1 May 2014

চুকচুক করে ভুল

প্রখ্যাত দার্শনিক কান্ট্ (Immanuel Kant) -এর মতে , 'Man is a crooked timber' অর্থাৎ মানুষ নামক এই প্যাঁচ-খাওয়া গাঁট-মারা কাঠটিকে কেউ ঘুরিয়ে সিধে করতে পারবে না । আল্লা, ঈশ্বর - কেউ-ই না । এই এক সৃষ্টির জবরদস্ত বিকলাঙ্গ খুঁটি । সৃষ্টির নিজের পশ্চাদ্দেশে বাঁশ । আর এই খুঁটির প্যাঁচ খুলে সোজা করে দেওয়া বা বাঁশটিকে প্রানপ্রণে টেনেটুনে বাইরে বের করে আনার ব্যর্থ চেষ্টার চেয়ে আরো বড় অত্যাশ্চর্যজনক একটা ব্যাপার আছে । সেটা হল - সেই খুঁটি ধরে এক ঝাঁকুনি দিলে-ই গা থেকে ছিটকে বেরিয়ে ঝরে পড়বে রাশি রাশি ভুল । গন্ধহীন ভুল । বর্ণহারা ভুল । ছন্দশূন্য ভুল । ব্যাপারটা আপাত অলৌকিক মনে হলেও মূলত লৌকি সব-ই । আসলে আমরা নিজেদের অজান্তে কোত্থেকে এক-একটা ভুলের বোঁটা ছিঁড়ে ফেলি আর হাতমুঠো করে বয়ে বেড়াই । টপ্ ভিউ দিয়ে দেখতে গেলে দেখা যায় এটা বাস্তবিক-ই । অতি জাগতিক । এবং আবশ্যিক-ও । সূক্ষ্মতার মধ্যে যা পাওয়া যায়, স্থূলতায় তা-ই পাওয়া-টা দৈনন্দিনতার মূলধারায় প্রতীকী হয়ে আসছে । ইম্পার্ফেক্সানিস্ট-পার্ফেক্সানিস্ট নির্বিশেষে সবার জীবনে ।

আচ্ছা, ভুলের রং যদি আমরা লাল ধরে নিই ছোটোবেলার সেই স্কুলখাতায় লালকালিতে কাটা বড়ো সড়ো ক্রসচিহ্ন (X) সমেত ভুলাবলী শিরোধার্য করে ? যা কিনা আজকের পোস্ট-মডার্নাইজড্ যুগে ল্যাপটপস্ক্রীনে ফুটে ওঠা লাল অক্ষরযুক্ত  'Authentication Failed' এর সমার্থক । লাল ফুল নিয়ে প্রেমের ভুল ব্যাকরণের ঠ্যালায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যতটা চোটআঘাত পায়, তার চেয়েও ভয়ানক হল সেই লাল ভুল নিয়ে জীবনের 'অলি'র অন্ধকারে, গলির বন্ধদ্বারে বার বার ধাক্কা খেয়ে আসা । দুরের লাল সাইরেনের তীব্রতা এড়িয়ে, পোড়োবাড়ির লাল বাতির ভৌতিকতা মাড়িয়েনিষিদ্ধ লাল জায়গায় আধ-দেড় ঘন্টা কাটিয়ে, মাথায় লাল আলো নিয়ে ছুটন্ত রোগী-নেই অ্যাম্বুলেন্সের জন্য নির্জন রাস্তাকে আরো নির্জন করে ছেড়ে দিয়ে, শেষে বাড়ি ফিরে মোবাইল-ঘড়ি-চশমাসমেত রোজকারের লাল ভুল-টাকে বালিশের পাশে রেখে দিব্যি-ই ঘুম দেয় মানুষ । আর ভুলভাল স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করে পরদিন ভুলকুমারীর সাথে ফের মুখোমুখি হওয়ার আগে । কাজে-ই পুরোটা ‘full-cycle-এ চলে না বলে ভুল-সাইকেলে চড়ে বসে আছে - এ কথাটি বললে ভুল শোনাবে না । 

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই । অবশ্য-ই অতি সতর্কতা সহকারে । তার আগে একটি প্রশ্ন হল - 'ভুল'-এর সত্যি কোনো Unit of Measurement ( UoM ) আছে ? নাকি ভুল একটি নিরাকার মানবসৃষ্টি যাকে আমরা নিজেদের দৃষ্টিসীমা দিয়ে আকার দিই ? যেকোনো একটা 'ভুল'কে ছোটো-বড়, সামান্য-মারাত্মক ইত্যাদি বিশেষণ দিয়ে স্লাইডার দিয়ে মেপে বসি, কেন ? আসলে 'মানুষ মাত্রে-ই ভুল করে' - এই বহুপ্রচলিত প্রবাদবাক্য আমাদের সবার মুখে এখনো নিখুঁতভাবে সচল । কিন্তু চিরাচরিত নিখুঁত ভাঁজহীন এই পর্দার পেছনে যে একটা অতিনাটকীয় মঞ্চ আছে এবং সেই মঞ্চে ঠাঁই করে থাকা 'মানুষ' নামের ছাপমারা আঠালো নায়কের খলনায়কীয় বিবেক বা খলনায়কের নায়কীয় রিটেক চলে সেটা হয়তো অনেকের দৃষ্টির গোচরে পড়ে না, বা পড়তে-ই দেয় না মানুষ স্বয়ং । কারণ ওই মঞ্চটা এতো সূক্ষ্ণভাবে পরিকল্পিত এবং হাতসাফাইয়ের মত সুপরিচালিত যে পুরোটা-ই ম্যাজিক শো-এর মত হয়ে যায় বস্তুতঃ ম্যাজিশিয়ানরা স্টেজে যা ম্যাজিক দেখায়, তার আড়ালে কত কূটকৌশল থাকে, সেগুলো আমরা চোখে দেখে বুঝতে পারি না । কিন্তু আমরা জানি এর পেছনে কোন কায়দা-ফায়দা আছে, তাই কোন ম্যাজিক দেখে চমৎকৃত হলেও আমরা বলি - "এর পেছনে কোন মারাত্মক চালাকি আছে নিশ্চয়ই" । বাস্তবেও ঠিক তাই অর্থাৎ মানুষের একটা সহজাত প্রবণতা আছে যে সে যা দেখে সেটা-ই বিশ্বাস করে । "আমি স্বচক্ষে দেখেছি" - বলে নিজেকে জাস্টিফাই করার একটা কমন হাতিয়ার এখন আমাদের সবার হাতে পাকাপোক্ত ভাবে এসে গেছে ফলস্বরূপ এখানে চলে আসে সেই স্লাইডার । 

