25 Apr 2014

ভুল


টকটকে লাল । রক্তবর্ণ লাল । লাল রঙের রাজকীয় দাপট প্রায় সর্বত্র-ই দৃশ্যমান । বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক যুদ্ধবিগ্রহ বা হানাহানি থেকে শুরু করে গোলবাড়িতে কনের শাড়ি । তবে লাল রং দৈনন্দিনতার মূলধারায় কখনো সখনো প্রতীকী হয়ে ওঠে । কার প্রতীক ? কিসের বা প্রতীক ? সি.পি.এম. এর ? নিকুচি করেছে । আমার পুরোনো সেই ধুলোমাখা স্কুলখাতায় লালকালিতে কাটা বড়ো সড়ো ক্রসচিহ্ন ( X ) সমেত ভুলাবলীর কথা বলছি । যা কিনা পোস্ট-মডার্নাইজড্ যুগে আমার বর্তমান ল্যাপটপস্ক্রীনে ফুটে ওঠা লাল অক্ষরযুক্ত  'Authentication Failed' এর সমার্থক । কিন্তু এই ধরণের অসতর্কতাজনিত ভুলের উৎপত্তি নিয়ে ব্যাখ্যা করা আমার মত নিতান্ত সাধারণ দ্বিপদ প্রাণীর পক্ষে সম্ভব নয়, বরং এড়িয়ে যাওয়া ভালো । নইলে ভুল নিয়ে আরো ভুল ব্যাখ্যা বেরোতে পারে যে 'ভুল'কে zoom in করলে-ই ভয়ানক লাগবে, zoom out করলে-ও চুকচুক করবে ভুলটা ।  

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই । অবশ্য-ই অতি সতর্কতা সহকারে ।  তার আগে একটি প্রশ্ন হলো - 'ভুল'-এর সত্যি এরকম কোনো Unit of Measurement ( UoM ) আছে নাকি ভুল একটি নিরাকার মানবসৃষ্টি যাকে আমরা নিজেদের দৃষ্টিসীমা দিয়ে আকার দিই ? যেকোনো একটা 'ভুল'কে ছোটো বা বড়, সামান্য বা মারাত্মক ইত্যাদি বিশেষণ দিয়ে স্লাইডার দিয়ে মেপে বসি, কেন ? আসলে 'মানুষ মাত্রে-ই ভুল করে' - এই বহুপ্রচলিত সাধুবাদ আমাদের সবার মুখে এখনো নির্ভুলভাবে সচল ।  কিন্তু এই চিরাচরিত পর্দার পেছনে যে একটা অতিনাটকীয় মঞ্চ আছে এবং সেই মঞ্চে ঠাঁই করে থাকা 'মানুষ' নামের ছাপমারা আঠালো নায়কের খলনায়কীয় বিবেক বা খলনায়কের নায়কীয় রিটেক চলে সেটা হয়তো অনেকের দৃষ্টির গোচরে পড়ে না, বা পড়তে-ই দেয় না মানুষ স্বয়ং । কারণ ওই মঞ্চটা এতো সূক্ষ্ণভাবে পরিকল্পিত এবং হাতসাফাইয়ের মত সুপরিচালিত যে পুরোটা-ই ম্যাজিক শো-এর মত হয়ে যায় । বস্তুতঃ ম্যাজিশিয়ানরা স্টেজে যে ম্যাজিক দেখায়, তার আড়ালে কত কূটকৌশল থাকে, যা আমরা চোখে দেখে বুঝতে পারি না । কিন্তু আমরা জানি এর পেছনে কোন কৌশল আছে, তাই কোন ম্যাজিক দেখে অভিভূত হলেও আমরা বলি- “এর পেছনে কোন মারাত্মক চালাকি আছে নিশ্চয়ই” । বাস্তবেও ঠিক তাই অর্থাৎ মানুষের একটা সহজাত প্রবণতা আছে যে সে যা দেখে সেটাই বিশ্বাস করে । “আমি নিজের চোখে দেখেছি” - বাক্যটা নিজের কথাকে জাস্টিফাই করার একটা কমন হাতিয়ার। । ফলস্বরূপ এখানে চলে আসে সেই স্লাইডার । 

অনেকের নিশ্চয় জানা আছে প্রফেসর আইজ্যাক আজিমোভ ( নামের বিশুদ্ধ বাংলা বানান সঠিক জানা নেই বলে অনিচ্ছাকৃত ভুল বানানের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী ) - এর বিখ্যাত বই 'দি রিলেটিভিটি অফ রং' (The Relativity of Wrong) - এর কথা । এখানে উনি বলে গেছেন - 'ভুল'-এর নির্দিষ্ট কোনো মাত্রা নেই । অর্থাৎ আসলে বিজ্ঞান হল স্বতঃলব্ধ জ্ঞান । একটা গাড়ির চাকা কীভাবে বানালে গাড়িটা দ্রুত চলবে সেটার জন্য মানুষ তার নিজের জ্ঞানবুদ্ধি ও যুক্তি ব্যবহার করে নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় । যেহেতু স্বতঃলব্ধ জ্ঞান মানসিকতার সাথে পরিবর্তন হয়, তাই বিজ্ঞানের পরিবর্তনশীলতা চলমান । মানুষের স্বতঃলব্ধ জ্ঞান অপরিপূর্ণ । উপরোন্ত চর্মচক্ষে যা বোঝা যায় তার বাইরে কোন মত গেলে স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে বাধ্য যে সেটা 'ভুল', তাই মেনে নিতে কষ্ট হয়।

আবার সামান্যতম একটি ভুলের জন্যে মারাত্মক রকমের যে পরিণাম হতে পারে সেটা অনেকে-ই অক্ষরে অক্ষরে মানে । অনেকে নিজেদের অবিশ্বাসকে বিজ্ঞান দিয়ে ঢাকতে চায়। তারা না বোঝে বিজ্ঞান, না বোঝে ধর্ম, না বোঝে দর্শন। এদের সাথে খুব বেশি যুক্তিতর্কে লিপ্ত হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তারা প্রথমে নিজেদের অবিশ্বাসের পক্ষে যুক্তি দিতে চাইবে। সাধারণতঃ এদের কুযুক্তি বেশিক্ষণ ধোপে টেকে না। তারপর তারা ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসে এবং অপ্রাসঙ্গিক কথা টেনে গালিগালাজ করে একে অন্যকে ট্র্যাক থেকে সরাতে চেষ্টা করে । বাঙালিদের মধ্যে এই ধরণের 'ক্র্যাব মেন্টালিটি' (Crab Mentality) এক এক সময়ে এমন লাগামছাড়া হয়ে যায় যে 'ভুল'-এর বাস্তবিক অস্তিত্বটুকু-ও ভুলে যায় ।


সবশেষে উল্লেখ করি - অস্কার ওয়াইল্ড উবাচ 
"Whenever people agree with me I always feel I must be wrong" - এটা আমি আজ-ও মেনে চলার চেষ্টা করি । 

No comments:

Post a Comment