29 Apr 2014

শব্দের বানান


কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী
________________________________
পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ভাষা বাংলাভাষা কী সেই দূর্ভাগ্য নিয়ে এসেছে যে কেউ চাইলেই শব্দের বানান নিজের অভিরুচি অনুযায়ী পরিবর্তন করে নিতে পারে আর সেই স্বেচ্ছাচারী পরিবর্তনে কী শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয়ে যায় না ? আর কোনো ভাষা কী এইরূপ স্বেচ্ছাচারিতার অত্যাচার সহ্য করে ? আপাত দৃষ্টিতে মনে হতেই পারে, ই-কারের পরিবর্তে ঈ-কার আর উ-কারের পরিবর্তে ঊ-কার লিখলে কী আর ক্ষতি ! বাড়ীকে "বাড়ি" বললে কী থাকার জায়গা ছোট হয়ে যাবে? তাহলে বানান নিয়ে এত সংবেদনশীলতার অর্থ কী ? হ্যাঁ অর্থ আছে, অনেক অর্থ আছে যা অমান্য করলে অনেক অনর্থই ঘটে যেতে থাকে অগোচরে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় এই অনর্থ খুব ভালো করেই টের পেয়েছিলেন আর তাই উদ্যোগ নিয়েছিলেন বানান সমস্যার সমাধানের, প্রস্তাব করেছিলেন বানানের নিয়ম আবিস্কার করতে। কিন্তু বানানের সেই নিয়ম তখন আবিস্কার করা সম্ভব হয় নি। সেই সমস্যার সমাধানকল্পে এগিয়ে এসেছেন বাংলার দুই সাম্প্রতিক মনীষা -- কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী যারা উদ্ভাবন করেছেন সেই নিয়ম যা মেনে বাংলা বানানের নৈরাজ্য দূর হবে। নিচে পড়ুন কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর সর্বশেষ লেখা যা বাংলাভাষার জন্য এক যুগান্তকারী আবিস্কার।
বাংলাভাষার বানান-সমস্যা সমাধানের পথ (১ম খসড়া)
রবি চক্রবর্তী কলিম খান


বাংলাভাষার বানানে ব্যাপক নৈরাজ্য দেখে রবীন্দ্রনাথ তা দূর করার কথা ভাবেন ১৯৩৫ সালে । নিজেই তা দূর করবেন, এমন সময় বা উপায় নিশ্চয় তাঁর হাতে ছিল না । তাই তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস-চ্যান্সেলর শ্রীযুক্ত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন । সেই উদ্যোগের ফলস্বরূপ একটি সমিতি গঠিত হয় । বানানে নৈরাজ্য দূর করে নিয়মের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, ‘বাংলাভাষাকে বাংলাভাষা বলে স্বীকার করে তার স্বভাবসঙ্গত নিয়মগুলি উদ্ভাবন’ করা হোক ।(১) সেই সমিতি কিন্তু সেই নিয়ম ‘উদ্ভাবন’ বা আবিষ্কার করতে পারেননি । না করেই নানারকম বিধান দিয়ে তথাকথিত ‘বানান সংস্কার’-এর কাজ শুরু করে দেন । ফলে, বাংলা বানান নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায় তখন থেকেই, যা আজও সমানে চলছে এবং যত দিন যাচ্ছে বিধানের সংখ্যা ততই বেড়ে চলেছে । এদিকে শব্দার্থসন্ধান করতে গিয়ে আমাদের দুজনের সামনে বাংলাভাষার অন্তর্নিহিত নিয়ম ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’-এর মতো বেরিয়ে পড়ে ।(২) তাকে শব্দার্থের নিয়ম ভেবে পরখ করতে গিয়ে আমরা দেখি, বাংলা শব্দের বানান কীরকম থাকলে শব্দটির মাধ্যমে প্রকাশিতব্য অর্থ ঠিক থাকে, এ হল তারও নিয়ম । সেই নিয়মই যে বাংলা শব্দের বানানের রীতিনীতি নির্ধারণ করে, সে বিষয়ে আমরা ক্রমে নিঃসন্দেহ হই । বর্তমান প্রসঙ্গে সেই নিয়মটিকে সূত্রবদ্ধ করা দরকার । কিন্তু তার আগে সংস্কৃতভাষা ও বাংলাভাষার স্বরূপ ও সম্পর্কটি বুঝে নেওয়া জরুরী ।

