ্যে ব্যাঘ্রদিগের মহাসভা সমবেত হইয়াছিল। নিবিড় বনমধ্যে প্রশস্ত ভূমিখণ্ডে ভীমাকৃতি বহুতর ব্যাঘ্র লাঙ্গুলে ভর করিয়া, দংষ্ট্রাপ্রভায় অরণ্যপ্রদেশ আলোকময় করিয়া, সারি সারি উপবেশন করিয়াছিল। সকলে একমত হইয়া অমিতোদর নামে এক অতি প্রাচীন ব্যাঘ্রকে সভাপতি করিলেন। অমিতোদর মহাশয় লাঙ্গুলাসন গ্রহণপূর্ব্বক সভার কার্য্য আরম্ভ করিলেন। তিনি সভ্যদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন;- “অদ্য আমাদিগের কি শুভ দিন! অদ্য আমরা যত অরণ্যবাসী মাংসাভিলাষী ব্যাঘ্রকুলতিলক সকল পরস্পরের মঙ্গল সাধনার্থ এই অরণ্যমধ্যে একত্রিত হইয়াছি। আহা! কুৎসাকারী, খলস্বভাব অন্যান্য পশুবর্গে রটনা করিয়া থাকে যে, আমরা বড় অসামাজিক, একা এক বনেই বাস করিতে ভালবাসি, আমাদের মধ্যে ঐক্য নাই। কিন্তু অদ্য আমরা সমস্ত সুসভ্য ব্যাঘ্রমণ্ডলী একত্রিত হইয়া সেই অমূলক নিন্দাবাদের নিরাস করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি! এক্ষণে সভ্যতার যেরূপ দিন দিন শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে, তাহাতে আমার সম্পূর্ণ আশা আছে যে, শীঘ্রই ব্যাঘ্রেরা সভ্যজাতির অগ্রগণ্য হইয়া উঠিবে। এক্ষণে বিধাতার নিকট প্রার্থনা করি যে, আপনারা দিন দিন এইরূপ জাতিহিতৈষিতা প্রকাশপূর্ব্বক পরম সুখে নানাবিধ পশুহনন করিতে থাকুন |” (সভামধ্যে লাঙ্গুল চট্‌চটারব।) “এক্ষণে হে ভ্রাতৃবৃন্দ! আমরা যে প্রয়োজন সম্পাদনার্থ সমবেত হইয়াছি, তাহা সংক্ষেপে বিবৃত করি। আপনারা সকলেই অবগত আছেন যে, এই সুন্দরবনের ব্যাঘ্রসমাজে বিদ্যার চর্চ্চা ক্রমে লোপ পাইতেছে। আমাদিগের বিশেষ অভিলাষ হইয়াছে, আমরা বিদ্বান্ হইব। কেন না, আজিকালি সকলেই বিদ্বান্ হইতেছে। আমরাও হইব। বিদ্যার আলোচনার জন্য এই ব্যাঘ্রসমাজ সংস্থাপিত হইয়াছে। এক্ষণে আমার বক্তব্য এই যে, আপনারা ইহার অনুমোদন করুন |” সভাপতির এই বক্তৃতা সমাপ্ত হইলে, সভ্যগণ হাউমাউ শব্দে এই প্রস্তাবের অনুমোদন করিলেন। তখন যথারীতি কয়েকটি প্রস্তাব পঠিত এবং অনুমোদিত হইয়া সভ্যগণ কর্ত্তৃক গৃহীত হইল। প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ বক্তৃতা হইল। সে সকল ব্যাকরণশুদ্ধ এবং অলঙ্কারবিশিষ্ট বটে, তাহাতে শব্দবিন্যাসের ছটা বড় ভয়ঙ্কর; বক্তৃতার চোটে সুন্দরবন কাঁপিয়া গেল। পরে সভার অন্যান্য কার্য্য হইলে, সভাপতি বলিলেন, “আপনারা জানেন যে, এই সুন্দরবনে বৃহল্লাঙ্গুল নামে এক অতি পণ্ডিত ব্যাঘ্র বাস করেন। অদ্য রাত্রে তিনি আমাদিগের অনুরোধে মনুষ্য চরিত্র সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পাঠ করিতে স্বীকার করিয়াছেন |” মনুষ্যের নাম শুনিয়া কোন কোন নবীন সভ্য ক্ষুধা বোধ করিলেন। কিন্তু তৎকালে পব্লিক ডিনারের সূচনা না দেখিয়া নীরব হইয়া রহিলেন। ব্যাঘ্রাচার্য্যবৃহল্লাঙ্গুল মহাশয় সভাপতি কর্ত্তৃক আহূত হইয়া গর্জ্জনপূর্ব্বক গাত্রোত্থান করিলেন। এবং পথিকের ভীতিবিধায়ক স্বরে নিম্নলিখিত প্রবন্ধটি পাঠ করিলেন;- “সভাপতি মহাশয়! বাঘিনীগণ এবং ভদ্র ব্যাঘ্রগণ! মনুষ্য একপ্রকার দ্বিপদ জন্তু। তাহারা পক্ষবিশিষ্ট নহে, সুতরাং তাহাদিগকে পাখী বলা যায় না। বরং চতুষ্পদগণের সঙ্গে তাহাদিগের সাদৃশ্য আছে। চতুষ্পদগণের যে যে অঙ্গ, যে যে অস্থি আছে, মনুষ্যেরও সেইরূপ আছে। অতএব মনুষ্যদিগকে এক প্রকার চতুষ্পদ বলা যায়। প্রভেদ এই যে, চতুষ্পদের যেরূপ গঠনের পারিপাট্য, মনুষ্যের তাদৃশ নাই। কেবল ঈদৃশ প্রভেদের জন্য আমাদিগের কর্ত্তৃব্য নহে যে, আমরা মনুষ্যকে দ্বিপদ বলিয়া ঘৃণা করি। চতুষ্পদমধ্যে বানরদিগের সঙ্গে মনুষ্যগণের বিশেষ সাদৃশ্য। পণ্ডিতেরা বলেন যে, কালক্রমে পশুদিগের অবয়বের উৎকর্ষ জন্মিতে থাকে; অবয়বের পশু ক্রমে অন্য উৎকৃষ্টতর পশুর আকার প্রাপ্ত হয়। আমাদিগের ভরসা আছে যে, মনুষ্য-পশুও কালপ্রভাবে লাঙ্গুলাদিবিশিষ্ট হইয়া ক্রমে বানর হইয়া উঠিবে। মনুষ্য-পশু যে অত্যন্ত সুস্বাদু এবং সুভক্ষ্য, তাহা আপনারা বোধ হয়, সকলেই অবগত আছেন। (শুনিয়া সভ্যগণ সকলে আপন আপন মুখ চাটিলেন)। তাহারা সচরাচর অনায়াসেই মারা পড়ে। মৃগাদির ন্যায় তাহারা দ্রুত পলায়নে সক্ষম নহে, অথচ মহিষাদির ন্যায় বলবান্ বা শৃঙ্গাদি আয়ুধ-যুক্ত নহে। জগদীশ্বর এই জগৎ-সংসার ব্যাঘ্রজাতির সুখের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন, সন্দেহ নাই। সেই জন্য ব্যাঘ্রের উপাদেয় ভোজ্য পশুকে পলায়নের বা আত্মরক্ষার ক্ষমতা পর্য্যন্ত দেন নাই। বাস্তবিক মনুষ্যজাতি যেরূপ অরক্ষিত-নখ-দন্ত শৃঙ্গাদি বর্জ্জিত, গমনে মন্থর এবং কোমলপ্রকৃতি, তাহা দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয় যে, কি জন্য ঈশ্বর ইহাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন। ব্যাঘ্রজাতির সেবা ভিন্ন ইহাদিগের জীবনের আর কোন উদ্দেশ্য দেখা যায় না। এই সকল কারণে, বিশেষ তাহাদিগের মাংসের কোমলতা হেতু, আমরা মনুষ্য জাতিকে বড় ভালবাসি। দৃষ্টি মাত্রেই ধরিয়া খাই। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তাহারাও বড় ব্যাঘ্রভক্ত। এই কথায় যদি আপনারা বিশ্বাস না করেন, তবে তাহার উদাহরণ স্বরূপ আমার যাহা ঘটিয়াছিল, তদ্বৃত্তান্ত বলি। আপনারা অবগত আছেন, আমি বহুকালাবধি দেশ ভ্রমণ করিয়া বহুদর্শী হইয়াছি। আমি যে দেশে প্রবাসে ছিলাম, সে দেশ এই ব্যাঘ্রভূমি সুন্দরবনের উত্তরে আছে। তথায় গো মনুষ্যাদি ক্ষুদ্রাশয় অহিংস্র পশুগণই বাস করে। তথাকার মনুষ্য দ্বিবিধ; এক জাতি কৃষ্ণবর্ণ, এক জাতি শ্বেতবর্ণ। একদা আমি সেই দেশে বিষয়কর্ম্মোপলক্ষে গমন করিয়াছিলাম।” শুনিয়া মহাদংষ্ট্রানামে একজন উদ্ধতস্বভাব ব্যাঘ্র জিজ্ঞাসা করিলেন,- “বিষয়কর্ম্মটা কি?” বৃহল্লাঙ্গুল মহাশয় কহিলেন, “বিষয়কর্ম্ম, আহারান্বেষণ। এখন সভ্যলোকে আহারান্বেষণকে বিষয়কর্ম্ম বলে। ফলে সকলেই যে আহারান্বেষণকে বিষয়কর্ম্ম বলে, এমত নহে। সম্ভ্রান্ত লোকের আহারান্বেষণের নাম বিষয়কর্ম্ম, অসম্ভ্রান্তের আহারান্বেষণের নাম জুয়াচুরি, উঞ্ছবৃত্তি এবং ভিক্ষা। ধূর্ত্তের আহারান্বেষণের নাম চুরি; বলবানের আহারান্বেষণ দস্যুতা; লোকবিশেষে দস্যুতা শব্দ ব্যবহার হয় না; তৎপরিবর্ত্তে বীরত্ব বলিতে হয়। যে দস্যুর দণ্ডপ্রণেতা আছে, সেই দস্যুর কার্য্যের নাম দস্যুতা; যে দস্যুর দণ্ডপ্রণেতা নাই, তাহার দস্যুতার নাম বীরত্ব। আপনারা যখন সভ্যসমাজে অধিষ্ঠিত হইবেন, তখন এই সকল নামবৈচিত্র্য স্মরণ রাখিবেন, নচেৎ লোকে অসভ্য বলিবে। বস্তুতঃ আমার বিবেচনায় এত বৈচিত্র্যের প্রয়োজন নাই; এক উদর-পূজা নাম রাখিলেই বীরত্বাদি সকল বুঝাইতে পারে। সে