15 Feb 2014

শব্দ


শব্দকল্পদ্রুম Vs. আমি

"ঠাস্‌ ঠাস্‌ দ্রুম দ্রাম,শুনে লাগে খটকা--
ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পট্‌কা!
শাঁই শাঁই পন্‌ পন্‌, ভয়ে কান বন্ধ--
ওই বুঝি ছুটে যায় সে-ফুলের গন্ধ?
হুড়মুড় ধুপধাপ--ওকি শুনি ভাইরে!
দেখ্‌ছনা হিম পড়ে-- যেও নাকো বাইরে।
চুপ চুপ ঐ শোন্‌! ঝুপ ঝাপ্‌ ঝপা-স!
চাঁদ বুঝি ডুবে গেল? গব্‌ গব্‌ গবা-স!
খ্যাঁশ্‌ খ্যাঁশ্‌ ঘ্যাঁচ্‌ ঘ্যাঁচ্‌ , রাত কাটে ঐরে!
দুড়দাড় চুরমার--ঘুম ভাঙে কই রে!
ঘর্ঘর ভন্‌ ভন্‌ ঘোরে কত চিন্তা!
কত মন নাচ শোন্‌--ধেই ধেই ধিন্‌তা!
ঠুংঠাং ঢংঢং, কত ব্যথা বাজেরে--
ফট্‌ ফট্‌ বুক ফাটে তাই মাঝে মাঝে রে!......." 

'শব্দকল্পদ্রুম'-এর লাইনগুলি যতবার পড়ি ততবার মুখ নিশ্ পিশ্ করে বিকৃত করি । রাগে সমস্ত শিরা-উপশিরা দপ্ দপ্ করে । এত 'আবোল-তাবোল' বকতে পারেন গোল গোল চশমাধারী লোকটা ? জানি আমার এই রাগটা হিং-টিং-ছট্ গোছের । কিন্তু ফুল ফোটা, চাঁদ ডোবা, রাত কাটা, ঘুম ভাঙা, চিন্তা ঘোরার মত দৈনন্দিন পার্থিব মুভমেন্ট কিংবা মন নেচে ওঠা , ব্যথা বেজে ওঠা , বুক ফেটে যাওয়ার মত মানসিক অন্তর্বাসের গোপনীয়তা - এইসব কি সত্যি সত্যি সশব্দে হয় ? আরে বাবা, আমি ভালো-ই জানি যে রায়বাবু রসিকতা করে বিশেষ বিশেষ ক্রিয়াপদের সাথে শব্দপদগুলি তুলনা করেছেন । বাট ওয়াই ? যেটা পার্থিবভাবে অপার্থিব বা যার মধ্যে বাস্তবিক-ই কোনো শব্দধ্বনি বাজে না সেটা নিয়ে এইরকম ছেলেখেলা করলে আমার মত যারা আছে তাদের কাছে এটা বেঠিক পথের ঠিকানা । বুঝতে পারো নি নিশ্চয়ই ?

আসল বক্তব্য হচ্ছে একজন বধির মানুষের কাছে 'শব্দ'-এর সঠিক ব্যবহারিক নির্দেশ । এখানে আমি একজন জন্মবধির হয়ে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠছি কিনা তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে 'শব্দ' নিয়ে আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিচালিত জীবনভর অভিজ্ঞতাভিত্তিক কিছু মন্তব্য । রায়বাবু জীবিতকালে কোনো বধির মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছেন কিনা আমার জানা নেই, পেলেও তার ছিটেফোঁটা পাই নি তাঁর কোনো লেখার মধ্যে যতটুকু পড়েছি । সবেতে তাঁর নিজস্ব কল্পনাশক্তি এবং সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ নিয়ে পরীক্ষামূলক লেখনী । অবশ্য-ই এর মধ্যে অসাধারণত্ব খুঁজে পেতে দেড় সেকেন্ড লাগবে না কারো । কিন্তু অন্তত আমি ? হয়ত পাই । ওনার শব্দবাঁধুনি নিয়ে ছড়া লেখার ক্ষমতা যে অপরিসীম এবং তৎকালীন সমসাময়িক কবি বা লেখকদের থেকে আলাদাভাবে যে একটা স্বতন্ত্রবিশেষ শিরোপা পেয়েছেন তা নিয়ে আমার সন্দেহের একটু-ও ফাঁকফোকর নেই । তবুও যথেষ্ট শ্রদ্ধেয় মনোভাব নিয়ে আমার একটা অতি সহজ সরল প্রশ্ন - উনি যদি 'নৈঃশব্দ্য' নিয়ে একটা জলজ্যান্ত গল্প বা ছড়া লিখতেন তাহলে কি খুব একটা জমতো ?