'
ভুল' নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার শেষ নেই । ভুল-বিষয়ক এই নিরন্তর গবেষণার ধরণ কেমন হয় বা কিসের ভিত্তিতে হয় সেটা-ই ভাবতে গিয়ে এখনো অবাক লাগে আমার । এমনকি ভুলের আবার যে আপেক্ষিক ব্যাপার-স্যাপার আছে সেটা-ও মানুষের ভাবনার বাইরে পড়ে নি । প্রফেসর আইজ্যাক আজিমোভ ( নামের বিশুদ্ধ বাংলা বানান সঠিক জানা নেই বলে অনিচ্ছাকৃত ভুল বানানের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী )-এর বিখ্যাত বই 'The Relativity of Wrong' এর ফুটন্ত উদাহরণ না বাবাঃ, আমি বইটি পড়ি নি, শুধু নাম শুনেছি মাত্র । নিজে জীবনের অর্ধেকরাস্তা পেরিয়ে ভুলের কোটিপতি হলাম, তার উপরে কেং-শিং-টন থেকে প্রকাশিত মাত্র দুশো ছাপান্ন পাতার ভুলের ওইসব আপেক্ষিকতাবাদ পড়বো ? বাপের নিকুচি করেছে ! পারলাম না, কারণ ভুলের ভবিষ্যৎ এমনিতে-ই অনেক ভুলময় উজ্জ্বল । তাই ওই কেং-শিং-টন থেকে ছাপা বইটি পড়ে নিজের মাথায় নতুন করে শিং গজিয়ে লাভ নেই, ভাই !

১. "আরে চটে গেছিস দাদা ! তখন বললাম না, ভুল বলেছিলাম..."
২. "সরি স্যার, খুব ভুল হয়ে গেছে..." ৩. "মশাই, আপনি যেটা বললেন সেটা-ই ভুল..." ৪. "আঃ মারলে কেন, মা ? উঃ দাঁড়াও বলছি তো...উফফ... লাগছে মা, প্লী-ঈ-ঈ-ঈ-জ ছেড়ে দাও, আর কখনো-ই করবো না এই ভু-উ-উ-উফফ..."  উপরের ফর্দ আরো লম্বা করা যায় অনায়াসে । ভুলের এই ফর্দটি নিয়ে হাটবাজার বসে যেখানে-সেখানে, মুহূর্তের আনাচে-কানাচে এই ধরণের ভুলোৎসব পালিত হয়, সময়ে-অসময়ে-দুঃসময়ে ভুলাসর জমিয়ে রাখে ভুলের স্রষ্টা । প্রতিটি ক্ষেত্রে সামান্যতম একটি ভুলের যে মারাত্মক পরিণাম হতে পারে সেটা অনেকে-ই মুক্তাক্ষরে মানে, যুক্তাক্ষরে জানে, কিন্তু স্রেফ অক্ষরে অক্ষরে ভুলে যায়  অনেকে আবার নিরক্ষর । তারা না বোঝে বিজ্ঞান, না বোঝে ধর্ম, না বোঝে দর্শন । এদের সাথে খুব বেশি যুক্তিতক্কে লিপ্ত হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় । সাধারণতঃ এদের কু-যুক্তি বেশিক্ষণ ধোপে টেকে না । তারপর তারা ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসে এবং অপ্রাসঙ্গিক কথা টেনে গালিগালাজ করে একে অন্যকে ট্র্যাক থেকে সরাতে চেষ্টা করে । এখানে বড় ভারী দুঃখের সাথে জানাই যে একটা বেনামী সার্ভে-তে দেখা যায় বাঙালিদের মধ্যে এই জাতীয় 'ক্র্যাব মেন্টালিটি' (Crab Mentality) প্রকটভাবে প্রকটিত হয় । যা এক এক সময়ে এমন লাগামছাড়া হয়ে যায় তাতে-ই 'ভুল'-এর বাস্তবিক অস্তিত্বটুকু-ও শূন্যে হাত-পা ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায়

প্রসঙ্গতঃ এখানে উল্লেখ করি, অস্কার ওয়াইল্ড উবাচ - "Whenever people agree with me I always feel I must be wrong" - এটা আমি আজ-ও চুপচাপ মেনে চলার চেষ্টা করি । তবে এই ধরণের উক্তি নিয়ে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করা আমার মত নিতান্ত সাধারণ দ্বিপদ প্রাণীর পক্ষে সম্ভব নয়, বরং এড়িয়ে যাই । নইলে ভুলভাল ব্যাখ্যা বেরোতে পারে যে 'ভুল'কে zoom in করলে-ই ভয়ানক লাগবে, zoom out করলে-ও চুকচুক করবে ভুলটা ।

No comments:

Post a Comment