যাহাই হউক, যাহা বলিতেছিলাম, শ্রবণ করুন। মনুষ্যেরা বড় ব্যাঘ্রভক্ত। আমি একদা মনুষ্যবসতি মধ্যে বিষয়কর্ম্মোপলক্ষে গিয়াছিলাম। শুনিয়াছেন, কয়েক বৎসর হইল, এই সুন্দরবনে পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি স্থাপিত হইয়াছিল |” মহাদংষ্ট্রা পুনরায় বক্তৃতা বন্ধ করাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি কিরূপ জন্তু?” বৃহল্লাঙ্গুল কহিলেন, “তাহা আমি সবিশেষ অবগত নহি। ঐ জন্তুর আকার, হস্তপদাদি কিরূপ, জিঘাংসাই বা কেমন ছিল, ঐ সকল আমরা অবগত নহি। শুনিয়াছি, ঐ জন্তুর মনুষ্যের প্রতিষ্ঠিত; মনুষ্যদিগেরই হৃদয়-শোণিত পান করিত; এবং তাহাতে বড় মোটা হইয়া মরিয়া গিয়াছে। মনুষ্যজাতি অত্যন্ত অপরিণামদর্শী। আপন আপন বধোপায় সর্ব্বদা আপনারাই সৃজন করিয়া থাকে। মনুষ্যেরা যে সকল অস্ত্রাদি ব্যবহার করিয়া থাকে, সেই সকল অস্ত্রই এ কথার প্রমাণ। মনুষ্যবধই ঐ সকল অস্ত্রের উদ্দেশ্য। শুনিয়াছি, কখন কখন সহস্র সহস্র মনুষ্য প্রান্তরমধ্যে সমবেত হইয়া ঐ সকল অস্ত্রাদির দ্বারা পরস্পর প্রহার করিয়া বধ করে। আমার বোধ হয়, মনুষ্যগণ পরস্পরের বিনাশার্থ এই পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি নামক রাক্ষসের সৃজন করিয়াছিল। সে যাহাই হউক, আপনারা স্থির হইয়া এই মনুষ্য-বৃত্তান্ত শ্রবণ করুন। মধ্যে মধ্যে রসভঙ্গ করিয়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে বক্তৃতা হয় না। সভ্যজাতিদিগের এরূপ নিয়ম নহে। আমরা এক্ষণে সভ্য হইয়াছি, সকল কাজে সভ্যদিগের নিয়মানুসারে চলা ভাল। আমি একদা সেই পোর্ট ক্যানিং কোম্পানির বাসস্থান মাতলায় বিষয়কর্ম্মোপলক্ষে গিয়াছিলাম। তথায় এক বংশমণ্ডপ-মধ্যে একটা কোমল মাংসযুক্ত নৃত্যশীল ছাগবৎস দৃষ্টি করিয়া তদাস্বাদনার্থ মণ্ডপ-মধ্যে প্রবিষ্ট হইলাম। ঐ মণ্ডপ ভৌতিক-পশ্চাৎ জানিয়াছি, মনুষ্যেরা উহাকে ফাঁদ বলে। আমার প্রবেশ মাত্র আপনা হইতে তাহার দ্বার রুদ্ধ হইল। কতকগুলি মনুষ্য তৎপরে সেইখানে উপস্থিত হইল। তাহারা আমার দর্শন পাইয়া পরমানন্দিত হইল, এবং আহ্লাদসূচক চীৎকার, হাস্য, পরিহাসাদি করিতে লাগিল। তাহারা যে আমার ভূয়সী প্রশংসা করিতেছিল, তাহা আমি বুঝিতে পারিয়াছিলাম। কেহ আমার আকারের প্রশংসা করিতেছিল, কেহ আমার দন্তের, কেহ নখের, কেহ লাঙ্গুলের গুণগান করিতে লাগিল। এবং অনেকে আমার উপর প্রীত হইয়া, পত্নীর সহোদরকে যে সম্বোধন করে, আমাকে সেই প্রিয়সম্বোধন করিল। পরে তাহারা ভক্তিভাবে আমাকে মণ্ডপ সমেত স্কন্ধে বহন করিয়া, এক শকটের উপর উঠাইল। দুই অমলশ্বেতকান্তি বলদ ঐ শকট বহন করিতেছিল। তাহাদিগকে দেখিয়া আমার বড় ক্ষুধার উদ্রেক হইল। কিন্তু তৎকালে ভৌতিক মণ্ডপ হইতে বাহির হইবার উপায় ছিল না, এ জন্য অর্দ্ধভুক্ত ছাগে তাহা পরিতৃপ্ত করিলাম। আমি সুখে শকটারোহণ করিয়া ছাগমাংস ভক্ষণ করিতে করিতে এক নগরবাসী শ্বেতবর্ণ মনুষ্যের আবাসে উপস্থিত হইলাম। সে আমার সম্মানার্থ স্বয়ং দ্বারদেশে আসিয়া আমার অভ্যর্থনা করিল। এবং লৌহদণ্ডাদিভূষিত এক সুরম্য গৃহমধ্যে আমার আবাসস্থান নির্দ্দেশ করিয়া দিল। তথায় সজীব বা সদ্য হত ছাগ মেষ গবাদির উপাদেয় মাংস শোণিতের দ্বারা আমার সেবা করিত। অন্যান্য দেশবিদেশীয় বহুতর মনুষ্য আমাকে দর্শন করিতে আসিত, আমিও বুঝিতে পারিতাম যে, উহারা আমাকে দেখিয়া চরিতার্থ হইত। আমি বহুকাল ঐ লৌহজালাবৃত প্রকোষ্ঠে বাস করিলাম। ইচ্ছা ছিল না যে, সে সুখ ত্যাগ করিয়া আর ফিরিয়া আসি। কিন্তু স্বদেশ-বাৎসল্য প্রযুক্ত থাকিতে পারিলাম না। আহা! যখন এই জন্মভূমি আমার মনে পড়িত, তখন আমি হাউ হাউ করিয়া ডাকিতে থাকিতাম। হে মাতঃ সুন্দরবন! আমি কি তোমাকে কখন ভুলিতে পারিব? আহা! তোমাকে যখন মনে পড়িত, তখন আমি ছাগমাংস ত্যাগ করিতাম, মেষমাংস ত্যাগ করিতাম! (অর্থাৎ অস্থি এবং চর্ম্ম মাত্র ত্যাগ করিতাম)-এবং সর্ব্বদা, লাঙ্গুলাঘাতের দ্বারা আপনার অন্তঃকরণের চিন্তা লোককে জানাইতাম। হে জন্মভূমি! যতদিন আমি তোমাকে দেখি নাই, ততদিন ক্ষুধা না পাইলে খাই নাই, নিদ্রা না আসিলে নিদ্রা যাই নাই। দুঃখের অধিক পরিচয় আর কি দিব, পেটে যাহা ধরিত, তাহাই খাইতাম, তাহার উপর আর দুই চারি সের মাত্র মাংস খাইতাম। আর খাইতাম না |” তখন বৃহল্লাঙ্গুল মহাশয়, জন্মভূমির প্রেমে অভিভূত হইয়া অনেকক্ষণ নীরব হইয়া রহিলেন। বোধ হইল, তিনি অশ্রুপাত করিতেছিলেন, এবং দুই এক বিন্দু স্বচ্ছ ধারা পতনের চিহ্ন ভূতলে দেখা গিয়াছিল। কিন্তু কতিপয় যুবা ব্যাঘ্র তর্ক করেন যে, সে বৃহল্লাঙ্গুলের অশ্রুপতনের চিহ্ন নহে। মনুষ্যালয়ের প্রচুর আহারের কথা স্মরণ হইয়া সেই ব্যাঘ্রের মুখের লাল পড়িয়াছিল। লেক্‌চরর তখন ধৈর্য্য প্রাপ্ত হইয়া পুনরপি বলিতে আরম্ভ করিলেন, “কি প্রকারে আমি সেই স্থান ত্যাগ করিলাম, তাহা বলিবার প্রয়োজন নাই। আমার অভিপ্রায় বুঝিয়াই হউক, আর ভুলক্রমেই হউক, আমার ভৃত্য একদিন আমার মন্দির-মার্জ্জনান্তে দ্বার মুক্ত রাখিয়া গিয়াছিল। আমি সেই দ্বার দিয়া নিষ্ক্রান্ত হইয়া উদ্যানরক্ষককে মুখে করিয়া লইয়া চলিয়া আসিলাম। এই সকল বৃত্তান্ত সবিস্তারে বলার কারণ এই যে, আমি বহুকাল মনুষ্যালয়ে বাস করিয়া আসিয়াছি-মনুষ্যচরিত্র সবিশেষ অবগত আছি-শুনিয়া আপনারা আমার কথায় বিশেষ আস্থা করিবেন, সন্দেহ নাই। আমি যাহা দেখিয়াছি, তাহাই বলিব। অন্য পর্য্যটকদিগের ন্যায় অমূলক উপন্যাস বলা আমার অভ্যাস নাই। বিশেষ, মনুষ্যসম্বন্ধে অনেক উপন্যাস আমরা চিরকাল শুনিয়া আসিতেছি; আমি সে সকল কথায় বিশ্বাস করি না। আমরা পূর্ব্বাপর শুনিয়া আসিতেছি যে, মনুষ্যেরা ক্ষুদ্রজীবী হইয়াও পর্ব্বতাকার বিচিত্র গৃহ নির্ম্মাণ করে। ঐরূপ পর্ব্বতাকার গৃহে তাহারা বাস করে বটে, কিন্তু কখন তাহাদিগকে ঐরূপ গৃহ নির্ম্মাণ করিতে আমি চক্ষে দেখি নাই। সুতরাং তাহারা যে ঐরূপ গৃহ স্বয়ং নির্ম্মাণ করিয়া থাকে, ইহার প্রমাণাভাব। আমার বোধ হয়, তাহারা যে সকল গৃহে বাস করে, তাহা প্রকৃত পর্ব্বত বটে, স্বভাবের সৃষ্টি; তবে তাহা বহু গুহাবিশিষ্ট দেখিয়া বুদ্ধিজীবী মনুষ্যপশু তাহাতে আশ্রয় করিয়াছে।