নাহ, জমতো না । কারণ শব্দের মধ্যে যে একটা নিঃশব্দের বীজ লুকিয়ে থাকে সেটা একমাত্র আমার মত যারা তারা উপযুক্ত জমিতে, হয়তো বা নিষিদ্ধ জমিতে রোপণ করতে সক্ষম হবে, তা বলা-ই বাহুল্য । এই নিঃশব্দের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে যে চারাগাছটি  বড় হতে থাকে আমাদের জীবনযাত্রার সাথে তাল রেখে , সেই চারাগাছের শব্দবহুল আবহাওয়াতে বেড়ে ওঠাটা কেমন যেন সবার দৃষ্টির অগোচরে পড়ে যায় । এইকথা ভাবলে-ই এখনো অফিসে কাজ করাকালীন বুক ফাটে আমার , অবশ্যই সশব্দে নয় । কালি-পটকার মত ফট্ ফট্ করে ফাটলে-ই তো আমার চাকরী সেই কবে হয়ে যেতো ঘচাং ফু । যাই হোক, এই বুকফাটার সাথে সাথে চোখের বাঁধ ভেঙে ( তাও ঝন্ ঝন্ করে নয়, নইলে চোখের বাঁধ সশব্দে ভাঙার সুবাদে বিশ্বরেকর্ডে আমার নামে নিশ্চিত বুকড্ ) ভিতরের সমস্ত কান্না বেরিয়ে আসে দুই গাল বেয়ে । শব্দহীন এক কষ্ট । নিঃশব্দের ব্যথা কোনো শব্দ বা সাউন্ড দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না । অবর্ণনীয় এই যন্ত্রণা আমার নিজের আকাশ বাতাস ধুলিকণার সাথে এক অদ্ভূত শান্ত সুতোয় সুন্দরভাবে বাঁধা । সেই সুতোর কাল্পনিক তারটি ধরে আলতো করে টান মারলে হয়তো শুধু তোমরা শুনতে পাবে একটা মিষ্টিসুর - রিং রিং রিং ।

শব্দের সাথে লুকোচুরি

যখন পূর্ণাঙ্গ ভ্রূণ ছিলাম আমি , তখনো অন্ধকার নোনা সমুদ্রগহ্বরে ভাসছিলাম । টের পেতাম বন্ধ গোলাকৃতি দেয়ালের সাথে মৃদু আদু ধাক্কা । দেখতে পেতাম জল আর জলের মধ্যে ভেসে থাকা কতকগুলো না-জানা জৈবিকবস্তু । জিভে এসে ঠেকতো নানা স্বাদ-বিস্বাদ । নাকভরে শুঁকতাম গন্ধময় জঠররাজ্য । কিন্তু স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞের বা গর্ভধারিণীর কারো গুরুগম্ভীর আলোচনা কানে এসে পৌঁছাতো না । কখনো-ই না । দেখতে দেখতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় এলো একসময় । কিন্তু আমি স্বীয় দোষগুনে চুপচাপ  ছিলাম ভিতরে । বাইরে বেরোনোর জন্যে দোনোমোনো করছিলাম কিন্তু অবাধ্য ডাক্তারবাবু আমার ঘাড় ধরে টেনে বের করে আনলো । বাধ্য হয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে দেখা দিলাম জন্মদাত্রীকে, জন্মদাত্রীর পরম পতিদেব এবং তাদের নিকটাত্মীয়দের সামনে । আমার তলপেটের তলায় কচি পাদুটির মাঝের ঝুলন্ত পুঁচকে জিনিসটার দিকে একবার না দুবার নির্দেশ করলো ধোপদুরস্ত ধড়াচুড়ো পরা হারামী ডাক্তারবাবু । কিন্তু দেখি সবার মুখে এক অনাবিল আনন্দের হাসি । শব্দহীন হাসি ।

প্রথম কালীপূজার আগে দেখে যেতাম আমার উপর আদরযত্নের বাহার । সাথে দেখতাম সবার ঠোঁটদুটি অনবরত নড়ে যাচ্ছে, চোখ নাচানাচি করে যাচ্ছে আমার দিকে তাকিয়ে । ঠোঁটনাড়া কবে যে থামবে সেটা ভেবে ভেবে ঘুমিয়ে পড়তাম মাঝে মাঝে । এইভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জীবনের সেই প্রথম কালীপূজার ভরদুপুরে । কখন যে ভাঙলো ঘুম জানি না কিন্তু দেখলাম আমায় ঘিরে চারজোড়া চোখ, সাথে উদ্বিগ্ন মুখের অস্বস্তিকর ভিড় । মাথাভর্তি কাঁচাপাকা চুলের যে লোকটি ছিলো আমার মাথার কাছে তাকে দেখলাম ঘন ঘন দুই হাত মিলে জোড়-বিজোড় করছে , একবার কানের দোরগোড়ায় এসে দুই আঙ্গুলের ডিগবাজির খেল দেখালো । আমি যেন অপরাধের মুখ করে ছিলাম আর চোখদুটি ঘোরাছিলাম দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে । আমার অপরাধ ওদের কাছে যেন অবাক বিস্ময়বস্তু ।

