6 Nov 2014

চুমুবাদ

এবার ওরা নামলো 'কচি' ঘটনার প্রতিবাদে । কারা ? কোচিতে 'কিছু একটা' হয়েছে তার বিরূদ্ধে পথে নেমে 'কিছু একটা' করলো খোদ কলকাতার 'কোচি'কাঁচারা । এর দৌলতে ফের শিরোনামে । সাথে তাদের 'কিছু একটা'-এর কুচি কুচি ছবি । সকালে ঘুমচোখে এইসব ছবি দেখলে অনেকের ঘুমটুম নষ্ট । বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশ ধিক্কার জানাচ্ছে, কেউ কেউ চোখেমুখে অপার বিস্ময় জাগিয়ে অনেক কষ্টে বলছে - "আমাদের সমাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে"

'কিছু একটা' অবশ্যই একটা কিছু এমন যা হিন্দুধর্মী আর জৈনধর্মী মানুষদের হাতে তৈরী খাজুরাহো মন্দিরের স্থাপত্যকাল থেকে হাজার হাজার বছর পেরিয়ে আসার পর একটা অতিবিরল ঘটনা যা প্রথমে কোচিতে হলো, সেটা ফলো করলো কলকাতা । কিন্তু প্রাচীন আর্যযুগের হিন্দুরাজাদের আমলে যা হতো, তা নিয়ে কারোর মাথাব্যাথা ছিলো না, এমনকি ছিলো না এখনকার মত উন্নততর অত্যাধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা বা আন্তর্জালিক যোগাযোগ ব্যবস্থা । মিডিয়া-ফিডিয়া বা জার্নালিজমের ধারণাও ছিলো এদের স্বপ্নের বাইরে । অথচ কামদেবের ( হিন্দু পুরাণের মতে প্রেমের দেবতা ) মত রক্তমাংসের মানুষ সব রাজাপ্রজাদের মধ্যে বাস করতো যেটা বলাবাহুল্য । রাজার সাথে রানীর, রাজার সাথে দাসীর, প্রজার সাথে রানীর, প্রজার সাথে দাসীর রতিক্রিয়ার বর্ণনার রমরমা আমরা পাই বেদ থেকে শুরু করে অনেক প্রাচীনগ্রন্থে । এগুলোর অনৈসর্গিকতা আর অনৈতিহাসিকতা বাদ দিলে প্রেমযৌনতা নিয়ে যা বাকিটুকু থাকে তার ঐতিহাসিকতার বিষয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেই না । কিন্তু আর্যযুগ বা তারও আগে প্রাচীন বৈদিকযুগের ঋষিমুনিদের চিন্তাধারা আর এখনকার বুদ্ধিজীবীদের চিন্তাধারার মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখতে পাই । কিসের ? 

সমাজের আধুনিকতা মানুষের হাত ধরে এসেছে, বিজ্ঞান আর ধর্ম দুটির সমণ্বয়ে মানবজাতির প্রগতিশীলতা নিয়ে মানুষের ভূমিকা সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে । 'বিগ ব্যাং' তত্ব নিয়ে বিশ্বসৃষ্টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার স্বপক্ষে যুক্তিবাদী স্বয়ং পোপ ফ্রান্সিসের কথা অনেকেই নিশ্চয় জানে । সময় যত গড়াবে, মানুষের বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে আমূল পরিবর্তনের চমক তত আরো বেশি করে পেয়ে বসবে আমাদের দুর্বলসত্তাকে, এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে যায়, বলা যেতে পারে সবার মনে খোঁচা মারে এখনো - "এই আধুনিকতাকে পুঁজি করে আমরা কি আদৌ আধুনিকমনস্ক হতে পেরেছি? এই আধুনিকমনস্ক হওয়া আর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া একই নয় জেনেও আমরা কি এই স্থূলপার্থক্যটা সমাজের সামনে তুলে ধরতে পারছি ?" উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক প্রাচীনযুগের হারেমপ্রথা, সমাজ তথা ভারতে আধুনিকতার ছিঁটেফোঁটা ছিলো না তখনকার রাজা-মহারাজা, বাদশাহ-নবাবদের রাজত্বে অথচ এই প্রথা চালু করে গেছেন দেশের নানা প্রান্তে প্রাসাদের ভিতরে-বাইরে । এই 'অবৈধতা' বা 'পুরুষের বহুগামিতা' গোপনে নয়, বরং চোখের সামনেই প্রকাশ্যে চলতো । ওদের এই ব্যবস্থাকে 'আধুনিকরণ' বলে আখ্যান দেওয়া যেতে পারে তৎকালীন সমাজের পক্ষে । অর্থাৎ এই নয় যে তৎকালীন এরূপ সমাজব্যবস্থা সারা দেশে বিপ্লব আনতে পারে নি বা সাড়া ফেলে নি, নিশ্চয়ই ফেলেছে । উত্তরভারতের একরাজ্যের রাজাদের যা কিছু নতুন জেনে বা দেখে ( সব জেনেশুনে বা দেখেশুনে ) উৎসাহিত বা অনুপ্রেরিত হয়ে মধ্যভারতের অন্য রাজ্যের রাজা সেই একই পন্থা অবলম্বন করে আসতেন আর সেই সূত্রে গড়ে তুলতেন নিজেদের রাজ্যসীমানায় নিজস্ব হারেম । এটাকে কিন্তু প্রতিবাদ বলে না, এটাকে প্রতিযোগিতা বলে না, এটাকে সংঘাত বলে না, এটাকে বলে 'আধুনিকরণের ব্যবস্থা' যা নিজেদের স্বার্থের জন্য ভিন্ন আর কিছু নয় । কিছুটা দেখনদারিও বলা যেতে পারে । 