1 মনুষ্য-জন্তু উভয়াহারী। তাহারা মাংসভোজী; এবং ফলমূলও আহার করে। বড় বড় গাছ খাইতে পারে না; ছোট ছোট গাছ সমূলে আহার করে। মনুষ্যেরা ছোট গাছ এত ভালবাসে যে, আপনারা তাহার চাষ করিয়া ঘেরিয়া রাখে। ঐরূপ রক্ষিত ভূমিকে ক্ষেত বা বাগান বলে। এক মনুষ্যের বাগানে অন্য মনুষ্য চরিতে পায় না। মনুষ্যেরা ফল মূল লতা গুল্মাদি ভোজন করে বটে, কিন্তু ঘাস খায় কি না, বলিতে পারি না। কখন কোন মনুষ্যকে ঘাস খাইতে দেখি নাই। কিন্তু এ বিষয়ে আমার কিছু সংশয় আছে। শ্বেতবর্ণ মনুষ্যেরা এবং কৃষ্ণবর্ণ ধনবান্ মনুষ্যেরা বহু যত্নে আপন আপন উদ্যানে ঘাস তৈয়ার করে। আমার বিবেচনায় উহারা ঐ ঘাস খাইয়া থাকে। নহিলে ঘাসে তাহাদের এত যত্ন কেন? এরূপ আমি একজন কৃষ্ণবর্ণ মনুষ্যের মুখে শুনিয়াছিলাম। সে বলিতেছিল, ‘দেশটা উচ্ছন্ন গেল-যত সাহেব সুবো বড় মানুষে বসে বসে ঘাস খাইতেছে |’ সুতরাং প্রধান মনুষ্যেরা যে ঘাস খায়, তাহা এক প্রকার নিশ্চয়। কোন মনুষ্য বড় ক্রুদ্ধ হইলে বলিয়া থাকে, ‘আমি কি ঘাস খাই?’ আমি জানি, মনুষ্যদিগের স্বভাব এই, তাহারা যে কাজ করে, অতি যত্নে তাহা গোপন করে। অতএব যেখানে তাহারা ঘাস খাওয়ার কথায় রাগ করে, তখন অবশ্য সিদ্ধান্ত করিতে হইবে যে, তাহারা ঘাস খাইয়া থাকে। মনুষ্যেরা পশু পূজা করে। আমার যে প্রকার পূজা করিয়াছিল, তাহা বলিয়াছি। অশ্বদিগেরও উহারা ঐরূপ পূজা করিয়া থাকে; অশ্বদিগকে আশ্রয় দান করে, আহার যোগায়, গাত্র ধৌত ও মার্জ্জনাদি করিয়া দেয়। বোধ হয়, অশ্ব মনুষ্য হইতে শ্রেষ্ঠ পশু বলিয়াই মনুষ্যেরা তাহার পূজা করে। মনুষ্যেরা ছাগ, মেষ, গবাদিও পালন করে। গো সম্বন্ধে তাহাদের এক আশ্চর্য্য ব্যাপার দেখা গিয়াছে; তাহারা গরুর দুগ্ধ পান করে। ইহাতে পূর্ব্বকালের ব্যাঘ্র পণ্ডিতেরা সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, মনুষ্যেরা কোন কালে গোরুর বৎস ছিল। আমি তত দূর বলি না, কিন্তু এই কারণেই বোধ করি, গোরুর সঙ্গে মানুষের বুদ্ধিগত সাদৃশ্য দেখা যায়। সে যাহাই হউক, মনুষ্যেরা আহারের সুবিধার জন্য গোরু, ছাগল এবং মেষ পালন করিয়া থাকে। ইহা এক সুরীতি, সন্দেহ নাই। আমি মানস করিয়াছি, প্রস্তাব করিব যে, আমরাও মানুষের গোহাল প্রস্তুত করিয়া মনুষ্য পালন করিব। গো, অশ্ব, ছাগ ও মেষের কথা বলিলাম। ইহা ভিন্ন হস্তী, উষ্ট্র, গর্দ্দভ, কুক্কুর, বিড়াল, এমন কি, পক্ষী পর্য্যন্ত তাহাদের কাছে সেবা প্রাপ্ত হয়। অতএব মনুষ্য জাতিকে সকল পশুর ভৃত্য বলিলেও বলা যায়। মনুষ্যালয়ে অনেক বানরও দেখিলাম। সে সকল বানর দ্বিবিধ; এক সলাঙ্গুল, অপর লাঙ্গুলশূন্য। সলাঙ্গুল বানরেরা প্রায় ছাদের উপর, না হয় গাছের উপর থাকে। নীচেও অনেক বানর আছে বটে, কিন্তু অধিকাংশ বানরই উচ্চপদস্থ। বোধ হয় বংশমর্য্যবা জাতিগৌরব ইহার কারণ। মনুষ্যচরিত্র অতি বিচিত্র। তাহাদের মধ্যে বিবাহের যে রীতি আছে, তাহা অত্যন্ত কৌতুকাবহ। তদ্ভিন্ন তাহাদিগের রাজনীতিও অত্যন্ত মনোহর। ক্রমে ক্রমে তাহা বিবৃত করিতেছি। এই পর্য্যন্ত প্রবন্ধ পঠিত হইলে, সভাপতি অমিতোদর, দূরে একটি হরিণশিশু দেখিতে পাইয়া, চেয়ার হইতে লাফ দিয়া তদনুসরণে ধাবিত হইলেন। অমিতোদর এইরূপ দূরদর্শী বলিয়াই সভাপতি হইয়াছিলেন। সভাপতিকে অকস্মাৎ বিদ্যালোচনায় বিমুখ দেখিয়া প্রবন্ধপাঠক কিছু ক্ষুণ্ণ হইলেন। তাঁহার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া একজন বিজ্ঞ সভ্য তাঁহাকে কহিলেন, “আপনি ক্ষুদ্ধ হইবেন না, সভাপতি মহাশয় বিষয়কর্ম্মোপলক্ষে দৌড়িয়াছেন। হরিণের পাল আসিয়াছে, আমি ঘ্রাণ পাইতেছি |” এই কথা শুনিবামাত্র মহাবিজ্ঞ সভ্যেরা লাঙ্গুলোত্থিত করিয়া, যিনি যে দিকে পারিলেন, সেই দিকে বিষয়কর্ম্মের চেষ্টায় ধাবিত হইলেন। লেক্‌চররও এই বিদ্যার্থীদিগের দৃষ্টান্তের অনুবর্ত্তী হইলেন। এইরূপে সেদিন ব্যাঘ্রদিগের মহাসভা অকালে ভঙ্গ হইল। পরে তাঁহারা অন্য একদিন সকলে পরামর্শ করিয়া আহারান্তে সভার অধিবেশেন করিলেন। সে দিন নির্ব্বিঘ্নে সভার কার্য্য সম্পন্ন হইয়া প্রবন্ধের অবশিষ্টাংশ পঠিত হইল। তাহার বিজ্ঞাপনী প্রাপ্ত হইলে, আমরা প্রকাশ করিব।
দ্বিতীয় প্রবন্ধ
সভাপতি মহাশয়, বাঘিনীগণ, এবং ভদ্র ব্যাঘ্রগণ! আমি প্রথম বক্তৃতায় অঙ্গীকার করিয়াছিলাম যে, মানুষের বিবাহপ্রণালী এবং অন্যান্য বিষয় সম্বন্ধে কিছু বলিব। ভদ্রের অঙ্গীকার পালনই প্রধান ধর্ম্ম। অতএব আমি একেবারেই আমার বিষয়ে প্রবেশ করিলাম। বিবাহ কাহাকে বলে, আপনারা সকলেই অবগত আছেন। সকলেই মধ্যে মধ্যে অবকাশ মতে বিবাহ করিয়া থাকেন। কিন্তু মনুষ্যবিবাহে কিছু বৈচিত্র্য আছে। ব্যাঘ্র প্রভৃতি সভ্য পশুদিগের দারপরিগ্রহ কেবল প্রয়োজনাধীন, মনুষ্যপশুর সেরূপ নহে-তাহাদের মধ্যে অনেকেই এককালীন জন্মের মত বিবাহ করিয়া রাখে। মনুষ্যবিবাহ দ্বিবিধ-নিত্য এবং নৈমিত্তিক। তন্মধ্যে নিত্য অথবা পৌরোহিত্য বিবাহই মান্য। পুরোহিতকে মধ্যবর্ত্তী করিয়া যে বিবাহ সম্পন্ন হইয়া থাকে, তাহাই পৌরোহিত বিবাহ। মহাদংষ্ট্রা। পুরোহিত কি? বৃহল্লাঙ্গুল। অভিধানে লেখে, পুরোহিত চালকলাভোজী বঞ্চনাব্যবসায়ী মনুষ্যবিশেষ। কিন্তু এই ব্যাখ্যা দুষ্ট। কেন না, সকল পুরোহিত চালকলাভোজী নহে, অনেক পুরোহিত মদ্য মাংস খাইয়া থাকেন; অনেক পুরোহিত সর্ব্বভুক্। পক্ষান্তরে চালকলা খাইলেই পুরোহিত হয়, এমত নহে। বারাণসী নামক নগরে অনেকগুলিন ষাঁড় আছে-তাহারা চালকলা খাইয়া থাকে। তাহারা পুরোহিত নহে, তাহার কারণ তাহারা বঞ্চক নহে। বঞ্চকে যদি চালকলা খায়, তাহা হইলেই পুরোহিত হয়। পৌরোহিত বিবাহে এইরূপ একজন পুরোহিত বরকন্যার মধ্যবর্ত্তী হইয়া বসে। বসিয়া কতকগুলা বকে। এই বক্তৃতাকে মন্ত্র বলে। তাহার অর্থ কি, আমি সবিশেষ অবগত নহি, কিন্তু আমি যেরূপ পণ্ডিত, তাহাতে ঐ সকল মন্ত্রের একপ্রকার অর্থ মনে মনে অনুভূত করিয়াছি। বোধ হয়, পুরোহিত বলে, “হে বরকন্যা! আমি আজ্ঞা করিতেছি, তোমরা বিবাহ কর। তোমরা বিবাহ করিলে, আমি নিত্য চাল কলা পাইব-অতএব তোমরা বিবাহ কর। এই কন্যার গর্ভাধানে, সীমান্তোন্নয়নে, সূতিকাগারে, চাল কলা পাইব–অতএব তোমরা বিবাহ কর। সন্তানের ষষ্ঠীপূজায়, অন্নপ্রাশনে, কর্ণবেধে, চূড়াকরণে বা উপনয়নে-অনেক চাল কলা পাইব, অতএব তোমরা বিবাহ কর। তোমরা সংসারধর্ম্মে প্রবৃত্ত হইলে, সর্ব্বদা ব্রত নিয়মে, পূজা পার্ব্বণে যাগ যজ্ঞে রত হইবে, সুতরাং আমি অনেক চাল কলা পাইব, অতএব তোমরা বিবাহ কর। বিবাহ কর, কখন এ বিবাহ রহিত করিও না। যদি রহিত কর, তবে আমার চাল কলার বিশেষ বিঘ্ন হইবে। তাহা হইলে এক এক চপেটাঘাতে তোমাদের মুণ্ডপাত করিব। আমাদের পূর্ব্বপুরুষদিগের এইরূপ আজ্ঞা |” বোধ হয়, এই শাসনের জন্যই পৌরোহিত বিবাহ কখন রহিত হয় না। আমাদিগের মধ্যে যে বিবাহপ্রথা প্রচলিত আছে, তাহাকে নৈমিত্তিক বিবাহ বলা যায়। মনুষ্যমধ্যে এরূপ বিবাহও সচরাচর প্রচলিত। অনেক মনুষ্য এবং মানুষী, নিত্য নৈমিত্তিক উভয়বিধি বিবাহ করিয়া থাকে। কিন্তু নিত্য নৈমিত্তিক বিবাহে বিশেষ প্রভেদ এই যে, নিত্য বিবাহ কেহ গোপন করে না, নৈমিত্তিক বিবাহ সকলেই প্রাণপণে গোপন করে। যদি একজন মনুষ্য অন্য মনুষ্যের নৈমিত্তিক বিবাহের কথা জানিতে