‘সংস্কৃতভাষা’ শব্দটিই আমাদের বলে দেয়, সে এমন একটি ভাষা যাকে সংস্কার করে বানানো হয়েছে । রান্নার আগে গিন্নী-মায়েরা যেমন রান্নার নিমিত্ত প্রাপ্ত উপকরণগুলিকে বেছে সাফসুফ করে কেটে কুচিয়ে ধোয়াধুয়ি করার মাধ্যমে সংস্কার করে নিয়ে তবেই রান্না চড়িয়ে ব্যঞ্জন প্রস্তুত করেন, তেমনি নিশ্চয় নানা প্রকার প্রাপ্ত ভাষিক উপকরণকে সংস্কার করেই সংস্কৃতভাষা বানানো হয়েছিল । প্রশ্ন হল, সেই ভাষিক উপকরণগুলি কী ? সংস্কৃতকারগণ সেগুলি কোথা থেকে পেয়েছিলেন ?
ভাষিক উপকরণগুলি হল, শব্দসম্ভার (vocabulary) এবং শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়ম ; যে দুটি নিয়মকে যথাক্রমে শব্দের ভিতরে অর্থ নিষেক ও নিষ্কাশনের (‘semantic’) ও শব্দের পাশে শব্দ গাঁথবার (‘syntactic’) নিয়ম বলে মনে করা হয় । সেগুলি তাঁরা সংগ্রহ করেছিলেন তাঁদের চারপাশে প্রচলিত তৎকালের স্বাভাবিক (natural) ভাষাগুলি থেকে ; সংস্কৃতভাষা বানিয়ে ফেলার আগে তাঁরা নিজেরাও যে ভাষাগুলিতে কথাবার্তা বলতেন ।(৩) কিন্তু কথা হল, কীভাবে তাঁরা তাঁদের সেই প্রাপ্ত ভাষিক উপকরণগুলিকে সংস্কার করে সংস্কৃত ভাষা বানিয়েছিলেন ?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা যতদূর জেনেছি ও বুঝেছি তা হল, প্রতিটি স্বাভাবিক (natural) ভাষার হাতে তার নিজস্ব শব্দসম্ভার যেমন থাকে, সেই শব্দসম্ভারের সাহায্যে বাক্য গঠন করে মনোভাব লেনদেনের কাজ চালানোর জন্য তার স্বাভাবিক নিয়ম (natural law) দুটিও (শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়ম দুটিও) অবশ্যই থাকে ; কিন্তু থাকে অব্যক্তভাবে (tacitly) । সংস্কৃতকারগণ সেই অব্যক্ত (tacit) নিয়ম দুটিকে সূত্রবদ্ধ ও সুবিন্যস্ত করে ব্যক্ত (explicit) করে নিয়েছিলেন এবং তার সাহায্যে ঐ শব্দসম্ভারের প্রতিটি শব্দকে (প্রত্যেকটি শব্দের মাতৃকাবর্ণ, ক্রিয়ামূল, ক্রিয়া-পরিবার ইত্যাদি নির্ণয়পূর্বক বিন্যাস ও পরিমার্জন-শোধন করে) সংস্কার করে নিয়ে মনোভাব লেনদেনের কাজে বা বাক্যে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেছিলেন । আমাদের অনুসন্ধানলব্ধ বোধ অনুসারে (৫০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দের বেশ কয়েক শতাব্দী পূর্বেই) তৎকালের প্রচলিত ভাষাপ্রবাহগুলি থেকে উপাদান সংগ্রহ করে উপরোক্ত ব্যক্ত (explicit) শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়মে সংস্কার করে, জ্ঞানচর্চ্চার ও সমাজশাসনের ভাষা রূপে ব্যবহারের জন্য যে মানভাষা (standard language) বানানো হয়েছিল, সেটিই সংস্কৃত ভাষা । সেকারণে সংস্কৃতভাষা বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম ভাষাই বটে । স্বভাবতই ভাষাটির নিজস্ব বাহক স্বরূপ কোনো স্বাভাবিক (natural) জাতি ছিল না, যেমন অনাদিকাল থেকে বাংলাভাষাকে বহন করে নিয়ে চলেছে বাঙালী জাতি, কিংবা ইংরেজিকে বহন করে নিয়ে চলেছে ইংরেজ জাতি, সেরকম । তার মানে, নিজ ভাষা নিয়ে আবর্ত্তমান কোনো একটি জাতি আদিম কাল থেকে প্রজন্মক্রমে সংস্কৃতভাষা বহন করে স্বভাবত আবর্ত্তমান ছিল না, নেই । তবে সেকালের জ্ঞানচর্চ্চাকারী পণ্ডিত ও সমাজশাসকেরা এই ভাষা বহন ও ব্যবহার করতেন । তাছাড়া সেকালের ‘চারপাশের ভাষাগুলি’ থেকে উপাদান নিয়ে সংস্কার করে বানানো হয়েছিল বলে আশপাশের ভাষাভাষী জ্ঞানীগুণী ও ক্ষমতাবান মানুষেরা এই মানভাষা স্বরূপ সংস্কৃতভাষায় কথাবার্তা বলতে ও বুঝতে পারতেন । সেকারণেই প্রাচ্যের জাতিগুলির জ্ঞানতাত্ত্বিক অর্জনের অধিকাংশ মানসসম্পদ এই ভাষাতেই লিপিবদ্ধ পাওয়া যায় । সর্বোপরি, বিশ্বের সমস্ত ভাষার তুলনায় সংস্কৃত ভাষার মহত্তম গৌরব ঠিক এইখানে যে, ভাষাটিকে মানবভাষায় বিধৃত প্রকৃতির নিয়ম (natural law in human language) স্বরূপ শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক ব্যক্ত (explicit) নিয়ম দ্বারা সংস্কার করে নির্মাণ করে নেওয়া হয়েছিল । (সেকারণেই, এমনকি একালের কমপিউটার প্রযুক্তির বিচারেও সংস্কৃতই সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত ভাষা) । পরবর্তীকালে ঐ শব্দার্থতাত্ত্বিক নিয়মই যাস্কের নিরুক্তে এবং ঐ বৈয়াকরণিক নিয়মই পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে ।
এখন কথা হল, ঐ সংস্কৃতভাষা যখন বানানো হয়েছিল, তখন আমাদের বঙ্গবাসী-বঙ্গভাষীদের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা নিশ্চয় পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন, তাঁরা নিশ্চয় বোবা ছিলেন না । আর, তাঁরা যে ভাষাতেই কথা বলুন, সেটি নিশ্চয় আমাদের বর্তমান বাংলাভাষারই প্রাচীন রূপ, তা আপনি তাকে প্রাচীন প্রাকৃত, প্রাকৃত-অপভ্রংশ, প্রাকৃত বাঙ্গালা ইত্যাদি যে নামেই শনাক্ত করুন ।(৪) কেননা, আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের সেই প্রাচীন বাংলাই তো প্রজন্মক্রমে প্রবাহিত ও বিবর্তিত হয়ে এসে একালের বাংলাভাষায় পরিণত হয়েছে । তা আমাদের সেই প্রাচীন বাংলা থেকে সংস্কৃতকারগণ শব্দসম্ভার ও ভাষার নিয়মাদি নিয়েছিলেন কি ?