একদিন ঘুম ভেঙে দেখলাম আমার সামনে বসে আছে জন্মদাত্রী । তার পিপের মত ফুলে যাওয়া চোখদুটি থেকে জল গলগল করে বেরিয়ে পড়ছে । ঠোঁটদুটি কেঁপে কেঁপে উঠছিলো । তার পিঠে হাত রেখে বুলিয়েছিল তার পাশে বসে থাকা সুদর্শন পতিদেব । আমি আবার চোখবুজে ঘুমিয়ে পড়লাম । এতো কান্নার রোল বেজে উঠেছিলো চারপাশে তখন আর সেই শব্দসমুদ্রের বুকে আমি নির্বিকার ঘুমন্ত শিশু । নিঃশব্দপুরের বাসিন্দা এক দোষী রাজপুত্র । কিন্তু সেদিনে ঠিক কি হয়েছিলো অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম ।

জানতে পেরেছিলাম যে কোনো এক ই.এন.টি. স্পেশালিস্ট পরীক্ষা করে ঘোষণা করেছিলো - আমি বড় অপরাধী আর অপরাধ হলো শব্দকে খুন করেছিলাম সেই ভ্রূণ থাকাকালীন । এ যেন ভ্রুণহত্যার বদলে শব্দহত্যা । আমার ভ্রূণ তো তখন মেরে ফেললে ভালো হতো তাহলে পাহাড়প্রমাণ দোষের ভার এখনো যে বয়ে বেড়াচ্ছি সেটা অন্তত থাকতো না, কিন্তু শেষ অবধি তা হয় নি আর শেষে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে ছাড়লো ভদ্রলোকটি ।

কিন্তু আমি বলবো আমি কিছু করি নি । নির্দোষ আমি । এ অন্যায় কাজ করতে পারি না কখনো-ই ।  বরং আমার ব্যক্তিগত ধারণা - শব্দ স্বয়ং লুকোচুরি খেলাচ্ছলে আমাকে জব্দ করে পালিয়ে গেছে চিরকালের জন্যে, কিম্বা আমার অভিধানিক জীবন থেকে 'শব্দ' নামক যে সার্বজনীন প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত শব্দ, সেই শব্দটি কেউ এসে চুরি করে অন্তরালে লুকিয়ে রেখেছে অনন্তকালের জন্য । আমার সাথে শব্দের নিঃশব্দ নিষ্ঠুর লুকো-চুরি । এই চুরি হয়ে যাওয়া বা লুকিয়ে থাকা শব্দ কোনোদিন কি ফিরে আসবে আমার কাছে ? একদিন হয়তো দেখবো আমার মাথায় কে একজন চাঁটি মেরে দেবে আর চমকে ফিরে দেখবো পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সহাস্য শব্দ । সে আর সম্ভব নয় । এটি জীবনের প্রথম ও শেষ ধাপ্পা-না-দেওয়া ঠগবাজ । শব্দহীন চিরপ্রতারক ।  এক মারাত্মক ধাপ্পাবাজ । আমার সাথে এমন এক বিশ্বাসঘাতকতা করলো শব্দের লুকোচুরি সেটা একটু একটু করে উপলব্ধি করতে শুরু করি সেদিন থেকে ।

'মা' শব্দের মাধুর্য

বধিরতাজনিত কারণে বাইরের জগতের সাথে আমার যোগাযোগ কখনো শব্দনির্ভর হয়ে ওঠে নি । হওয়ার কথাও নয় । যোগাযোগ কেবল চারটি ইন্দ্রিযযোগে হয় যতটুকু সম্ভব আমার সীমিত ক্ষমতার মধ্যে । তার বাইরে না । মানুষের সংস্পর্শ বলতে আমি সবার আগে পেয়েছি আমার জন্মদাত্রীকে মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমে আর তার হাতে লালন-পালনে । সে মাঝে মাঝে আমার চোখে চোখ রেখে নিজের ঠোঁট নাড়িয়ে থাকতো আর আমার ঠোঁটে আঙ্গুল ছূঁয়ে মুখে হাসি আনতো । এতে তাকে ভারী সুন্দর দেখাতো নাহলে হয়তো আমি ঠোঁট ফাঁক করে খিল খিল করে হেসে উঠতাম না । এইভাবে দিনের পর দিন , মাসের পর মাস , বছরের পর বছর কাটতে থাকলো ।

কিন্তু তখনো জানতাম না শব্দজগতের প্রত্যেকটা জিনিসের একটা করে নিজস্ব নাম আছে যা শব্দ দিয়ে আমরা সাধারণ মানুষ চিনি বা জানি । এমনকি তখনো জানতাম না সামনের সুন্দরী মানুষটি আমার 'মা' বা জানা তো দূরের কথা , 'মা' বলে শব্দটার যে অস্তিত্ব আছে সেটা আমার ধারণায় ছিলো না । 