পারে, তাহা হইলে কখন কখন তাহাকে ধরিয়া প্রহার করে। আমার বিবেচনায় পুরোহিতরাই এই অনর্থের মূল। নৈমিত্তিক বিবাহে তাহারা চাল কলা পায় না-সুতরাং ইহার দমনই তাহাদের উদ্দেশ্য-তাহাদের শিক্ষামতে সকলেই নৈমিত্তিকবিবাহকারীকে ধরিয়া প্রহার করে। কিন্তু বিশেষ চমৎকার এই যে, অনেকেই গোপনে স্বয়ং নৈমিত্তিক বিবাহ করে, অথচ পরকে নৈমিত্তিক বিবাহ করিতে দেখিলে ধরিয়া প্রহার করে! ইহাতে আমার বিবেচনা হইতেছে যে, অনেক মনুষ্যই নৈমিত্তিক বিবাহে সম্মত, তবে পুরোহিত প্রকৃতির ভয়ে মুখ ফুটিতে পারে না। আমি মনুষ্যালয়ে বাসকালীন জানিয়া আসিয়াছি, অনেক উচ্চ শ্রেণীস্থ মনুষ্যের নৈমিত্তিক বিবাহে বিশেষ আদর। যাঁহারা আমাদিগের ন্যায় সুসভ্য, সুতরাং পশুবৃত্ত, তাঁহারাই এ বিষয়ে আমাদিগের অনুকরণ করিয়া থাকেন। আমার এমনও ভরসা আছে যে, কালে মনুষ্যজাতি আমাদিগের ন্যায় সুসভ্য হইলে, নৈমিত্তিক বিবাহ তাহাদের মধ্যে সমাজসম্মত হইবে। অনেক মনুষ্যপণ্ডিত তৎপক্ষে প্রবৃত্তিদায়ক গ্রন্থাদি লিখিতেছেন। তাঁহারা স্বজাতিহিতৈষী, সন্দেহ নাই। আমার বিবেচনায়, সম্মানবর্দ্ধনার্থ তাঁহাদিগকে এই ব্যাঘ্র-সমাজের অনরারি মেম্বর নিযুক্ত করিলে ভাল হয়। ভরসা করি, তাঁহারা সভাস্থ হইলে, আপনারা তাঁহাদিগকে জলযোগ করিবেন না। কেন না, তাঁহারা আমাদিগের ন্যায় নীতিজ্ঞ এবং লোকহিতৈষী। মনুষ্যমধ্যে বিশেষ এক প্রকার নৈমিত্তিক বিবাহ প্রচলিত আছে, তাহাকে মৌদ্রিক বিবাহ বলা যাইতে পারে। এ প্রকার বিবাহ সম্পন্নার্থ মানুষ মুদ্রার দ্বারা কোন মানুষীর করতল সংস্পৃষ্ট করে। তাহা হইলেই মৌদ্রিক বিবাহ সম্পন্ন হয়। মহাদংষ্ট্রা। মুদ্রা কি? বৃহল্লাঙ্গুল। মুদ্রা মনুষ্যদিগের পূজ্য দেবতাবিশেষ। যদি আপনাদিগের কৌতূহল থাকে, তবে আমি সবিশেষ সেই মহাদেবীর গুণ কীর্ত্তন করি। মনুষ্য যত দেবতার পূজা করে, তন্মধ্যে ইঁহার প্রতিই তাহাদের বিশেষ ভক্তি। ইনি সাকারা। স্বর্ণ, রৌপ্য এবং তাম্রে ইঁহার প্রতিমা নির্ম্মত হয়। লৌহ, টিন এবং কাষ্ঠে ইঁহার মন্দির প্রস্তুত করে। রেশম, পশম, কার্পাস, চর্ম্ম প্রভৃতিতে ইঁহার সিংহাসন রচিত হয়। মানুষগণ রাত্রিদিন ইঁহার ধ্যান করে, এবং কিসে ইঁহার দর্শন প্রাপ্ত হইবে, সেই জন্য সর্ব্বদা শশব্যস্ত হইয়া বেড়ায়। যে বাড়ীতে টাকা আছে জানে, অহরহ সেই বাড়ীতে মনুষ্যেরা যাতায়াত করিতে থাকে,-এমনই ভক্তি, কিছুতেই সে বাড়ী ছাড়ে না-মারিলেও যায় না। যে এই দেবীর পুরোহিত, অথবা যাহার গৃহে ইনি অধিষ্ঠান করেন, সেই ব্যক্তি মনুষ্যমধ্যে প্রধান হয়। অন্য মনুষ্যেরা সর্ব্বদাই তাঁহার নিকট যুক্তকরে স্তব স্তুতি করিতে থাকে। যদি মুদ্রাদেবীর অধিকারী একবার তাঁহাদের প্রতি কটাক্ষ করে, তাহা হইলে তাঁহারা চরিতার্থ হয়েন। দেবতাও বড় জাগ্রত। এমন কাজই নাই যে, এই দেবীর অনুগ্রহে সম্পন্ন হয় না। পৃথিবীতে এমন সামগ্রীই নাই যে, এই দেবীর বরে পাওয়া যায় না। এমন দুষ্কর্ম্মই নাই যে, এই দেবীর উপাসনায় সম্পন্ন হয় না। এমন দোষই নাই যে, ইঁহার অনুকম্পায় ঢাকা পড়ে না। এমন গুণই নাই যে, তাঁহার অনুগ্রহ ব্যতীত গুণ বলিয়া মনুষ্যসমাজে প্রতিপন্ন হইতে পারে; যাহার ঘরে ইনি নাই-তাহার আবার গুণ কি? যাহার ঘরে ইনি বিরাজ করেন, তাহার আবার দোষ কি? মনুষ্যসমাজে মুদ্রামহাদেবীর অনুগৃহীত ব্যক্তিকেই ধার্ম্মিক বলে-মুদ্রাহীনতাকেই অধর্ম্ম বলে। মুদ্রা থাকিলেই বিদ্বান্ হইল। মুদ্রা যাহার নাই, তাহার বিদ্যা থাকিলেও, মনুষ্যশাস্ত্রানুসারে সে মূর্খ বলিয়া গণ্য হয়। আমরা যদি “বড় বাঘ” বলি, তবে অমিতোদর, মহাদংষ্ট্রা প্রভৃতি প্রকাণ্ডাকার মহাব্যাঘ্রগণকে বুঝাইবে। কিন্তু মনুষ্যালয়ে “বড় মানুষ” বলিলে সেরূপ অর্থ হয় না-আট হাত বা দশ হাত মানুষ বুঝায় না, যাহার ঘরে এই দেবী বাস করেন, তাহাকেই “বড় মানুষ” বলে। যাহার ঘরে এই দেবী স্থাপিতা নহেন, সে পাঁচ হাত লম্বা হইলেও তাহাকে “ছোট লোক” বলে। মুদ্রাদেবীর এইরূপ নানাবিধ গুণগান শ্রবণ করিয়া আমি প্রথমে সঙ্কল্প করিয়াছিলাম যে, মনুষ্যালয় হইতে ইঁহাকে আনিয়া ব্যাঘ্রালয়ে স্থাপন করিব। কিন্তু পশ্চাৎ যাহা শুনিলাম, তাহাতে বিরত হইলাম। শুনিলাম যে, মুদ্রাই মনুষ্যজাতির যত অনিষ্টের মূল। ব্যাঘ্রাদির প্রধান পশুরা কখন স্বজাতির হিংসা করে না, কিন্তু মনুষ্যেরা সর্ব্বদা আত্মজাতির হিংসা করিযা থাকে। মুদ্রাপূজাই ইহার কারণ। মুদ্রার লোভে, সকল মনুষ্যেই পরস্পরের অনিষ্ট চেষ্টায় রত। প্রথম বক্তৃতায় বলিয়াছিলাম যে, মনুষ্যেরা সহস্রে সহস্রে প্রান্তরমধ্যে সমবেত হইয়া পরস্পরকে হনন করে। মুদ্রাই তাহার কারণ। মুদ্রাদেবীর উত্তেজনায় সর্ব্বদাই মনুষ্যেরা পরস্পর হত, আহত, পীড়িত, অবরুদ্ধ, অপমানিত, তিরস্কৃত করে। মনুষ্যলোকে বোধ হয়, এমত অনিষ্টই নাই যে, এই দেবীর অনুগ্রহপ্রেরিত নহে। ইহা আমি জানিতে পারিয়া, মুদ্রাদেবীর উদ্দেশে প্রণাম করিয়া তাঁহার পূজার অভিলাষ ত্যাগ করিলাম। কিন্তু মনুষ্যেরা ইহা বুঝে না। প্রথম বক্তৃতাতেই বলিয়াছি যে, মনুষ্যেরা অত্যন্ত অপরিণামদর্শী-সর্ব্বদাই পরস্পরের অমঙ্গল চেষ্টা করে। অতএব তাহারা অবিরত রূপার চাকি ও তামার চাকি সংগ্রহের চেষ্টায় কুমারের চাকের ন্যায় ঘুরিয়া বেড়ায়। মনুষ্যদিগের বিবাহতত্ত্ব যেমন কৌতুকাবহ, অন্যান্য বিষয়ও তদ্রূপ। তবে পাছে দীর্ঘ বক্তৃতা করিলে, আপনাদিগের বিষয়কর্ম্মের সময় পুনরুপস্থিত হয়, এই জন্য অদ্য এইখানে সমাধা করিলাম। ভবিষ্যতে যদি অবকাশ হয়, তবে অন্যান্য বিষয়ে কিছু বলিব। এইরূপে বক্তৃতা সমাধা করিয়া পণ্ডিতবর ব্যাঘ্রাচার্য্য বৃহল্লাঙ্গুল, বিপুল লাঙ্গুলচট্‌চটারব-মধ্যে উপবেশন করিলেন। তখন দীর্ঘনখ নামে এক সুশিক্ষিত যুবা ব্যাঘ্র গাত্রোত্থান করিয়া, হাউ মাউ শব্দে বিতর্ক আরম্ভ করিলেন। দীর্ঘনখ মহাশয় গর্জ্জনান্তে বলিলেন, “হে ভদ্র ব্যাঘ্রগণ! আমি অদ্য বক্তার সদ্বক্তৃতার জন্য তাঁহাকে ধন্যবাদ দিবার প্রস্তাব করি। কিন্তু ইহা বলাও কর্ত্তব্য যে, বক্তৃতাটি নিতান্ত মন্দ; মিথ্যাকথাপরিপূর্ণ, এবং বক্তা অতি গণ্ডমূর্খ |” অমিতোদর। আপনি শান্ত হউন। সভ্যজাতীয়েরা অত স্পষ্ট করিয়া গালি দেয় না। প্রচ্ছন্নভাবে আপনি আরও গুরুতর গালি দিতে পারেন। দীর্ঘনখ। যে আজ্ঞা। বক্তা অতি সত্যবাদী, তিনি যাহা বলিলেন, তাহার মধ্যে অধিকাংশ কথা অপ্রকৃত হইলেও, দুই একটা সত্য কথা পাওয়া যায়। তিনি অতি সুপণ্ডিত ব্যক্তি। অনেকেই মনে করিতে পারেন যে, এই বক্তৃতার মধ্যে বক্তব্য কিছুই নাই। কিন্তু আমরা যাহা পাইলাম, তাহার জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। তবে বক্তৃতার সকল কথায় সম্মতি প্রকাশ করিতে পারি না। বিশেষ আদৌ মনুষ্যমধ্যে