হ্যাঁ, নিয়েছিলেন এবং ব্যাপকভাবে নিয়েছিলেন । নিয়েছিলেন বলেই একালের ভাষাবিদ দেখতে পান যে, বাংলাভাষার ৯০ শতাংশ শব্দই সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে কমবেশি মেলে ।(৫) নিয়েছিলেন বলেই আমরা আজ বাংলাভাষার ভিতরে যে শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়মকে সক্রিয় দেখি, সংস্কৃতের শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়মের সঙ্গে তা প্রায় হুবহু মিলে যায় । তার মানে, বাংলাভাষা হল আদিম কাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে আসা এমন একটি স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক (natural) ভাষা, যার প্রাচীন রূপের নিকট সংস্কৃতভাষা যথেষ্ট পরিমাণে ঋণী । তবে সেই ঋণ পরবর্তীকালে (মধ্যযুগে) বাংলাভাষা সুদসহ ফেরত নিয়ে নিয়েছে । নিয়েছে বলেই স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক (natural) ভাষা হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তীকালের বাংলাভাষার শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়ম অন্যান্য স্বাভাবিক ভাষার মতো প্রধানত অব্যক্ত (tacit) হলেও যথেষ্ট পরিমাণে ব্যক্তও (explicit-ও) বটে । ব্যাপারটি কীরকম ?
ধরা যাক, আপনার নিজের ক্ষেতের ধান কড়াই শাকসব্জি ইত্যাদি একত্রে পাক করে সপরিবারে খিচুড়ী খেয়েই আপনি দিন কাটান । আপনার প্রতিবেশী এরকম আরও কয়েকজন আছেন । একদিন কয়েকজন সরকারী কর্ম্মী এসে আপনাদের মাঝে বসবাস করতে লাগলেন এবং আপনাদের সকলের কাছ থেকে চাল ডাল শাকসব্জি নিয়ে রান্না করে খেয়ে দিনাতিপাত করতে লাগলেন । ক্রমে জানা গেল, তাঁরা আপনাদের মতো খিচুড়ী খান না, আপনাদের দেওয়া চাল ডাল শাকসব্জি ইত্যাদি দিয়ে তাঁরা পঞ্চব্যঞ্জন রান্না করে খেয়ে থাকেন । তাঁদের ভাত ডাল সুক্তো ঘণ্ট ঝাল ঝোল অম্বল সবই আলাদা আলাদা এবং তাদের একের পর এক সুবিন্যস্তভাবে সাজিয়ে যথানিয়মে ভোজন করা হয় । রান্নাবান্না, পরিবেশন ও ভোজনের পুরো কর্মকাণ্ডটাই আপনি দেখলেন, দেখেশুনে চেখে খেয়ে শিখেও গেলেন এবং সপরিবারে সেভাবেই সেই রান্নাবান্না করে আপনার পরিবারের ভোজনব্যবস্থা চালাতে লাগলেন । এরকম করলে যা হয়, বাংলাভাষার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে । সংস্কৃতভাষার নিজস্ব মাটি ছিল না, সেকারণে নিজস্ব ফসলও ছিল না । বাংলার মাটি থেকে জাত শব্দসম্ভার এবং শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক (‘বাংলাভাষার স্বভাবসঙ্গত’) নিয়মগুলি গ্রহণ করে সেগুলিকে সংস্কার করে সংস্কৃতভাষা এক নিয়মবদ্ধ সুবিন্যস্ত ভাষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল । মধ্যযুগের বাংলাভাষা তাকে আত্মসাৎ করে সংস্কৃতভাষার থেকেও সম্পদশালী হয়ে যায় । একে তো তার নিজের মাটি, নিজের স্বাভাবিক উৎপাদন, নিজের অব্যক্ত প্রযুক্তি ; এবার তার সঙ্গে জুড়ে যায় সংস্কার-কৃত ব্যক্ত প্রযুক্তি, উভয়ের সাহায্যে নিজের জ্ঞানতাত্ত্বিক অর্জন - মধ্যযুগের বাংলা রামায়ণ মহাভারত মঙ্গলকাব্য নব্যন্যায় এবং হিন্দু-মুসলিম পদকর্তাদের সৃষ্ট ও বঙ্গসমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত পদাবলী কীর্তন … ইত্যাদিতে বিধৃত বাংলাভাষাকে দেখা যাচ্ছে, সে তার নিজস্ব ‘স্বভাবসঙ্গত নিয়মগুলি’ ব্যক্তরূপে অনুসরণ করে নিজের বিপুল বিকাশ সাধনে সমর্থ হয়েছে, অজস্র নতুন শব্দ সৃষ্টি করেছে ও বিপুল মানসসম্পদ অর্জন করেছে । (যে বর্ণগুলিতে তেমন কিছু শব্দসম্ভার সংস্কৃতের ছিল না, সেই ছ, ঝ, ঠ, ড, ঢ, থ প্রভৃতি বর্ণে উপরোক্ত ব্যক্ত প্রযুক্তির সাহায্যে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে বিপুল শব্দসম্ভার মধ্যযুগের বাংলাভাষা নিজেই সৃষ্টি করে নিয়েছে । শব্দের সূচনায় থ বর্ণ আছে, এমন কোনো সংস্কৃত শব্দই ছিল না, আর ঠ বর্ণে মাত্র একটি শব্দ ছিল ‘ঠক্কুর’।)
বঙ্গদেশে ব্রিটিশ শাসন বাংলাভাষাকে তার স্বকীয়তা ত্যাগে প্ররোচিত করলেও ১৯৩৫ সালের আগে পর্যন্ত বাংলাভাষার বিকাশ রোধ করা যায়নি । বাংলাভাষীর জ্ঞানচর্চার জগতে সে রাজার মতোই বিরাজ করেছে । কার্যত স্বাধীনতা লাভের পর দিন থেকেই বাংলাভাষার দুর্দিনের সূচনা হয় । অ্যাকাডেমিতে বাংলার শিক্ষকেরা নিষ্প্রভ হয়ে যান । বাংলাভাষাকে তার স্বভাব ত্যাগ করে ইংরেজী ভাষার মতো বানিয়ে ফেলার অ্যাকাডেমিক চক্রান্ত শুরু হয়, যার ফলে বাংলাভাষীগণ তাঁদের অতীত থেকে বিচ্যুত হতে থাকেন । ফলত, বাঙালী জাতি তার স্বভাববশত যে ভাষায় তার মানসিক শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে প্রাণবন্ত থাকত, সেই ভাষা পরিত্যক্ত হতে থাকে, ইংরেজী ভাষার দ্বারা দূষিত হতে থাকে । বাঙালীর একালের অ্যাকাডেমিগুলির সেই চক্রান্ত বর্তমানে এমন চরমে পৌঁছেছে যে সাধারণ বাংলাভাষী জনসাধারণ সাংস্কৃতিক শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করেছেন ।
এখানে আমরা দেখলাম, বাংলাভাষা নিজে একটি স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক (natural) ভাষা । সংস্কৃতভাষা সৃষ্টির আগে থেকেই সে জন্মলাভ করে প্রবাহিত হয়ে আজ পর্যন্ত এসেছে । তার ভিতরের অব্যক্ত (tacit) শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়মগুলি ব্যক্ত (explicit) ভাবেও তার হাতে রয়েছে, যদিও খানিকটা ধামাচাপা পড়ে । সেগুলির মধ্যে শব্দার্থতাত্ত্বিক নিয়মগুলিকে সম্প্রতি আমরা পুনরুদ্ধার করে একালীকরণ করেছি । সেই নিয়মই বানান সমস্যা সমাধানের কাজে লাগবে । এবার তবে সেই নিয়মকে সূত্রবদ্ধ করে নেওয়ার চেষ্টা করা যাক ।