একদিন যখন আমার বয়স ৫ কি ৬ বছর তখন খেলাচ্ছলে মা তার বড় বড় চোখ ফেলে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো আর আমিও তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম চোখ বড় বড় করে । মা এবার তার ঠোঁটদুটি নাড়াতে শুরু করলো আস্তে আস্তে । আমি দেখলাম তার বন্ধ ঠোঁটদুটি বার বার ফাঁক করে কিছুক্ষণের জন্যে আবার চেপে ধরলো ঠোঁটদুটি পরস্পরের কাছে এনে । তা দেখাদেখি আমিও আপনা আপনি নিজের ঠোঁটদুটি ঠিক সেইভাবে নাড়িয়ে ফাঁক করতে শুরু করলাম আবার বন্ধ করলাম ।

এইভাবে কয়েকবার করার পরে দেখলাম মা হঠাৎ আমায় তার বুকে জড়িয়ে নিলো । আমি মায়ের বুকের গন্ধে বুঁদ হয়ে গেছিলাম এক অদ্ভূত ভালোলাগায় । সেদিন ছিলো আমার মুখ ফুটে বলা প্রথম একটা শব্দ এবং সশব্দে বলা 'মা' তাও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলা প্রথম 'মা' । জীবনের প্রথম মাধুর্যের স্পর্শ পাই 'মা' শব্দের মধ্যে কারণ যতবার মা বলি ততবার মা আমাকে জড়িয়ে ধরতো তার বুকে ।

বাকি শব্দগুলি শেখাও ছিলো সম্পূর্ণ 'মা'-নির্ভর । একেকটা শব্দ শিখতে লাগলাম মায়ের অপরিসীম ধৈর্যের সামনে আর জানতে পারলাম আমাদের চারপাশের জগতের পরিচিতি প্রাথমিক শব্দের ব্যবহারে । 

শব্দবিভ্রাটের চেনা অচেনা গণ্ডি 

একদিন অফিসমুখী গাড়ি ড্রাইভ করছিলাম । সায়েন্স সিটির কাছে ট্রাফিকজ্যামে কুড়িমিনিট যাবৎ আটকে ছিলাম আর অভ্যাসবশত আমার চোখ চলে গেছিলো ডানপাশের রাস্তা যার উপর দিয়ে গাড়িগুলো চলে উল্টোমুখে । হঠাৎ দেখলাম উল্টোমুখী রাস্তাটার ওইধারে একজনকে ঘিরে জনাকয়েক লোক দাঁড়িয়ে আছে আর লোকটি ইশারায় কথা বলার চেষ্টা করছিলো , ঘন ঘন মাথা নাড়ছিলো , সাথে হাতদুটি সমান তালে নাড়িয়ে যাচ্ছিলো । দেখে মনে হচ্ছিলো লোকটা রীতিমত অসহায় এবং ব্যক্তিটি একজন যে বধির ওনার এইরূপ আচরণ থেকে আমার অনুমান করতে একমিনিটও লাগে নি । ওনাকে ঘিরে ধরা দুই-তিনজনকে দেখলাম মাঝে মাঝে পেটে হাত রেখে হাসতে হাসতে এর ওর গায়ে পড়ছিলো ।
 
উল্লিখিত ঘটনাটির নিরিখে কেবল একটা কথা অন্তত আমার মনে খোঁচা মেরে দেয় - দুর্বোধ্য শব্দে কথা বলার চেষ্টা বা হাত নেড়ে কথা বলার মধ্যে যে একটা সূক্ষ্ম বিভাজনরেখা থাকে যা আমাদের মত বধিরদের আলাদা করে margin করে রাখে । এই marginalize করার ব্যাপারে আমার বিশেষ কিছু বলার নেই। আমার ৩১ বছরের এই জীবনে বেশ কয়েকবার marginalization এর লক্ষ্যবস্তু হয়ে এসেছি সেটা নিশ্চয় আলাদা করে বলার দরকার হবে না কারণ এটাই আজকের দুনিয়াতেও, আজকের যুগেও, আজকের প্রজন্মেও বহাল তবিয়তে চলছে ।


একটা ঘটনা বলি যেখানে আমার আর আমার স্কুলের খুব কাছের বন্ধুর মধ্যে নিম্নলিখিত কথোপকথন ছিল -

  বন্ধু - "এই সোম , কি রে ? কি খবর ?" (চোখ নাচিয়ে , ডান হাত উল্টে বার দুয়েক নাড়িয়ে )

  আমি - "ভালই আছি রে রাম (নাম পরিবর্তিত ) , তুই ?"

   বন্ধু - "বেশ আছি । আচ্ছা কাল তোর ছোটো পিসির সাথে দেখা হলো । .. দাঁড়া হিসি করে আসি , খুব পেয়েছে .." (তর্জনী তুলে আকাশের দিকে উঁচিয়ে 'কাল' বুঝিয়ে পিসি আর হিসি একসাথে এত দ্রুত গতিতে বলে ফেলেছিলো , শেষে কড়ে আঙুল তুললো )

  আমি (পুরো হতভম্ব হয়ে ) - "কি বললি পিসি হিসি করেছে ?" 