বিবাহ কাহাকে বলে, বক্তা তাহাই অবগত নহেন। ব্যাঘ্রজাতির কুলরক্ষার্থ যদি কোন বাঘ কোন বাঘিনীকে আপন সহচরী করে (সহচরী, সঙ্গে চরে) তাহাকেই আমরা বিবাহ বলি। মানুষের বিবাহ সেরূপ নহে। মানুষ স্বভাবতঃ দুর্ব্বল এবং প্রভুভক্ত। সুতরাং প্রত্যেক মনুষ্যের এক একটি প্রভু চাহি। সকল মনুষ্যই এক একজন স্ত্রীলোককে আপন প্রভু বলিয়া নিযুক্ত করে। ইহাকেই তাহারা বিবাহ বলে। যখন তাহারা কাহাকে সাক্ষী রাখিয়া প্রভু নিয়োগ করে, তখন সে বিবাহকে পৌরোহিত বিবাহ বলা যায়। সাক্ষীর নাম পুরোহিত। বৃহল্লাঙ্গুল মহাশয় বিবাহমন্ত্রের যে ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা অযথার্থ। সে মন্ত্র এইরূপ;- পুরোহিত। বল, আমাকে কি বিষয়ের সাক্ষী হইতে হইবে? বর। সাক্ষী থাকুন, আমি এই স্ত্রীলোকটিকে জন্মের মত আমার প্রভুত্বে নিযুক্ত করিলাম। পুরো। আর কি? ব। আর আমি জন্মের মত ইঁহার শ্রীচরণের গোলাম হইলাম। আহার যোগানের ভার আমার উপর;-খাইবার ভার উঁহার উপর। পুরো। (কন্যার প্রতি) তুমি কি বল? কন্যা। আমি ইচ্ছাক্রমে এই ভৃত্যটিকে গ্রহণ করিলাম। যত দিন ইচ্ছা হইবে, চরণসেবা করিতে দিব। যে দিন ইচ্ছা না হইবে, সে দিন নাতি মারিয়া তাড়াইয়া দিব। পুরো। শুভমস্তু। এইরূপ আরও অনেক ভুল আছে। যথা, মুদ্রাকে বক্তা মনুষ্যপূজিত দেবতা বর্ণনা করিয়াছেন, কিন্তু বাস্তবিক উহা দেবতা নহে। মুদ্রা একপ্রকার বিষচক্র। মনুষ্যেরা অত্যন্ত বিষপ্রিয়; এই জন্য সচরাচর মুদ্রাসংগ্রহজন্য যত্নবান্। মনুষ্যগণকে মুদ্রাভক্ত জানিয়া আমি পূর্ব্বে বিবেচনা করিয়াছিলাম যে, ‘না জানি, মুদ্রা কেমনই উপাদেয় সামগ্রী; আমাকে একদিন খাইয়া দেখিতে হইবে |’ একদা বিদ্যাধরী নদীর তীরে একটা মনুষ্যকে হত করিয়া ভোজন করিবার সময়ে, তাহার বস্ত্রমধ্যে কয়েকটা মুদ্রা পাইলাম। পাইবামাত্র উদরসাৎ করিলাম। পরদিবস উদরের পীড়া উপস্থিত হইল। সুতরাং মুদ্রা যে এক প্রকার বিষ, তাহাতে সংশয় কি? দীর্ঘনখ এইরূপে বক্তৃতা সমাপন করিলে পর অন্যান্য ব্যাঘ্র মহাশয়েরা উঠিয়া বক্তৃতা করিলেন। পরে সভাপতি অমিতোদর মহাশয় বলিতে লাগিলেন;– “এক্ষণে রাত্রি অধিক হইয়াছে, বিষয়কর্ম্মের সময় উপস্থিত। বিশেষ, হরিণের পাল কখন আইসে, তাহার স্থিরতা কি? অতএব দীর্ঘ বক্তৃতা করিয়া কালহরণ কর্ত্তব্য নহে। বক্তৃতা অতি উত্তম হইয়াছে-এবং বৃহল্লাঙ্গুল মহাশয়ের নিকট আমরা বড় বাধিত হইলাম। এক কথা এই বলিতে চাহি যে, আপনারা দুই দিন যে বক্তৃতা শুনিলেন, তাহাতে অবশ্য বুঝিয়া থাকিবেন যে, মনুষ্য অতি অসভ্য পশু। আমরা অতি সভ্য পশু। সুতরাং আমাদের কর্ত্তব্য হইতেছে যে, আমরা মনুষ্যগণকে আমাদের ন্যায় সভ্য করি। বোধ করি, মনুষ্যদিগকে সভ্য করিবার জন্যই জগদীশ্বর আমাদিগকে এই সুন্দরবনভূমিতে প্রেরণ করিয়াছেন। বিশেষ, মানুষেরা সভ্য হইলে, তাহাদের মাংস আরও কিছু সুস্বাদু হইতে পারে, এবং তাহারাও আরও সহজে ধরা দিতে পারে। কেন না, সভ্য হইলেই তাহারা বুঝিতে পারিবে যে, ব্যাঘ্রদিগের আহারার্থ শরীরদান করাই মনুষ্যের কর্ত্তব্য। এইরূপ সভ্যতাই আমরা শিখিতে চাই। অতএব আপনারা এ বিষয়ে মনোযোগী হউন। ব্যাঘ্রদিগের কর্ত্তব্য যে, মনুষ্যদিগকে অগ্রে সভ্য করিয়া পশ্চাৎ ভোজন করেন |” সভাপতি মহাশয় এইরূপে বক্তৃতা সমাপন করিয়া লাঙ্গুলচট্‌চটারব-মধ্যে উপবেশন করিলেন, তখন সভাপতিকে ধন্যবাদ প্রদানানন্তর ব্যাঘ্রদিগের মহাসভা ভঙ্গ হইল। তাঁহারা যে কথায় পারিলেন, বিষয়কর্ম্মে প্রয়াণ করিলেন। যে ভূমিখণ্ডে সভার অধিষ্ঠান হইয়াছিল, তাহার চারি পার্শ্বে কতকগুলি বড় বড় গাছ ছিল। কতকগুলিন বানর তদুপরি আরোহণ করিয়া বৃক্ষপত্রমধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া ব্যাঘ্রদিগের বক্তৃতা শুনিতেছিল। ব্যাঘ্রেরা সভাভূমি ত্যাগ করিয়া গেলে, একটি বানর মুখ বাহির করিয়া অন্য বানরকে ডাকিয়া কহিল, “বলি ভায়া, ডালে আছ?” দ্বিতীয় বানর বলিল, “আজ্ঞে, আছি |” প্র, বা। আইস, আমরা এই ব্যাঘ্রদিগের বক্তৃতার সমালোচনায় প্রবৃত্ত হই। দ্বি, বা। কেন? প্র, বা। এই বাঘেরা আমাদিগের চিরশত্রু। আইস, কিছু নিন্দা করিয়া শত্রুতা সাধা যাউক। দ্বি, বা। অবশ্য কর্ত্তব্য। কাজটা আমাদিগের জাতির উচিত বটে। প্র, বা। আচ্ছা, তবে দেখ, বাঘেরা কেহ নিকটে নাই ত? দ্বি, বা। না। তথাপি আপনি একটু প্রচ্ছন্ন থাকিয়া বলুন। প্র, বা। সেই কথাই ভাল! নইলে কি জানি, কোন্ দিন কোন্ বাঘের সম্মুখে পড়িব, আর আমাকে ভোজন করিয়া ফেলিবে। দ্বি, বা। বলুন। কি দোষ? প্র, বা। প্রথম ব্যাকরণ অশুদ্ধ। আমরা বানরজাতি, ব্যাকরণে বড় পণ্ডিত। ইহাদের ব্যাকরণ আমাদের বাঁদুরে ব্যাকরণের মত নহে। দ্বি, বা। তার পর? প্র, বা। ইহাদের ভাষা বড় মন্দ। দ্বি, বা। হাঁ, উহারা বাঁদুরে কথা কয় না! প্র, বা। ঐ যে অমিতোদর বলিল, ‘ব্যাঘ্রদিগের কর্ত্তব্য, অগ্রে মনুষ্যদিগকে সভ্য করিয়া পশ্চাৎ ভোজন করেন’, ইহা না বলিয়া যদি বলিত, ‘অগ্রে মনুষ্যদিগকে ভোজন করিয়া পশ্চাৎ সভ্য করেন’, তাহা হইলে সঙ্গত হইত। দ্বি, বা। সন্দেহ কি-নহিলে আমাদের বানর বলিবে কেন? প্র, বা। কি প্রকারে বক্তৃতা হয়, তাহা উহারা জানে না। বক্তৃতায় কিছু কিচমিচ করিতে হয়, কিছু লম্ফঝম্ফ করিতে হয়, দুই এক বার মুখ ভেঙ্গাইতে হয়, দুই এক বার কদলী ভোজন করিতে হয়; উহাদের কর্ত্তব্য, আমাদের কাছে কিছু শিক্ষা লয়। দ্বি, বা। আমাদিগের কাছে শিক্ষা পাইলে উহারা বানর হইত, ব্যাঘ্র হইত না। এমত সময়ে আরো কয়েকটা বানর সাহস পাইয়া উঠিল। এক বানর বলিল, “আমার বিবেচনায় বক্তৃতার মহদ্দোষ এই যে, বৃহল্লাঙ্গুল আপনার জ্ঞান ও বুদ্ধির দ্বারা আবিষ্কৃত অনেকগুলিন নূতন কথা বলিয়াছেন। সে সকল কথা কোন গ্রন্থেই পাওয়া যায় না। যাহা পূর্ব্বলেখকদিগের চর্ব্বিতচর্ব্বণ নহে, তাহসা নিতান্ত দূষ্য। আমরা বানর জাতি, চিরকাল চর্ব্বিতচর্ব্বণ করিয়া বানরলোকের শ্রীবৃদ্ধি করিয়া আসিতেছি-ব্যাঘ্রাচার্য্য যে তাহা করেন নাই ইহা মহাপাপ |” তখন একটি রূপী বানর বলিয়া উঠিল, “আমি এই সকল বক্তৃতার মধ্যে হাজার এক দোষ তালিকা করিয়া বাহির করিতে পারি। আমি হাজার এক স্থানে বুঝিতে পারি নাই। যাহা আমার বিদ্যাবুদ্ধির অতীত, তাহা মহাদোষ বই আর কি?” আর একটি বানর কহিল, “আমি বিশেষ কোন দোষ দেখাইতে পারি না। কিন্তু আমি বায়ান্ন রকম মুখভঙ্গী করিতে পারি; এবং অশ্লীল গালিগালাজ দিয়া আপন সভ্যতা এবং রসিকতা প্রচার করিতে পারি |” এইরূপে বানরেরা ব্যাঘ্রদিগের নিন্দাবাদে প্রবৃত্ত রহিল। দেখিয়া স্থূলোদর বানর বলিল, “আমরা যেরূপ নিন্দাবাদ করিলাম, তাহাতে বৃহল্লাঙ্গুল বাসায় গিয়া মরিয়া থাকিবে। আইস, আমরা কদলী ভোজন করি |”