বাংলা শব্দের বানান যেমন থাকলে শব্দটির মাধ্যমে প্রকাশিতব্য অর্থ ও উচ্চারণ ঠিক থাকে, বাংলা শব্দের বানানের সেই নীতি নির্ধারণ করে যে-নিয়ম, সেই নিয়মটিকে সূত্রবদ্ধ করলে তা এইরকম দাঁড়ায় :-

"যে বর্ণ বা বর্ণসমবায় দিয়ে কোনো শব্দ (গঠিত) লিখিত হয়, সেই বর্ণের বা বর্ণসমবায়ের অর্থ ও শব্দটির অভিধার্থ অভিন্ন হয়" (উদ্ধৃতি চিহ্ন লেখকদ্বয়ের) ।
এই নিয়ম অনুসরণ করে বাংলা শব্দের বানান লিখতে হবে । তাহলেই বাংলাভাষার বানানে নৈরাজ্য থাকবে না ।
যেমন, ‘তীর’ শব্দের অভিধার্থ হল কূল (নদীর পাড়) । তার সঙ্গে 'ত্ ী র্ অ' এই বর্ণগুলির অর্থের যোগফল এক হতে হবে । যদি হয়, তাহলে শব্দটি 'ত্ ী র্ অ' বা তীর বানানেই লিখতে হবে । আপনি বলবেন, তাহলে তো বর্ণমালার ৪৩টি বর্ণেরই অর্থ জানতে হবে । হ্যাঁ, জানতে হবে । জানতে হবে মাত্র ৪৩টি বর্ণের মানে । এবং শুধু জানলেই হবে না, তার ব্যবহারেও দক্ষ হতে হবে । আমরা সেই ৪৩টি অর্থ নিম্নে লিপিবদ্ধ করছি এবং তার প্রয়োগ বিষয়ে দিশানির্দেশ দেওয়ার চেষ্টা করছি । মনে রাখা দরকার, উপরোক্ত এই ‘বানান সংস্কার সূত্র’–এর সাহায্যে কোনো বাংলা শব্দের সংস্কার করে শব্দটি লিখলে সেটিকে সংস্কার-কৃত বাংলা শব্দ বা সংস্কৃত-বাংলা শব্দ বলা চলে । একেই সেকালের শব্দবিদগণ ব্যুৎপত্তিগত অর্থসম্পন্ন সংস্কৃত শব্দ নামে শনাক্ত করতেন । আমরা দুজন তাকেই ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি মান্যকারী শব্দ নামে চিহ্ণিত করেছি । করেছি এইজন্য যে, কোনো শব্দের ক্রিয়ামূল বোঝা যাক আর নাই যাক, তার বর্ণ ধরে নির্ব্বচন করলেই শব্দটির অর্থ নিষ্কাশন করা সম্ভব । এ নির্দেশ যাস্কের নিরুক্তেই রয়েছে । তা সে যাই হোক, ‘বানান সংস্কার সূত্র’ নামক এই নিয়মের ক্ষেত্রে এমন কয়েকটি শব্দার্থতাত্ত্বিক সত্য মেনে নিতে হয়, যেগুলিকে একালের অ্যাকাডেমিতে প্রচলিত পাশ্চাত্যের ভাষাতত্ত্ব সম্যকভাবে জানে না । আমরা দেখছি যে, লিপি, শব্দ, পদ, অর্থ, ধ্বনি, বর্ণ, ও বানান বলতে বাংলায় যা বোঝায় ও বোঝানো হয়, পাশ্চাত্যের ভাষাতত্ত্বে যথাক্রমে script, word, part of speech, meaning, phoneme, letter ও spelling বললে ঠিক তা বোঝায় না । কী বোঝায়, সে প্রসঙ্গেই আমরা যাব । কেননা, ঐ বিষয়গুলিতে বাংলা ও ইংরেজীর বোধের পার্থক্যের বিষয়ে ঠিকঠাক জানা না থাকলে উপরোক্ত সূত্রটিকে ভুল বুঝবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে । এই তুলনামূলক আলোচনায় প্রতিটি বিচার্য বাংলা শব্দের ক্রিযাভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ শুরুতেই বন্ধনীর মধ্যে দিয়ে তার পরে আমরা আলোচনায় এগোব । সর্বদা মনে রাখতে হবে, আমরা ভাষার লিখিত রূপ নিয়ে কথাবার্তা বলছি ।
লিপি :
(‘লিপ বা কালি লেপন করা সক্রিয় যাহাতে বা যে সক্রিয়তায়’, অথবা, ‘কালি দিয়ে লিপে বা লিখে যা করা হয়’) । প্রাচীন কাল থেকে মানুষ তো অর্থপূর্ণ শব্দ গেঁথে বাক্য বানিয়ে কথাবার্তা বলে আসছিল । তাতে কোনোরকম বানান সমস্যা দেখা দেয়নি । সমস্যা দেখা দেয় সেই বার্তাকে লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে । লোকে যখন কোনো শব্দ বলে, তা সে ‘পদ’ বলুক আর ‘leg’ বলুক, শ্রোতা কেবল একপ্রকার আওয়াজই (উচ্চারণই) শোনে না, তার অর্থটাও বুঝতে পারে । তার মানে, মানুষের ভাষার শব্দ মাত্রেই একটি দ্বৈতাদ্বৈত (two in one) সত্তা । সমস্যা দেখা দিল, সেই দ্বৈতাদ্বৈত সত্তাকে লিপিতে বদলে নিতে গিয়ে । একটি মানুষের দুটো পায়ের মতো লিপির প্রতিটি এককের (বর্ণের, বানানের) আওয়াজ ও অর্থ এই দুই পা-কে লিপিতে ধরে রাখা যাবে কীভাবে ? নিজ নিজ ভাষার শব্দকে লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে আদিম মানবজাতিগুলি এই সমস্যায় পড়েছিল । আমাদের অনুসন্ধান জানায়, এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে প্রাচীন মানবজাতির ভাষাগুলি প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত হয়ে যায় । ইংরেজী প্রভৃতি পাশ্চাত্যের ভাষাগোষ্ঠীগুলি যে লিপিতে লিখতে শুরু করে, তা আওয়াজ (উচ্চারণ) ধরে রাখতে সক্ষম হয়, কিন্তু অর্থ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় । লিখিত শব্দের অর্থটিকে তাঁদের বুঝে নিতে হয় আরোপিত প্রথারূপে, যার সঙ্গে লিপিবাহিত উচ্চারণের নাকি সম্পর্ক নাই । ফলত আজও লিখিত ইংরেজী ভাষাকে কাজ চালাতে হয় এমন একরকম খঞ্জ লিপি নিয়ে, যার একটি পা আস্ত থাকলেও অন্য পা-টি নেই, তার বদলে আছে বৈশাখী (ক্রাচ) । এই ধরনের নানান লিপিকে পাশ্চাত্যের ভাষাবিদগণ সংজ্ঞায়িত করেন phonetic script ব’লে । চীনাগোষ্ঠীর ভাষাগুলি আবার এমন লিপিতে লিখতে শুরু করে, যা অর্থ (idea) ধরে রাখতে সমর্থ হয়, কিন্তু আওয়াজ ধরে রাখতে পারে না । ফল হয় এই যে, চীনের এক প্রদেশের মানুষ অন্য কোনো প্রদেশের মানুষকে চিঠিপত্র লিখে পাঠালে, পত্রপ্রাপক বার্তাটি বুঝে নিতে পারে বটে; কিন্তু পত্রপ্রেরক যদি তার চিঠিতে লেখা সেই বাক্যগুলি উচ্চারণ করে প্রাপককে বলতে শুরু করে, সে তার কিছুই বুঝতে পারে না । প্রাপক উচ্চারণ করে চিঠিটি পড়লে প্রেরকেরও একই দশা হয় । তার মানে, চিঠির লিপি অর্থ বহন করে নিয়ে যেতে সক্ষম, কিন্তু আওয়াজ বহন করে না । সেই কারণে চীনা লিপিকে ideographic script ব’লে চিহ্ণিত করা হয়েছে । তার মানে, ইংরেজী প্রভৃতি লিপিগুলির যদি বাঁ পা খোঁড়া হয়, তো চীনা লিপির ডান পা খোঁড়া । এদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃত বাংলা প্রভৃতি ভাষাগুলি যে লিপির ব্যবহার শুরু করে, তা একই সঙ্গে শব্দের আওয়াজ ও অর্থকে ধরে রাখতে সমর্থ হয় । হয় বলেই লিখিত ‘পদ’ যেমন আমরা উচ্চারণ করতে পারি, তেমনি তার ভিতরের ‘পালন দান করে যে’ অর্থটিও বুঝতে পারি । সেই অর্থকেই ‘পদ’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বা ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ বলে । তদ্রূপ অর্থ ধারণ করে বলেই শব্দটি পদাঘাতের পদ, পদাধিকারীর পদ, পদোন্নতির পদ, পদচ্যুতির পদ, গানের পদ, ভোজনের পদ, বাক্যের পদ, ধর্মের পদ … ইত্যাদি যে কোনো প্রকার পদকে বোঝাতে পারে । তবে তার কোন অর্থটি বোঝা হবে, তা ঠিক হয়, বাক্যের প্রেক্ষাপট অনুসারে । সুতরাং, বাংলাভাষায় যখন আপনি কোনো শব্দকে লিপিবদ্ধ করতে যাচ্ছেন, আপনাকে মনে রাখতে হবে, আপনি শব্দটির আওয়াজ ও অর্থ দুটিকেই লিখছেন । কেননা, আমাদের লিপির দ্বৈতাদ্বৈত (two in one) চরিত্র কমবেশি অক্ষুণ্ণ আছে, দুটো পা-ই রয়েছে, আজও । পাশ্চাত্যের ভাষাবিদগণ এবং তাঁদের শিক্ষায় অত্যন্ত প্রভাবিত ভারতবর্ষীয় ভাষাবিদগণ আমাদের লিপির এই স্বভাবকে বুঝতেই পারলেন না । পারতেন, যদি না তাঁদের অর্থবহনের দায়িত্বহীন phonetic script-এর তত্ত্বে তাঁরা সম্পূর্ণ নিমগ্ন (conditioned) থাকতেন । সেকারণে আজ আমরা আমাদের লিপিকে আখ্যাত করছি phonetic-cum-ideographic script বা phono-ideographic script. এরপরও আপনি বলতে পারেন, উচ্চারণকে ধারণ করাই যদি ইংরেজী লিপির যোগ্যতা হয়, তবে gnat, know, knife প্রভৃতি লিখিত ইংরেজী শব্দ তাদের উচ্চারণকে যথাযথ ভাবে ধারণ করে না কেন ? করে না কারণ, ইংরেজী শব্দেও যে এককালে অর্থ নিহিত থাকত, ঐ ধরনের লিখিত শব্দগুলি তারই রেশ টেনে নিয়ে চলেছে আজও । তার মানে, আমরা যে বাংলাভাষায় কথা বলি, তার আদি রূপ ও ইংরেজী ভাষার আদি রূপ যে একই ছিল, এই ধরনের ইংরেজী শব্দগুলি তারই স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে । আমাদের ‘জ্ঞ’ (জ্ + ঞ) ও ইংরেজীর know (gnow) তার স্পষ্ট উদাহরণ । যাই হোক, আমরা যদি লিপিবাহিত আওয়াজ ও অর্থকে যথাক্রমে লিপির দেহ ও মন বলি, তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইংরেজী লিপির দেহ আছে মন নেই, চীনা লিপির মন আছে দেহ নেই, আর বাংলা লিপির দেহ-মন দুই-ই আছে । বাংলা শব্দ লিখবার সময় কথাটি ভোলা চলবে না ।