  বন্ধু (আমার শব্দের উচ্চারণ এমনিতে অত স্পষ্ট নয়, তাই সে কি বুঝলো কে জানে) মাথা কোনরকমে উপরে নিচে নাড়িয়ে হন হন করে হেঁটে চলে গেলো ।

  পাশের একজন বন্ধু আমাদের কথোপকথন ততক্ষণে সব শুনেছিলো কান পেতে আর ক্লাসের বাকি কয়েকজনকে ডেকে ঘোষণা করে দিলো - "সোমের পিসি হিসি করেছে ।" 

ব্যস্ শুরু হয়ে গেলো আমাকে নিয়ে চরম পর্যায়ের খিল্লি । পরে রাম ক্লাসে ঢুকে সব শুনে হেসে লুটোপুটি । তখনি ব্যাপারটা মিটমাট করিয়ে নেয় - পুরোটাই নাকি আমার শব্দ বোঝার সমস্যাজনিত কেলেঙ্কারি সেটা বলে ।

প্রসঙ্গতঃ ওই বন্ধুকে কোনো দোষ দেওয়া যায় না কারণ পেচ্ছাপ পেলে লোকে তার চারপাশটা বইয়ের মত উল্টে চাপা দিয়ে নিজেরটাকে ক্ষনিকের জন্যে উন্মুক্ত করে । এমনকি পার্কে বসে প্রেম করতে করতে একবার চমৎকার হিসি পেলে তো লোকে প্রেমের প-এর র-ফলা খুঁজে পায় না যা অতি জাগতিক । 

বাকি যারা খিল্লি করেছিল তাদের তো খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই, বসে বসে হাতের নখ খুঁটছিলো , খাতায় আঁকিবুঁকি আঁকছিলো । ভালো কিছু সিনেমা বা অ্যাকশন-থ্রিলার সিন না দেখলে ওদের সারাটা দিন যেন মাটি । যে কান পেতে সব শুনেছিলো তার সবাইকে খোঁচা মারার মারার বদঅভ্যাস ছিল এখন জানি না বদলে গেছে কিনা ।


গোটা ব্যাপারটার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলতে পারি যে আমরা মানুষ যতদিন না রেললাইন থেকে ট্রেন সরে যাওয়ার মত বা রাস্তায় চলা একটা মেয়ের শাড়ির আঁচল হঠাৎ বুক থেকে নেমে যাওয়ার মত আচমকা ঘটনা দেখছি বা খবর শুনছি ততদিন আমরা যেন নিজেদের খোলের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকি, আর যে মুহূর্তে অমুক ঘটবে সেই মুহূর্তে নিছক "শরীর আর মন চর্চা" করার জন্যে লেগে পড়ি । উপরন্তু লক্ষ্যবস্তু যদি প্রতি ২০-৫০ জনের থেকে সামান্য ( এমনকি অতি সামান্য ) আলাদা হয় তাহলে কে আর আটকাবে । এই "শরীর আর মন" চর্চার আরেক নাম marginalization যার মধ্যে কোনো sick-mindedness নেই , আছে শুধু সাময়িক আগুনের ফুলকি । এই মাপকাঠিতে বন্ধুত্বের কোনো সংজ্ঞা হয় না কারণ চর্চা থামলেই সবকিছু আবার আগের মত ।


কিন্তু বন্ধুমহলের বাইরে অচেনামহলে একই ঘটনা ঘটলে marginalization এর হৃদয়হীনতার দরজা খুলে যায় এবং নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা এবং শারীরিক নির্যাতন - একের পর এক প্রবিষ্ট হয় ।

  এই ক্ষেত্রে আমরা অনেকসময় ভাবি বা প্রশ্ন করি - এই marginalization এর নির্লজ্জ দিক থামাতে পারি কি ? 


তার আগে একটা ব্যাপার বলে রাখি সেটা হল আমরা নিজেরা যেমন marginalization এর শিকার হই, তেমন মেতে উঠি অন্য কারো হলে । সুতরাং এইরকম দুমুখো হয়ে আমরা যদি marginalization এর মুণ্ডুপাত করতে যাই সেটা আগাগোড়া বৃথা যাবে, আবার একটা মুণ্ডু কাটা পড়লেও নতুন আরেকটা মুণ্ডু গজিয়ে উঠবে, সেটা বলাই বাহুল্য । এটা চিরকাল চলবে । এমন কি আমরা কেউ marginalization-শূন্য দুনিয়া কল্পনা করি না , দুঃস্বপ্নেও না । কারণ marginalization একধরনের ছোয়াঁচে যা একতরফা কখনও হয় না । ঠিক একপ্রকার দেওয়া-নেওয়া । আমি করলে/হলে সেও করবে/হবে ।