——————-
1 পাঠক মহাশয় বৃহল্লাঙ্গুলের ন্যায়শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি দেখিয়া বিস্মিত হইবেন না। এইরূপ তর্কে মক্ষমূলর স্থির করিয়াছেন যে, প্রাচীন ভারতবর্ষীয়েরা লিখিতে জানিতেন না। এইরূপ তর্কে জেমস মিল স্থির করিয়াছেন যে, প্রাচীন ভারতবর্ষীয়েরা অসভ্য জাতি, এবং সংস্কৃত ভাষা অসভ্য ভাষা। বস্তুতঃ এই ব্যাঘ্র পণ্ডিতে এবং মনুষ্য পণ্ডিতে অধিক বৈলক্ষণ্য দেখা যায় না।

9 Feb 2014

Welcome to Hell


হপ্তাখানেক আগে থেকে স্বর্গে recession চলছে । আজ রাত্রি নটায় ঘুম ভাঙলো যমুনার । সবার আগে মনে পড়লো আজ তার ঠাকুরদা যমের মৃত্যুশতবার্ষিকী । খাট থেকে লাফ মেরে কালচে লাল দেওয়ালে টাঙানো ঠাকুরদার ছবিতে হাড়গোড়ের মালা পরিয়ে দিলো নাতনি যমুনা ।

যমুনার বয়স এখন প্রায়-ই ২০০ বছর , কিন্তু দেখতে শুনতে একদম বিশ বছর বয়সী যুবতী । আর বিষময় যৌবনে ভরাট তার শরীর । একমাথা ভর্তি পা-পিছলে-পড়ে-যাওয়া কালো চুল , নাকটি ফট-করে-বেলুন-ফাটানো সুচালো , ঠোঁটদুটি ড্রাগ-ভর্তি পাপড়ির মত অতিসুন্দর । কিন্তু তার চোখদুটি কেউ যেন যত্নসহকারে রঙ-পেন্সিল দিয়ে এঁকে দিয়েছে যা দেখলে মনে হবে শুধু রিয়ালিস্টিক আর্ট অথচ সত্যিকারের চোখ বলে অনেকের মনে সন্দেহ হবে । কারণ আবেগ-অনুভূতি-কান্নায় তার শিল্পসুলভ চোখদুটি সম্পূর্ণ ভাষাহীন ।

রোজ রাত্রি নটায় তার ঘুম ভাঙে আর যাবতীয় কাজ শুরু করে দেয় ভোরের আলো ফোটার আগে । কিন্তু আজকের বিশেষ দিনটা তার ব্যতিক্রম । মনের মধ্যে খেলে যাচ্ছে একটা চাপা টান-টান উত্তেজনা । ঠাকুরদার কথা খুব মনে পড়ে এইসময়ে । কত পাপীষ্ঠ-পাপীয়সীদের নেমন্তন্ন করতেন নিজের হলঘরে । আসমুদ্রহিমাচলের আয়তনে এক নরকপুকুরে সবার সাথে স্নান করতেন, তাদের যত্ন করে নিজের হাতে স্নান করাতেন । একটা বিশাল ডিনাররুমে একসাথে বসে খেতেন । কিশোরী যমুনা সব দেখতো তার রঙ-পেনসিল-আঁকা দু'চোখ মেলে । সব পাপাত্মাকে দেখতে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মত । আলাদা করে তাদের পাপকর্ম দিয়ে চিহ্নিত করার জো নেই । এরা মানুষের মত মানুষ । যা পাপ করার তাই করেছে স্বর্গীয়সুখ লাভের লোভে পড়ে । আর কিছু-ই না ।

এই ব্যাপারে ঠাকুরদা জীবিতকালে একদিন যমুনাকে বলেছিলেন - "পাপ বলে যা আছে সেগুলো আসলে ঠিক পাপ নয় , এগুলো স্বর্গপুরে যাওয়ার পথে পড়ে থাকা কলার খোসা মাত্র । একটু বেখেয়ালে পড়লে কিয়ৎকালের জন্য হাত-পা ভাঙ্গলেও কোথাও না কোথাও ক্ষতস্থান তৈরী হয়ে-ই যায় বাকিজীবনের জন্যে । সেই ক্ষত শুকিয়ে ফেটে পাপ বেরোয় । আর মরণকাল থেকে এদের সেবাযত্ন করার দায়িত্ব আমাদের ।"

শুনে যমুনা জিজ্ঞাসা করেছিল - "আচ্ছা স্বর্গ কেমন ? ওখানে কারা যায় ?"

উত্তরে ঠাকুরদা জানালেন - "ছিঃ ছিঃ স্বর্গের নাম উচ্চারণ করতে নেই । এ অতি খারাপ জায়গা । এটা সমস্ত রকম পাপের উৎস , আর স্বর্গীয়সুখ পাওয়ার জন্যে লোকে ভয়ানক লোভী হয়ে যায় । সে অতি খারাপ জিনিস , বুঝলি যমুনা ?"

- "কিন্তু কারা যায় বললে না যে ?"

- "সে শুনে তোর কাজ নেই । যারা যায় তাদের তো খেয়ে দেয়ে আর কোনো অসৎ কাজ থাকে না সারা জীবন জুড়ে । ভীতুর ডিম সব । জীবনের সাদা দিক দেখে শুধু , কালো দিক দেখে না । দেখবার আগ্রহ তো দূরের কথা , সাহস হয় না । কুসংস্কারাছন্ন সৎ-ধার্মিক হতভাগাদের জায়গা"

- "আচ্ছা, ফোন নাম্বার পাওয়া যাবে ?"

- "নিকুচি করেছে । জানিস না, যমনীতির ৩৫৮৭-তম ধারা অনুসারে স্বর্গের সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা বা কিঞ্চিত ইচ্ছাপ্রকাশের অপরাধে মাথায় একটা ছোট্ট গাট্টা মারার মত কঠিনতম শাস্তি দিতে হয় । যা এখুনি পড়তে বস্ ।"

যমুনার মনে খুব জেদ চেপেছিল সেদিন থেকে , যেমন করে হোক স্বর্গপুরবাসীদের সাথে যোগাযোগ রেখে তাদের সম্বন্ধে নানা বিষয়ে জেনে নেবে একদিন না একদিন । আর ভবিষ্যতে স্বর্গের খুব শিগগির recession যে হবে সেটা বুদ্ধিদীপ্ত ও দূরদর্শী যমুনা জানতো সেই কৈশোরকাল থেকে-ই । নরকপুরের ভবিষ্যৎ যে অতিউজ্জ্বল সেটা সে তার রঙ-পেনসিল-আঁকা চোখের সামনে পরিষ্কার দেখতে পেত । দেখতে পেত দেশে পাপীসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে , তার সাথে সমান হারে বাড়ছে পাপিয়সীর সংখ্যা । দেশের সরকার নিজে-ই ঘুষখোর । নিজে-ই ধর্ষকের নামান্তর । সরকারের ফেলা একেকটা থুথু একেকটা খুনের সমান । আর ভাবতো , ইস্ এত পাপী-পাপিনীদের জায়গা হবে কোথায় ? নরকটাকে আরো বড় করতে হবে , মেরামত করতে হবে , রঙ করতে হবে , আরো জমি কিনতে হবে , নতুন নতুন ফ্ল্যাট কিনতে হবে , প্রচূর কাজ পড়ে আছে । যমুনা মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলো সে নিজে সব দায়িত্ব নেবে । যেমন ভাবার তেমনি কাজ ।

এখন নরকে প্রত্যেক জীবিত মানুষের জন্যে একটা করে ঘর । যখন যে শিশুর জন্ম হয় ঠিক তক্ষুনি একটা নতুন ঘরের ব্যবস্থা হয়ে যায় নরকপুরে । কারণ যমুনা জানে-ই যে প্রত্যেক নবজাতকের মধ্যে লুকিয়ে থাকে পাপবীজ । সেই বীজ থেকে পাপী অঙ্কুরিত হয়ে বড় হতে থাকে । দুই কি তিন বছরের মধ্যে পাপের জয়যাত্রা শুরু হয়ে যায় । ক্রমশ-ই পরিণত হতে থাকে পাপ । শুধু অপেক্ষা তার মৃত্যু । না , পাপের মৃত্যু নয় । দুপেয়ে পাপীর মৃত্যু ।

ছোটবেলায় কোত্থেকে চুরি করা স্বর্গের ফোন নম্বর বের করলো যমুনা । সেই নম্বরে ডায়াল করলো । ওপ্রান্ত থেকে মিনমিনে একটা কন্ঠস্বর ভেসে এলো
- "হ্যালো? কাউকে পেলি ?"

যমুনা প্রথমে হতচকিত হয়ে সামলে নিলো তক্ষনাৎ । গলা একটু নরম করে বললো
- "ইয়ে আমি যমুনা বলছি । নরকপুর থেকে ।"

- "ওয়াট্ দা ফা-আ-আ হেল্ ? ওয়াট্ ডু ইউ মিন্ ?"