শব্দ :
(‘শব দান করে যে’ বা ‘মনোভাবের শব দান করে যে’ কিংবা ‘ঘটনা বা ক্রিয়া অতীত হইলেও তাহার যে মৃতদেহ আওয়াজ রূপে চাউর হইয়া থাকে’) । ইংরেজিতে যাকে word বলে, বাংলায় তাকে শব্দ বললে শব্দের অর্থকে সঙ্কুচিত করে ফেলা হয় । কেননা, বাংলায় মানুষের মুখনিঃসৃত ভাষিক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে যেমন শব্দ বলে, বাহ্যজগতের যে কোনো আওয়াজকেও (sound-কেও) শব্দ বলে । বাংলায় ভাষিক শব্দের ভিতরে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ (meaning) ও অর্থপূর্ণ ধ্বনি (meaningful sound) বা উচ্চারণ উভয়ই থাকে, বাহ্যিক শব্দের ভিতরেও আওয়াজের (sound-এর) উৎস-স্থলের ঘটে যাওয়া (মেঝেতে চামচ পড়ার মতো) ঘটনার বা ক্রিয়ার সংবাদও (অর্থও) থাকে । বাংলায় ‘শব্দ’ বাক্যের অংশ নয়, বাক্যের অংশ হল ‘সক্রিয়-শব্দ’ যাকে ‘পদ’ বলা হয় । ইংরেজির word–এর ভিতরের বর্ণগুলি বিশেষ আওয়াজ (sound) ধরে রাখে বটে, কিন্তু কোনো প্রকার অর্থ (meaning) আবশ্যিকভাবে ধারণ করে না বলেই পাশ্চাত্যের ভাষাতাত্ত্বিকগণ ঘোষণা করে রেখেছেন । যখন কিনা বাংলা ভাষার প্রতিটি শব্দই উচ্চারণের পাশাপাশি আপন গর্ভে তার অর্থ ধারণ করে রাখে । সেকারণে লিখিত বাংলাভাষার শব্দ মাত্রেই অর্থধারী আওয়াজের লিপিবদ্ধ রূপই বটে । সুতরাং বাংলাভাষায় শব্দকে লিপিবদ্ধ করতে গেলে, তার অর্থ ও আওয়াজ দুইই যেন লিখিত শব্দটির ভিতরে থাকে, সে কথা মনে রাখতে হবে ।

পদ :
(‘পালন বা প্রাপণ দান করে যে’, বা ‘যাহা দ্বারা জীব মানুষ সংস্থা সমাজ বাক্য গান ভোজন মূলধন … প্রভৃতি এক বা একাধিক পদীগণ হাঁটে’) । বাক্যে ব্যবহৃত শব্দকে পদ বলে । তার মানে, সক্রিয়-শব্দকে পদ বলা হয় । কেননা, মানুষ যার উপর নির্ভর করে হাঁটে, তাকে যেমন তার পদ বা পা বলে, তেমনি বাংলার বাক্য তার যে অংশগুলির উপর নির্ভর করে হাঁটে সেগুলিকে সেই বাক্যের পদ বা পা বলে । ইংরেজিতে একে part of speech বলা হয় । প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে দুটি তো আসলে একই কথা । কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, বাংলার লিখিত বাক্যের পদ যেন একটি মন-প্রাণবান জীবন্ত মানবদেহের প্রত্যঙ্গগুলি । তার প্রতিটি প্রত্যঙ্গই সমগ্র বাক্যশরীরের সঙ্গে বাস্তবিক ও মানসিক ভাবে যুক্ত, পৃথক করে নিলে প্রত্যঙ্গটির বা পদের অর্থ ক্ষুণ্ণ হয়ে যায় । বাংলায় বাক্য গঠনকালে প্রতিটি শব্দকে সক্রিয় সজীব করে নিতে হয় । যেমন, ‘আমি’ ‘বিদ্যালয়’ ‘যা’ এই তিনটি শব্দকে বাক্যে পরিণত করতে গেলে বিভক্তি-প্রত্যয়াদি যুক্ত হয়ে শব্দগুলি হয়ে যায় ‘আমি বিদ্যালয়ে যাই’। ‘বিদ্যালয়’তে এ বিভক্তি, যা-এ ই বিভক্তি এবং এমনকি ‘আমি’তে শূন্য বিভক্তি জুড়ে তাদের একত্র করে একটি দেহমন-সম্পন্ন বাক্যে পরিণত করা হয়েছে । ইংরেজীর বাক্য গঠন কালে প্রতিটি শব্দকে সক্রিয় সজীব করার উপায় নাই । তাতে বিভিন্ন নিষ্ক্রিয় শব্দকে আংটা বা নাটবল্টু দিয়ে জুড়ে নিয়ে একটি রোবোটের ন্যায় দেহসম্বল বাক্য বানানো হয়, যে বাক্যদেহটি সচল হয় বাইরের কারও নির্দেশে । ইংরেজী বাক্যের I, school, go এই শব্দগুলিকে অদলবদল করে জুড়ে নিয়ে বানানো হয় ‘I go to school’. যেন তিনটি নিষ্ক্রিয় মরা প্রত্যঙ্গকে to নামক আংটা দিয়ে জুড়ে নেওয়া হল । তার মানে বাংলা ভাষায় বাক্য গঠন কালে শব্দের পাশে শব্দ গাঁথার প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ও প্রাণবন্ত ; যান্ত্রিকতা যেটুকু দেখা যায়, তা আধুনিকতার দূষণ । আর, ইংরেজী ভাষার বাক্য গঠন কালে শব্দের পাশে শব্দ গাঁথার প্রক্রিয়াটি যান্ত্রিক, সজীবতা যেটুকু দেখা যায়, তা প্রাচীন উত্তরাধিকারের রেশ । বাংলার লিখিত বাক্যের পদ সজীব সপ্রাণ দেহমনধারী বাক্যের জীবন্ত অংশ । আর ইংরেজীর লিখিত বাক্যের part of speech হল মন-প্রাণহীন রোবোটের বিচ্ছিন্ন হাত পা মাথা ইত্যাদি । লিপিবদ্ধ করার সময় বাংলা ও ইংরেজী বাক্যের অংশগুলির এই পার্থক্য মনে রাখতে হবে ।