আর হৃদয়হীনতার যে কথাটা আসছে সেটা marginalization এর অন্তিম পর্যায় । কয়েকমাস আগে আমরা জানলাম জনৈক ভদ্রলোক হুইলচেয়ারে বসে শব্দবাজি ফাটানোর প্রতিবাদ করতে গিয়েই নিজে শিকার হলেন । কি লাভ হল ? তাই আমার অন্তত মনে হয় নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা না করে চুপচাপ মুখ বুজে মেনে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ । শিকার হতে হতে শিকার করতে যাওয়ার একটা স্বাভাবিক রীতি চালু হয়ে আছে আমাদের সবার মধ্যে, এর কোনো হেরফের হবে না । এবং এটা বন্ধুদের মধ্যে করা/হওয়া সবচেয়ে নিরাপদ । 




প্রেমের শব্দহীন যাত্রা 

বইতে অনেক বড় ছোট লেখকের লেখা পড়ে জানতে পেরেছি যে প্রেমের কিছু কিছু শব্দ আছে । তবে সে শব্দ একমাত্রিক নয় । "খল খল করে হাসছে মেয়েটি" , "ফিক করে হেসে ফেললো অর্জুন" , "চিঠি পড়া শেষ করে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠে বিছানায় গড়াগড়ি খেলো সে" , "উঃ লাগছে । এই একটু আস্তে ... " , "আহা , বড় সুন্দর দেখতে লাগছে তোমায়", "ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আর বললো যে সে আর কোনোদিন... " ইত্যাদি ইত্যাদি বহুমাত্রিক শব্দ নিয়ে ন্যাকা প্রেমের অবাধ যাতায়াত দেখতে পাই আমাদের ভিতরে আর বাইরে । মাঝে মাঝে শব্দের 'শ'-এর মাথায় মাত্রা না থাকার মত হয়ে যায় মাতৃহীন প্রেম । তখন ন্যাকামিতে মোড়া নিজস্ব শব্দ বলে আর কিছু থাকে না প্রেমের , শুরু হয়ে যায় মা-কে হারানোর মত অসহায়তা, বিষাদমাখা বিষণ্নতা আর প্রায় পাগল-পাগল ছন্নছাড়া জীবনের নিঃশব্দ ছ্যাঁকা । সেইসময় শুরু হয়ে যায় এক অদ্ভূত মায়াজাল যা আপনাআপনি বুনতে থাকে কোনোরকম শব্দোচ্চারণ ছাড়া-ই । সেই নিরিখে দেখলে বস্তুতঃ বলা যেতে পারে প্রেমের একপিঠে যেমন আছে শব্দবহুল মাত্রা , অপরপিঠ দিয়ে তেমনি পোহানো হয় নিঃশব্দের শোকতাপে ।

কিন্তু আমার ব্যক্তিগত জীবনে যা প্রেম এসেছে বা আসে তার সবগুলো একমাত্রিক কিম্বা শূন্যমাত্রিক শব্দে হয়েছে বললে বুদ্ধিজীবীদের বিতর্কিত খোঁচা খাওয়ার ভয় অন্ততঃ থাকে না । নিঃশব্দের বাসিন্দা হয়ে আমার জীবনে আসা প্রেম আবার কী ধরনের হতে পারে তা নিয়ে বরং অনেকের অপার কৌতুহল থাকা-ই স্বাভাবিক । আমার বা আমার মত যারা আছে তাদের জীবনের খাতা খুঁজলে নিশ্চয়-ই খুঁজে পাওয়া যাবে কত না-জানা প্রেমকাহিনী । এটুকু-ই বলতে পারি যে পড়াশুনায় মেধাবী হওয়ার সুবাদে একাধিক প্রেমের প্রস্তাব এসেছে আমার ব্যক্তিগত জীবনে । কিন্তু প্রেমটা কেমন ছিল ? শব্দহীন না শব্দবহুল ? একমাত্রিক বা শূন্যমাত্রিক নাকি অন্য পাঁচটা স্বাভাবিক প্রেমের মত বহুমাত্রিক ? এইসব অবান্তর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বরং শুধু বলবো আমার জীবনের প্রথম ব্যর্থ প্রেম এবং তার সাথে জড়িত শব্দের অলংকারের কথা ।

তার আগে একটা কথা বলতে চাই প্রেম শুধু মানসিক নয় , শারীরিকভাবেও হয় । হতে পারে শারীরিক প্রেমের সেরকম শব্দ হয় না দু-একটা উঃ আঃ-ব্যঞ্জক শব্দ ছাড়া যেমন ঠোঁটে ঠোঁট রেখে গভীরচুম্বন এঁকে দেওয়া , গলায় কাঁধে বুকে নাক হালকা ঘষে ঘষে গরম গরম শ্বাস ফেলা , শরীরের বিভিন্ন গোপন অঙ্গে হাত রেখে উষ্ণ-নাতিশীতোষ্ণ প্রেম করার সময় কিসের আবার আওয়াজ করতে হয় তা আমার নিজের সত্যি কোনো ধারণা নেই বা জানার দরকার পড়েও নি কোনোদিন । এখানে সশব্দ প্রেমের চেয়ে শব্দহীন অথচ স্পর্শময় প্রেম অনেক বেশি তাৎপর্যবাহী । অন্ততঃ আমার কাছে ।