- "ইয়েস স্যার । স্পিকিং ফ্রম্ হেল্ ।"

- ( ওপাশের গলা কেঁপে উঠলো যেন ভয় পেয়ে ) "আ-আ-আর ইউ সিওর ?"

- ( বহু কষ্টে হাসি চেপে ) "ইয়েস স্যার ! সো ক্যান আই আস্ক সামথিং ইম্পোর্টান্ট ?"

- ( আমতা আমতা করে ) "ইয়েস্ প্লিজ্ শুট্ । বাট্ বিফোর্ দ্যাট্ আই নিড্ টু নো ইওর নেম্ । "

- "ইয়েস্ যমুনা বলছি । এবার বাংলায় বলি শুনুন ..."

- "দাঁড়ান দাঁড়ান । যমুনা মানে ? যমের কি হলো ?"

- "বস্ আমি যমের নাতনি । ঠাকুরদা গত হয়েছেন আজ থেকে একশো বছর আগে"

- "ওহ ওক্কে ওক্কে । আমার ও তাই । সরি আই মিন আমার বাবা মারা গেছেন অনেক বছর আগে । আমি তার ছেলে বলছি । আমার নাম জুনিয়র দেবতা । আমাকে দেবজু বলে ডাকে এখানকার লোকে"

- "বেশ দেবজু । কিন্তু আপনার গলা শুনে মনে হচ্ছে না যে আপনি আমার বাবার বয়সী । আমার-ই বয়সী বোধ হয় । যাই হোক আসল কথায় আ-আ..."

- ( সব ভুলে উৎসাহিত হয়ে ) "তাই নাকি ? আর ইউ সিঙ্গল ?"

- ( হাসিতে ফেটে পড়তে পড়তে ) "ধুর মশাই আপনি সত্যি না ! কি হবে এইসব জেনে ? আসল ক-অ-অ..."

- ( রেগে গিয়ে ) "এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন ?"

- ( একটু থতমত খেয়ে ) "ইয়েস আমি একা । আমাদের নরকপুরের বাসিন্দা বলতে একমাত্র আমি একা । আর কেউ-ই নেই । আর যারা আছে তারা সবাই পা-আ-আ..."

- ( 'নরক' নাম শুনে হোঁচট খেয়ে ) "সরি বলুন এবার ।"

- "ওয়েল । আমি শুনলাম আপনাদের ওখানে নাকি recession চলছে এখন..."

- "সেরেছে ! কি করে জানলেন?"

- "জানি সব আমি । আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন থেকে হিসেব করে জানতে পেরেছিলাম..."

- "হুম । কিন্তু কি দরকার তাতে আপনার ?"

- "নাহ মানে আমি জানতে চাইছিলাম যে এই দুর্দশায় কি করে টিকে আছেন আপনারা মানে বউ বাচ্চা...?"

- ( বিরক্ত হয়ে ) "কে বললো আপনাকে যে আমার বউ আছে ? বিয়ে হয় নি আমার । কে বিয়ে করবে এই দুর্দশায় ? আসলে দেশের অবস্থা উন্নতি হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না , কিন্তু টের পাই অনেকবছর ধরে গা থেকে সততার পোশাক খুলে ভিতরের সমস্ত সভ্যতান্তর্বাস খুলে নেত্যকীর্তন করছে গোটা দেশ । তাই পুণ্যকাজের সমস্ত বিল ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে সরকার । মানুষ মরে গিয়ে সব শুধু হেলে যাচ্ছে । দেখতে দেখতে আমার লাইফটা পুরো হেল হয়ে গেছে তখন থেকে..."

- ( একটু নরম হয়ে ) "বুঝতে পারছি দেবজু । মন খারাপ করবেন না । ঠিক হয়ে যাবে সব ।"

- ( গলায় বিস্ময়ের সুর এনে ) "কি করে হবে? ইজ ইট পজিবল্ ? "

- "হবে । জানেন তো আমার এখানে অনেক গুনীমানী পাপাত্মা আছে । তাদের মধ্যে একজন হলো লিও টলস্টয় । নামকরা ঔপন্যাসিক ছিলো । সেই পাপাচারীর সাথে আমার মাঝে মাঝে কথা হয় । তার কাছে একটা কথা জানতে পারলাম - 'Everyone thinks of changing the world, but no one thinks of changing himself' - এই কথাটা একবার ভেবে দেখুন তো ।"

- ( গভীর শ্রদ্ধায় গলার স্বর পাল্টে গিয়ে ) "উরিব্বাশালা সরি ইয়ে মানে টলস্টয়ের নাম অনেক শুনেছি আমাদের এখানকার একজনের মুখে , কিন্তু উনি আপনাদের ওখানে গেলেন মৃত্যুর পরে । বেশ তো । কিন্তু ও কি এমন অন্যায় করেছিলেন?"

- ( তিতিবিরক্ত হয়ে ) "আপনি দেখছি এই বিশ্বপাপের কোনো খবর রাখেন না । টলস্টয় ছিল অনেক বড় মাপের ধর্ষক..."

- ( বিষম খেয়ে ) "অ্যাঁ ! কি বললেন ? ছিঃ ছিঃ ওইসব আমাদের এখানে চলে না । এখানে যারা এসেছে তারা সবাই ভীষণ সৎচরিত্রবান , জীবনে একটাও অন্যায় বা অপরাধ বা পা-আ-আ কি যেন বলে ওটাও করে নি । এই নিয়ে আমার ভীষণ গর্ব হয় "

- ( মুচকি হেসে ) "বুঝলাম ! আপনি 'পাপ' কথাটা পর্যন্ত শোনেন নি দেখছি । যাইহোক যা সব বললেন সব-ই পাপের নামান্তর । তবে এটাও জেনে রাখুন আর কোনোদিন নিষ্পাপ ভ্রূণ নিয়ে কেউ ভূমিষ্ঠ হবে না । এবার ভেবে দেখুন টলস্টয়ের অমূল্য ওই কথাটা ।"

- "হুম ঠিক আছে একটু ভেবে দেখছি । আপনার ফোন নম্বর দিন তো আর ছবিসহ ঠিকানা দিন ।"

- "ফোন নম্বর আর ঠিকানা দিতে পারি । ছবি নিয়ে কি করবেন আপনি? বুঝলাম না ।"

- "নাহ মানে আসলে আমাদের এখানে হাজার হাজার নিয়মের কড়াকড়ি ব্যাপার আছে । স্বর্গনীতির ১২ নং ধারা অনুসারে কারো সাথে ফোনে কথা বলতে গেলে সেই ব্যক্তির নাম-পরিচয়-ঠিকানা-ছবি সব-ই আগে থেকে নথিভুক্ত করে রাখা উচিৎ"

- "আচ্ছা বেশ । তাই হবে । আপনার মেল আই.ডি. দিন । এক মিনিটের মধ্যে পাঠিয়ে দিচ্ছি আমার ছবিসহ কন্টাক্ট ডিটেলস্"

- "এই নিন ডি ই বি ডট জে আর এট দ্য রেট হিভেন ডট কম"

- "ধন্যবাদ দেবজু । এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি । এখন রাখছি আর আপনার প্ল্যান জানাতে ভুলবেন না । বাই । "

- "সিওর বাই ।"
বলে ফোনের রিসিভার রাখলো দেবজু । তারপর তার বহুদিনের পুরোনো জং ধরে যাওয়া ঘরে ফিরলো । PC অন্ করলো । নেট কানেক্ট করার ট্রাই করলো বার আটেক । অবশেষে এলো । মেলবক্স ওপেন করলো । খুলে দেখলো যমুনা নামের সেন্ডার থেকে একটা মেল এসে গেছে ততক্ষণে । ক্লিক্ করলো । দেখে নিলো কন্টাক্ট নম্বর আর ঠিকানা । attachment ওপেন করলো । যা খুললো তা দেখে মাথাটা ঘুরে গেলো দেবজুর ।

এমন চোখদুটি দেখে নি দেবজু আগে কখনো । কোনো ভাষা নেই চোখের । নেই কোনো আবেগ । না হাসি , না দুঃখ । কোনো পুণ্যতার আভাস নেই । নিষ্পাপ ও বলা যাবে না । এমন ভাষাহীন চোখদুটি শুধু রঙ-পেনসিল-আঁকা বলে মনে হয় কেউ যেন ভিতরের সমস্তকিছু ব্লটিং পেপার দিয়ে শুষে নিয়েছে । অপার বিস্ময়ে থিতু দেবজু কতক্ষণ ধরে ছবিটা দেখছিলো খেয়াল নেই । এমনকি যমুনার শরীরের দিকে তখনো তার চোখ পড়ে নি ।

হঠাৎ দেবজুর মনে হলো তার নিজের শরীরের ভিতরে কিছু একটা হচ্ছে যা আগে কখনো হয় নি । সারা শরীর বেয়ে রক্ত যেন উন্মাদের মত ছুটে বেড়াচ্ছে । তারপর মনে হলো নিজের উরুসন্ধির মাঝের লম্বাটে ধরণের মাংসপিণ্ডটা যেন মাথা একটুখানি নেড়ে থামলো । সে বুঝতে পারলো না ব্যাপারটা কি হচ্ছে ? আবার দেখলো ছবিটার দিকে । চোখদুটি যেন ভাষাহীনতায় আরো অস্বাভাবিক সুন্দর হয়ে উঠছিলো । সেই সৌন্দর্যের টানে সে আবার অনুভব করলো সেই পিণ্ডের মৃদু ছটফটানি । এইভাবে পুণ্যতার অন্তিমবিন্দুতে এসে প্রকৃতির ডাকে শেষে সাড়া দিলো সে । সেই মাংসপিণ্ডের গায়ে ডানহাত রেখে বুলিয়ে দিলো । সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো চরম পবিত্র পাপহীনতা । রক্তে বইছে অতি নিষ্পাপ স্রোত । এক অদ্ভূত পরমতৃপ্তিতে আত্মহারা হয়ে পড়লো জুনিয়র দেবতা । ডানহাতটি চলতে থাকলো নিজস্ব প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে । এক তীব্র পুণ্যগতিতে । পরিশেষে পেলো জীবনের সবচেয়ে বড় পুরষ্কার । পুণ্যকর্মের বিশুদ্ধ ফল ।

পরদিন যমুনার মোবাইল বেজে উঠলো । স্ক্রীনে ভেসে উঠলো - "one unread mail from Debju" । ওপেন করে দেখলো সে । তাতে দেবজু লিখেছে - "যমুনাদেবী , গতকাল আমি এমন একটা শুভকাজ করেছি নিজের স্বার্থে যা আগে কখনো করি নি জীবনে । ষোলোআনা পুণ্যকর্ম যাকে বলে । জীবনের সাদা দিকটা আরো কাছ থেকে দেখতে পেলাম । এতো সাদা ধবধবে যে কল্পনাও করতে পারবেন না আপনি । আগাগোড়া পবিত্র সাদা । I've changed myself a lot. Anyway, now I've decided to meet you first for further discussion on this. Want to go to Hell."