অর্থ :
(‘অর বা পুনরাবর্তন থাকে যাহাতে বা যে বিকল্পে’, কিংবা ‘সামাজিক মানুষ যে পুনরাবৃত্তি-যোগ্য জ্ঞান-ধন লাভের চেষ্টা করিয়া থাকে’) । বাংলাভাষায় লিখিত শব্দের ভিতরে তার অর্থ থাকে । সেই অর্থকে সেকালে ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বা অভিধার্থ বলা হত, আমরা তাকে একালীকরণ করে তার নাম দিয়েছি ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক (ধ্বনিভিত্তিক) অর্থ । দেহের ভিতরে প্রাণ-মন-আত্মা থাকার মতো শব্দের ভিতরে নিহিত থাকে বলে, একে আপনি শব্দের নিহিতার্থও বলতে পারেন । এই অর্থের সঙ্গে স্বভাবতই শব্দের দৈহিক সম্পর্ক বর্তমান থাকে । এই অভিধার্থের উপর নির্ভর করেই তার লক্ষণার্থ ও ব্যঞ্জনার্থগুলি সক্রিয় হয়ে থাকে । সেকারণে বাংলাভাষার শব্দ বা পদকে লিপিবদ্ধ করার সময় তার অভিধার্থকেই শব্দের অন্তর্ভুক্ত করে রাখা হয়ে থাকে, লক্ষণার্থ বা ব্যঞ্জনার্থকে নয় । ওদিকে ইংরেজী ভাষার লিখিত শব্দের ভিতরে সেরকম কোনো meaning থাকে না, আরোপিত প্রথারূপী অর্থকে বা arbitrary meaning-কে বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় । সেই প্রথারূপী আরবিট্রারি অর্থের উপর নির্ভর করে বিকশিত হয় তার metonymy, metaphor, contextual meaning প্রভৃতি যা আসলে বাংলাভাষার লক্ষণার্থ ও ব্যঞ্জনার্থেরই অধঃপতিত রূপ । তাই বাংলাভাষার বাক্য বা শব্দ যখন লিপিবদ্ধ করা হয়, তার বানানের ভিতরে অবশ্য অবশ্যই শব্দের অভিধার্থটিকে নিষেক করে রাখা হয়, রাখতে হয়, রাখতে হবে । লিখিত বাংলাভাষায় এই রীতি বহু প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে ।

ধ্বনি :
(‘ধারণ-বহন সক্রিয় যাহাতে’, অথবা ‘যাহা কোনো এক প্রকার ধারণা বা অর্থ বহনকারী আওয়াজ রূপে উচ্চারিত হইতেছে’) । ধ্বনি শব্দটির অভিধার্থ হল, ‘ধারণা বহনের সক্রিয়ন যাহাতে’ । কার্যত এ হল ধারণা বহনের সক্রিয়তা । তার মানে, বাংলাভাষার ধ্বনি হল এমন এক আওয়াজ-ধারী সত্তা যা ধারণা (অর্থ) বহনের কাজে সক্রিয় রয়েছে । সেখানে ইংরেজী ভাষায় রয়েছে phoneme । সে হল উচ্চারণের একক, যার কাঁধে অর্থের বোঝা নাই, কিন্তু আওয়াজের বোঝা আছে । সুতরাং বাংলার ধ্বনি আর ইংরেজীর phoneme আদৌ এক ব্যাপার নয় ।

বর্ণ :
(‘ক্রিয়ার আধার রূপে স্বভাবত বরেণ্য যে’) । বাংলাভাষায় রয়েছে ৪৩টি মাতৃকাবর্ণ । তাদের প্রত্যেকের সুনির্দিষ্ট বহুরৈখিক অর্থ আছে । সেই ৪৩টি বর্ণে গড়ে উঠেছে (দাশবংশ, ঘোষবংশ ইত্যাদির মতো) ক-বংশ, খ-বংশ প্রভৃতির মতো ৪৩টি শব্দবংশ । এরূপ প্রত্যেকটি শব্দবংশ থেকে জাত হয়েছে অজস্র শব্দ-পরিবার, প্রত্যেকটি পরিবারের আবার রয়েছে দুশো-পাঁচশো শব্দ-সদস্য । এইভাবে ৪৩টি শব্দবংশ থেকেই বাংলাভাষার বিশাল শব্দসম্ভার সৃষ্টি হয়েছে । মনে রাখা দরকার, শব্দ-পরিবারের শব্দ-সদস্যদের মধ্যে থেকেই অনেককে বাক্যের কর্মী রূপে খাটার জন্য ডেকে কাজে লাগানো হয় । তাদেরকেই পদ বলে । ইংরেজী ভাষায় letter-এর সে গৌরব নাই, অর্থ তো letter-দের নাই-ই, শুধুমাত্র a আর i এর অর্থ ছাড়া । ইংরেজীর সেই letter-এর সংখ্যা এমনিতেই মাত্র ২৬টি । ত-বর্গটি তার নাই বললেই চলে । তাছাড়া ইংরেজীর শব্দবংশ, শব্দ-পরিবার, শব্দসদস্য স্মৃতিভ্রষ্ট ও অস্পষ্টভাবে থাকলেও ইংরেজী ভাষাবিদগণ তাদের উদ্ধার করে সংস্কার করে একালীকরণ করতে পারেননি আজও । সংস্কৃতকারগণের অর্জিত শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক প্রযুক্তির সহায়তায় ও বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় বাংলাভাষায় বর্ণমালাকে এমন সুবিন্যস্ত করে সাজিয়ে রাখা আছে, যার সঙ্গে কেবল মেনডেলিয়েভ টেবিলেরই তুলনা করা যায় । আদিম বাংলা ভাষায় তখনও পর্যন্ত ছ ঝ ঠ ঢ থ প্রভৃতি বর্ণে বলতে গেলে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র শব্দ সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু বর্ণমালায় একেবারে অঙ্ক কষে প্রত্যেক শব্দবংশের জন্য ঘর ছেড়ে রাখা হয়েছে । তাঁরা জানতেন, এই ঘরের শব্দগুলি জন্মাবে পরে । যে কোনো বাংলা অভিধান দেখলেই বোঝা সম্ভব, ঐ বর্ণগুলিতে পরবর্তী কালে কী পরিমাণে কত নতুন নতুন শব্দ জন্মেছে ।