কিন্তু শরীরের আগে পড়ে মন যেটা না থাকলে প্রেমের ফুল ফোটে না । নাঃ রায়বাবুর ভাষায় ফট ফট শব্দে ফটাস করে নয় । এটি নিতান্ত ফালতু জিনিস নয় । এটা অত্যন্ত সিরিয়াস কেস । ফুল ফোটানোর জন্য লাগে নিয়মিত মনের পরোক্ষ চর্চা ।

যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকালীন একই ক্যাম্পাসে পড়া একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম একসময়ে, কিন্তু পাল্টাপ্রেম পাই নি মেয়েটির দিক থেকে । আমি একদিন একটা ছোটো কাগজে লিখেছিলাম মাত্র তিন লাইন -

'আমি তোমাকে ভালোবাসি ।

ইতি
সোম' 

পরদিন সেই মেয়েটির বাড়ির লেটারবক্সে ফেলে দিয়েছিলাম । আর দিনের পর দিন অপেক্ষা করে যাচ্ছিলাম কবে উত্তর আসবে সেই আশায় । কিন্তু সমস্ত আশা গুঁড়িযে দিলো স্বয়ং মেয়েটি । কিভাবে ? পাড়ার এক দিদির মাধ্যমে জানায় যে সে কিনা আমাকে দাদার মত দেখে । যাহ শালা ! নিঃশব্দ প্রেম নিবেদনের পরিবর্তে পেলাম 'দাদা'সুলভ প্রত্যাখ্যান । এই 'দাদা' নামক শব্দে আমার তখন ভীষণ আপত্তি ছিলো । রাগে দুঃখে ভেঙে পড়েছিলাম দাদাগিরির গুগলি খেয়ে । এমন সশব্দে কেঁদেছিলাম সেদিন বাথরুমে যে দেওয়ালে থাকা তিনটে টিকটিকি ঘাড় ঘুরিয়ে করুণ চোখে দেখছিলো আমাকে । ওরা আমার কান্নার শব্দের ঢেউয়ের ধাক্কায় হিমশিম খাচ্ছিলো আর আমি নিজেই নিজের কান্নার শব্দ শুনতে পাই না বলে যেন আরো সজোরে কাঁদতে থাকছিলাম । 

এইভাবে যে কতক্ষণ কান্নার শব্দের মধ্যে দিয়ে নিজের নৈঃশব্দ্য পাক খেয়ে খেয়ে উঠছিলো তা আমার জানা ছিলো না । কিন্তু সেদিন শুধু বুঝতে পারলাম জীবনের প্রথম প্রেমের ব্যর্থতা ।  সেই প্রেমে ছিলো না কোনো শব্দসুচক ঘাত-প্রতিঘাত । ছিলো একরাশ অভিমান । সাথে সাক্ষী ছিলো কেবল কান্নার শব্দ আর সেই শব্দে বিহ্বল টিকটিকির দল । যেন শব্দ করে করে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল বার বার, অথচ আমি কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না সান্ত্বনা । বলা ভালো যে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার সঠিক শব্দ আমার জানা ছিলো না । এইভাবে শুরু হয়েছিলো আমার নিঃশব্দ প্রেমের প্রথম যাত্রা । সফরসঙ্গী নিজের অশ্রুত কান্নার শব্দ । 

শব্দছকের সাদাকালো ঘুঁটি

চার্লি চ্যাপলিন অভিনীত জনপ্রিয় ট্রাম্পচরিত্র আমার অতিপ্রিয় । সবার যেমন হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায় , আমারও তাই হয় ওই সাদাকালো নির্বাক ছবির সিরিজ দেখতে দেখতে । অমন একজন যদি কোনোরকম শব্দসৃষ্টি ছাড়া নিঃশব্দে হাসিবৃষ্টি ছড়াতে ওস্তাদ হয় , তার মত ভবঘুরে হয়ে সবার হৃদমাঝারে মণিমানিক্য হয়ে থাকার স্বপ্ন দেখা আমার পক্ষে অস্বাভাবিক ছিলো না । কিন্তু আমি বা অন্যকেউ তার জায়গা কেড়ে নিতে পারবে না বাস্তবে । এমনকি আমি সাইলেন্স-এর লাইসেন্সধারী হলেও সম্ভব নয় । তবুও মাঝে সাঝে আমি সেজে থাকি কথা-না-বলা একটা পুতুল । নিজের অজান্তে । বুঝতে পারি না আমি নিজে-ই একটা জলজ্যান্ত কেতাদুরস্ত পুতুল যে মুখে সবসময় হাসির দ্যুতি ছড়ায় সময়ে-অসময়ে-দুঃসময়ে , চোখের মণি ঘোরায় চরকির মত , মাথামুণ্ডু-বোঝে-না এমন মুণ্ডু নাড়ায় যখন তখন । শুধু বুঝতে পারি সবার হাসির পাত্র হয়ে যাই । এতে আমার মন সাদা আর কালো দুই খণ্ডে খণ্ডিত হয়ে থাকে দিনের শেষে ।