যমুনা রিপ্লাই দিলো - "Welcome to Hell"

6 Feb 2014

Elomelo #55


একটা পাতা শেষ করতে পারলাম না আজও
কাল আধপাতায় ঘুম

বাইরে পাতার পর পাতা
পড়ে ক্লান্ত হয়ে

মলাটে হেলান দিলে এক হয়
চোখের পাতা

4 Feb 2014

কাবোতি #1


#
ঘুম ভেঙ্গে দেখি বালিশের তলা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটছে , তার পেছনে পড়িমরি করে ছুটছে কবিতা । কে এমন আছে অ্যাম্বুলেন্সে ? তার বা কি হয়েছে ?

#
বের করো গোটা চারেক পেরেক । ঠুকে দাও কবিতার হাত-পা । টাঙিয়ে রাখো সোজা করে । ক্রুশবিদ্ধ যিশুখ্রিষ্ট । সবাই দেখুক । সবার মনে গেঁথে থাকুক ।


#
কবিতার ভ্রূণহত্যার অপরাধে কোনো আইনসম্মত শাস্তি আছে ? ফাঁসি ? আজীবন কারাবাস ? দ্বিতীয়টাতে কিন্তু আরেকটা ভ্রূণের জন্ম হয় । জানেন তো ?

#
একটা শুক্রাণু আর অসংখ্য কবিতাণু । নাহ সরি । হিসেবে ভুল আছে । কবিতার যৌনতা আনপ্রেডিক্টেবল্ । 

#
পাঁচতলার বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিচ্ছে কবিতা । তার আগে ভাত-মাছ-ডাল-তরকারি সব খেয়েছে ।  সাথে জলের সঙ্গে কলম গুলে খেয়েছে । 

#
মমতা ব্যানার্জীর বাথরুমে সারা গায়ে সাবান মাখছে কবিতা । ঘষটে ঘষটে মাখছে । দিদি ওকে নিয়ে বইমেলায় যাবে । এক্ষুনি । সময় নেই । 

#
পাঠকের খুব জ্বর । একশো চার । কবিতা এসে তার কপালে হাত রাখলো । পাঠক 'জ্বরু জ্বরু' চোখ মেলে জিজ্ঞেস করলো - "কে ভাই , তুমি ?"
উত্তরে কবিতা নিজের পরিচয় দেয় । শুনে পাঠকের মেজাজ 'জ্বরম' হয়ে গেলো - "একে ঘরে পাঠালে কেন, মা ?"
মা ওপাশের ঘর থেকে সাড়া দিলো - "আমি তোর জন্যে পাঠালাম তো, তুই ওকে ভালোবাসিস বলে"
শুনে পাঠকের কান্না পেলো , 'জ্বরা' গলায় বললো - "আমি কবে আবার কবিতাকে ভালোবাসলাম ?"

#
রেস্টুরেন্টে ঢুকে সে হাঁক দিলো - "দু গ্লাস কবিতা দে", ওপাশ থেকে প্রশ্ন এলো - "স্যার , কোনটা নেবেন ? ভাস্করাম ? বিনয়িস্কি ? তারাপদকা ? সুভাষিন ? রবিয়ার ? পিনাকিউলা ? জঅঅ..."
সে বিরক্ত হয়ে হাত তুলে তাকে থামিয়ে বললো - "যেটা আছে সেটা দে । তবে একটু তাড়াতাড়ি দে । খেয়ে সোজা অবনীর বাড়ি যাবো ।"

2 Feb 2014

ছুটি



ছুটি নিলো । কে আবার নেবে ? খেটে মরা দেহ থেকে খসে পড়া মন । তবে হঠাৎ করে নয় । 'Species' বলে একটা মুভিতে যেভাবে ডেভেলপ্ করতে করতে আকারে ও আয়তনে বড় হলো , তারপর টুপ্ করে খসে পড়লো মাটিতে সম্পূর্ণ স্বাধীন মানবদেহী একটা প্রজাতিবিশেষ , ঠিক সে-ই রকম করে টুপ্ করে খসে পড়লো মনটা । গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে নিজে । কিন্তু ওইটুকুতে-ই মিল । বাকিগুলোতে সিপিএম বনাম তৃণমূল । সে যাই হোক ।  

এই ছুটি কিছুদিনের জন্য কিম্বা স্বল্পমেয়াদের চিরকালীন সমাহার । এই ছুটি যা তা রকমের যেই সেই ছুটি নয় । জানি না কিসের ছুটি যদিও স্বঘোষিত সরকার-ই ছুটি ।

একলা ছুটিঘরে বসে আছে এই স্বতন্ত্র বিদেহী মন । একা একা । তার কাছে কেউ আসবে না বা সে নিজে কারোর কাছে যাবে না । মেইন এন্ট্রির মুখে 'নো এন্ট্রি' । আবার প্রস্থানের মুখেও একটা লাল শক্তিশালী পাকাপোক্ত ক্রস । কিন্তু এইসবে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই । এমনকি 'ডোন্ট ডিস্টার্ব' এর মত কর্মব্যস্ততার মনোভাব বা নিভৃতে যৌনমিলনের মনোবৃত্তি নেই । নিষ্কাম লিঙ্গহীন মন । 

শূন্যে ভাসমান একটি চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে এখন সে আপন মনে । চেয়ারটার পা নেই , হাতল নেই , হেলান দেওয়ার পিঠ-ও নেই , আছে শুধু বসার জন্যে উপযুক্ত আরামদায়ক জেলিপদার্থ যা কয়েকটা বিশেষ নিউরোন দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে । একেকটা নিউরোনের মধ্যে রয়েছে মনের জন্যে একেকরকম স্বাদের খাবার । টকদইয়ের 'ক' থেকে শুরু করে তেঁতুলের 'চন্দ্রবিন্দু' অবধি পার্মুটেশন এন্ড কম্বিনেশন পদ্ধতিতে রান্না করা । এই কটা-ই তার ছুটির সম্পদ । 
 
তার পেছনে পূর্ব-পশ্চিম জুড়ে রয়েছে লালচে সাদা দেওয়াল , দেওয়ালের গা বেয়ে ছোটো বড় অসংখ্য শিরা ধমনী । এগুলো সাপের চেয়েও নিষ্পাপ এবং সবগুলো-ই নির্বিষ । দেওয়ালের মাঝখানে একটা পিন ফোটার মত একটা ফুটো আছে যা দিয়ে দিনে একবার একটি নির্দিষ্ট সময়ে মিষ্টি রক্ত চুঁইয়ে পড়ে । একই ধারায় একই গতিতে একমুখী রক্ত । চেয়ারটির সাথে বেঁধে থাকা একটা ব্যাগে জমা পড়ে । মনতেষ্টা মেটাবার তালে । 

চেয়ারের সামনের দিকে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর হয়ে আছে অনেকগুলো গল্পিকা উপন্যাসিকা । সমান্তরাল ভাবে । ওরা সবাই যেন যোগাসনে ব্যস্ত । কেউ শীর্ষাসন , কেউ পদাসন , কেউ আবার ভুজঙ্গাসন, আর কীসবাসন । এরা এত ব্যস্ত যে মনটা কি করবে বুঝতে-ই পারছে না । ঘন্টার পর ঘন্টা এক-ই ভঙ্গিতে চলে আসনগুলি ।  সবগুলো নির্বিকার । কার ধ্যানভঙ্গ আগে-ই করবে সে নিজে জানে না । সে চেয়ার থেকে নেমে প্রথমে পায়চারী করলো , একবার তাদের কাছে যাবে ভাবছে , কিন্তু ওদের একনিষ্ঠ  ব্যক্তিত্বময়ী ভঙ্গি দেখে সাহস কিছুতে-ই কুলোয় না তার । কারণ সে নিজে একটা ছন্নছাড়া , অগোছালো , অলস , অস্থির , বেহিসেবী প্রকৃতির । এদের সাথে তার কোনোদিন কি স্থায়ী প্রেম করতে পারবে ? পারলেও কি এদের সময় দিতে পারবে কি সময়ে অসময়ে দুঃসময়ে ? এইসব প্রেমজ্ ভাবনা ঝেড়ে মনটা আবার ফিরে গেল তার প্রিয় চেয়ারটির কাছে । খুব ক্ষিদে পেয়েছে । চেয়ারের একটা নিউরোন পটাং করে ছিঁড়ে মুখে নিলো আর চুষতে লাগলো ।

এমন সময়ে তার চোখে পড়লো একটা ছোটখাটো গল্পিকা যে এতক্ষণে ধনুকাসনে মগ্ন ছিলো । চেহারাখানি ছোট হলে কি হবে ? এর আসনের ভঙ্গিতে রয়েছে এক অসামান্যা তেজ আর জেদ । তার সারা শরীর বেয়ে যেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে একটা অদৃশ্য বুনোবিড়াল , তর তর করে ঘাম ঝরছে তার কপাল বেয়ে , ঘামের বিন্দুগুলো কাঁধের কাছে এসে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে পড়লো । তার উজ্জ্বল চোখদুটি আস্তে আস্তে ঘুরে এলো মনটার দিকে । চোখদুটিতে এমন কিছু একটা মাদকাসক্তি চাহনি আছে যা দেখলে-ই বুক কেঁপে উঠবে । মনটার কিন্তু এতে কোনো হেলদোল নেই । সে খালি স্থির হয়ে দেখে-ই যাচ্ছে সেই বুনো গল্পিকার দিকে । একরকম ভেবলীকান্ত হয়ে । তার এই বেহাল বুঝে চেয়ারটি যেন প্রথমে প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দুলে উঠলো । মনটা টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলো আর গড়াগড়ি খেলো । গড়াতে গড়াতে সোজা গিয়ে পৌঁছালো সেই তেজস্বিনী গল্পিকার কাছে ।

এই গল্পিকাটি কিন্তু অনেক আগে-ই অন্য কোনো এক অপরিচিত বুড়োমনের কাছে তার প্রথম কুমারীত্ব হারিয়েছে । অনেকের হাতে ঘুরে এসেছে । কিন্তু এই মনটার কাছে নতুন । আদ্যোপান্ত একদম ফ্রেশ । বুনোবিড়ালী জালের ফাঁদে পা যখন পড়েছে সে কী আর করবে ? মেনে নিলো এটা-ই তার নেওয়া ছুটির প্রথম এবং প্রধান রসদ । 

ঘরের ছাদে ছুটির ঘন্টা "পড় শালা মন দিয়ে" এই শব্দধ্বনিতে বেজে উঠলো বার বার