স্বভাবতই বাংলা ভাষার উপরোক্ত ৪৩টি বর্ণেরই আওয়াজ ও অর্থ দুইই আছে । কিন্তু মানবমনের গভীরে এক রহস্যময় প্রক্রিয়ায় এই আওয়াজ ও অর্থ প্রস্তুত হয় বলেই তাকে উদ্ধার করা কঠিন । সেই কারণে বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণের অর্থ দুর্বোধ্য সন্দেহ নাই । এর কারণ হল, একক ধ্বনি বা বর্ণকে নিয়ে মানবমনের গভীরে যে অর্থময় ধ্বনির বিবর্তন (meaningful-phonemic evolution) চলে, উপরিতলে মানবের মুখের উচ্চারিত ভাষায় তাকে প্রকাশ করা সহজ কাজ নয় । যেমন ‘চালক’, ‘পালক’ প্রভৃতি শব্দের ক্ষেত্রে ‘ক’ বর্ণের ‘করে যে’ অর্থটি সুস্পষ্ট ও প্রকট, অধিকাংশ বর্ণের অর্থ কিন্তু তত প্রকট নয় ; কারও কারও অর্থ অস্পষ্ট, কারও বা খুবই অস্পষ্ট ও রহস্যময় । সেরকম বর্ণগুলির (ধ্বনিগুলির) অর্থ অনুভব করা গেলেও ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন । কিন্তু করা যায়, করতে হয়, করতে হয়েছে, একেবারে নিখুঁতভাবে না হলেও । আজ আমরা নিঃসন্দেহ যে, অ থেকে হ পর্যন্ত বর্ণমালার সমস্ত বর্ণের অর্থ আছে ; সেজন্যেই তাদের নিয়ে গড়ে ওঠা শব্দেরও অর্থ আছে এবং সেই অর্থের প্রচলনও আছে । শুধুমাত্র তাই নয়, তার ঐতিহাসিক সত্যতা যেমন রয়েছে, তেমনি নিত্যতাও বর্তমান রয়েছে । নিত্যতা আছে বলেই আজও বাংলার মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষেরা আওয়াজ ও অর্থবান নব নব শব্দ সৃষ্টি করে চলেছেন । ‘টপকা-ঝোল’, ‘পুঁচকে-ঝলক’, ‘পাগলু’ প্রভৃতি তার টাটকা উদাহরণ । ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির সাহায্যে সেই সব নব নব শব্দগুলিকে সংস্কার করে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল । প্রয়োজন ছিল, আমাদের পূর্বসূরীগণ আমাদের শব্দসম্ভার নিয়ে যে কাজ করে গিয়েছিলেন, নানান কারণে যার উপর শ্যাওলা জমে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল, সেগুলিকেও উদ্ধার করা ও একালীকরণ করা । আমাদের শব্দার্থকোষগুলিতে আমরা তা সাধ্যমতো করেছি, একেবারে নিখুঁতভাবে ও সম্পূর্ণভাবে করে ফেলেছি এমন দাবি আমরা করি না । শব্দতত্ত্ববিদগণ অনেকে মিলে হাত লাগালে তবেই কাজটি সম্পূর্ণ ও নিখুঁত হতে পারে । এখন তাহলে বাংলাভাষার মাতৃকাবর্ণগুলির অর্থ যেরূপ পাওয়া গেছে, সেগুলি উপস্থাপন করা দরকার । কেননা, বানান সংস্কার করার জন্য ঐ অর্থগুলি লাগবে । নিম্নে বানান ও spelling-এর তুলনামূলক আলোচনা করে তার পরই আমরা সেই অর্থ সরবরাহ করে তার প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করব ।
বানান :
(‘শব্দ বানাকরণ বা নির্মাণ চলমান যাহাতে’, অথবা, ‘নিয়মানুসারে বর্ণের সহিত বর্ণ যোগ করিয়া শব্দ বানানো বা নির্মাণকরণ করা চলমান যাহাতে’) । বাংলায় যাকে বানান বলা হয়, ইংরেজীতে তাকে spelling বলা হয়ে থাকে । বাংলায় ‘বানান’ মানে হল, যে এক বা একাধিক বর্ণের ইট দিয়ে একটি শব্দ বানানো হয়, সেই ইটগুলির কথা বলা । ইংরেজীতে spelling মানে হল, শব্দ ভাঙলে যে বর্ণের ইট বা ইটগুলি পাওয়া যায়, যেন সেই ইটগুলির কথা বলা । একই কথা হলেও বাংলায় বলা হয় শব্দ গড়তে কী কী লাগছে তার কথা, যখন কিনা ভাঙলে কী কী পাওয়া য

No comments:

Post a Comment