সাদা পর্দা সরিয়ে দেখতে পাই চোখের সামনে ধূ ধু কালো বালি । কখনো বা কালো চাদরের আড়ালে লুকিয়ে থাকে আমার সাদা কঙ্কাল । হয়তো জীবনের সাদা পাতলা ঠোঁটে অচেনা কেউ এসে এঁকে দিয়ে যায় মনখারাপের কালো রঙ । সময়ের কালচে নদী বয়ে নিয়ে যায় পুরোনো সাদাটে অ্যালবাম । তার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেয় ছেঁড়া কাঁটা সাদাকালো অভিমানী স্টিকার । স্টিকারে আমার দ্বিমাত্রিক নির্বাক সাদাকালো ছবি অথচ এই ছবি কিছু একটা বলতে চায় । একটা না অসংখ্য অক্ষরপোকা কিলবিল করতে চায় একটা খোলসের মধ্যে যা একটা বিস্ফোরক । একদিন না একদিন ফেটে যাবে দারুণ দারুণ একটা শব্দে । সজোরে ফাটবে । ফেটে চুরমার হয়ে যাবে আমার ভিতরখানি । ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে কতকগুলো টুকরো । প্রতিটা টুকরো আমার বলা শব্দটুকরো ।  

স্কুলের ক্লাসে কালো ব্ল্যাকবোর্ডে সাদা চক দিয়ে যেসব লেখা হয় সেগুলো দিয়ে আমার পড়া তৈরী হয় । স্কুলটিচারের মুখে আওড়ানো সব শব্দ আমার বধির কানের পর্দায় ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতো । খাতায় লিখে রাখতাম বোর্ডের গায়ে লেখা সীমিত শব্দগুলো আর চোখ মাঝে মাঝে বোর্ড থেকে সরে গিয়ে পড়তো দূরের পৃথিবীতে । আমার খাতায় লেখা শব্দগুলি যেন জীবন্ত হয়ে উঠতো , অবাক হয়ে দেখতাম শব্দরা সারি বেঁধে পায়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতো । ঠিক যেন সৈনিকের মত । একেকরূপ একেকজনের । খাতা থেকে বেঞ্চিতে , বেঞ্চি থেকে বেঞ্চির পা বেয়ে মেঝেতে , মেঝের উপর দিয়ে হেঁটে দেওয়ালের পা , পায়ে উঠে দেওয়ালের গা বেয়ে জানালার কোলে উঠে পড়তো । শব্দসৈনিকের যে সারি কোলে প্রথম পড়তো সেই সারির মুখগুলো একেক করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতো আমাকে আর হাত তুলে নাড়াতো । তারপর লাফ মেরে অদৃশ্য হয়ে যেতো এইভাবে একটার পর একটা শব্দের মালা । দূরের সেই পৃথিবীতে হয়তো এরা বিচরণ করে এই ভাবতে ভাবতে কখন আনমনা হয়ে যেতাম শেষে আমার কানের লতিতে পড়তো একটা রামটোকা । সম্বিৎ ফিরে ঘুরে দেখতাম রক্তবর্ণ চোখ পাকিয়ে স্কুলটিচারের ঠোঁটদুটি ক্রমাগত নাড়িয়ে যেতো । সাথে থু থু ছিটকে বেরিয়ে আমার মুখে গালে কপালে পড়তো । অনেক সহ্য করে তার দিকে তাকিয়ে হজম করতাম ওই অসহ্য ঠোঁটনাড়া । তার বকুনির কিছু বোধগম্য-ই হতো না আমার , শুধু বুঝতে পারতাম আমার ওই দূরের পৃথিবী আসলে সাদাকালো-ই । 

শব্দছক নামে ধাঁধালো এই নিঃশব্দ জীবনে দাঁড়িয়ে আমি চোখের সামনে যা দেখি , যা অনুভব করি , যা শুঁকি , যা জিভে এসে ঠেকে - তার সবগুলো নিজেদের মধ্যে দাবার সাদা-কালো ঘুঁটি সাজিয়ে রাখে আর নিজ নিজ গুণে যুদ্ধ করতো । কেউ হারতো না , কেউ কাউকে হারাতো না । এক অবিরত যুদ্ধ । যা আমাকে নিয়ে যায় এক অজানা গন্তব্যে যেখানে হয়তো শুনতে পাবো FM Radio-তে বেজে ওঠা প্রিয় গানটির সুর । 

কিন্তু , জানি না গানটি কি ?

No comments:

Post a Comment