আর এখন ? সোনাগাছির মত হাতে গোনা কয়েকটা রেড এরিয়াভুক্ত বেশ্যাদের ঠিকানা ছাড়া আর কোথাও তেমন উল্লেখ থাকে না । তাও অন্তঃপুরীয় অর্থাৎ লুকিয়ে লুকিয়ে যাওয়া-আসা চলে আর কি । এককথায় নিষিদ্ধ । অথচ বাজারী বলে সবাই একবাক্যে মেনে নেয় । নাহ, এখানে আমি ভালোবাসা বা প্রেমজাতীয় প্রবৃত্তি নিয়ে বলছি না, বলছি সমাজের 'আধুনিকতা' নিয়ে মানুষের দ্বিধাবোধ যা মানুষকে দ্বিচারিতার মুখোশ পরতে সাহায্য করে । আরে বাবা ! কোচিতে এক দম্পতির প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার প্রতিবাদে পুলিশিবাদী, পাল্টা প্রতিবাদে কলকাতায় এমন চুমুবাদ ! এসব চুমুবাদীদের নিয়ে আমার কিছু বলার নেই কারণ এরা যা পারে বা যা ভালো মনে করে তাই করে, কিন্তু তা বলে "ওরা যা করেছে, বেশ করেছে" বলতে পারবো না । বলার মত যুক্তিও খুঁজে পাচ্ছি না বা সৎকারণ অন্ততঃ দেখতে পাচ্ছি না । তবে এটা ঠিক আমি তিরিশের কোঠায় এসে বলছি কিন্তু আমি তেমন সেকেলেরও নই । কারণ একজন প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পেছনে একটা চুমুবাদের যুক্তি কোনোমতে যুক্তি হয়ে উঠতে পারে না । চুমু একটা ভাবপ্রকাশ । একটা স্পর্শকাতর প্রবৃত্তির জাগরণ । ভিতরের ইমোক্ষরণের বহিঃপ্রকাশ । স্কুলবয়সে থাকতে থাকতে অনেকে চুমু খাওয়ার অভিজ্ঞতা পেয়ে থাকে । কিম্বা পাড়াতুতো চুমু নিয়ে স্বীকারোক্তি পেশ করা লোকের অভাব নেই । কিন্তু তাই বলে চুমু নামের একটা আবেগপ্রকাশকে অস্ত্র বানিয়ে প্রতিবাদ করা কেন ? 

"চলো চুমু খাই" বলে একে ওকে জাপটে ধরে গালে গালে ঘষে, এর ওর ঠোঁটে ঠোঁটে ঘষে সরব হচ্ছে, তাও রাস্তায়, ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আবহে, শত শত লোকের চোখের সামনে, উর্দিধারী পুলিশের সামনে এবং খোদ থানার সামনে । অমনি দুঃসাহস পেলো কোত্থেকে এরা ? দুঃসাহস একদিনে হয় না তো বলে জানি । নাকি প্রতিবাদের নামে নিজেদের সাধ মেটালো ? কিম্বা চুমুবাদে প্রতিবাদ সম্পন্ন করা হয়ে গেলো ? এই চুমুবাদকে সমাজের আধুনিকরণ বলে ? সামান্য কয়েকঘন্টার ঘটনার নিরিখে একে "এগিয়ে যাওয়া সমাজ"-এর দৃশ্যায়ন বলে ? বঙ্গপ্রশাসকের দল থেকে শুরু করে বিভিন্নস্তরজীবীরা এই ঘটনাকে সমর্থন করতে পারে নি, কেউ কেউ করলেও পুরোপুরি মেনে নিতে কুন্ঠাবোধ করছে । এর কারণ আমরা আধুনিকমনস্ক হয়েও প্রাপ্তবয়স্কতার ধারণা নিয়ে একরকম দফারফা করে ফেলেছি । একে পরিণত মনের পরিচয় বলতে আপত্তি করা অস্বাভাবিক নয় । এর চেয়ে ঘরবাড়ি থাকতে বা সত্যিকারের ভালোবাসা থাকতে নিজেদের স্বার্থে চুমুর আবশ্যিকতা অনেক বেশি পরিণত । এমনকি হারেমপ্রথার মত প্রাচীনকালের 'আধুনিকতা'-এর আস্ফালনের চেয়েও অনেক বেশি সুরক্ষিত আর সুস্থ থাকে মানবিকতা এই আদরচুমুতে আর চারদেওয়ালের মধ্যে ভালোবাসার জনের সাথে লিপ্ত প্রেমযৌনতার ব্যবহারিক সততা সত্যিকারের প্রাপ্তবয়স্ক মনের পরিচায়ক ।

তবে সবাই একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে যারা আজ প্রকাশ্যে চুমুবাদী হয়েছে, আজ থেকে দশটা বছর বাদে এরা নীরবতা পালন করবে যেকোনো 'কচি'-জাতীয় ঘটনার স্বপক্ষে, অন্ততঃ এদের কেউ ততদিনে সেলেব্রিটি হলে বা প্রশাসনিক দলে যোগদান করলে বা সবার-মুখে-নাম-উচ্চারিত হলে অন্য কথা । তখন মিডিয়ার পাল্লায় পড়ে স্নব্ সেজে দু-এক লাইনের ভাষণ ঝাড়বে আর ফুড়ুৎ করে কেটে পড়বে । বাকিরা চুপ হয়ে থাকবে । শেষে বলতে বাধ্য হলাম যে আজকালকার ছাত্রছাত্রীরা পাশ্চাত্য অনুসরণ করতে গিয়ে অনেকটাই বেগরবাই করে ফেলছে নিজেদের চারপাশকে । যখন তখন আস্ফালন করছে যার কোনো মাথামুণ্ডু নেই, পুরো বালখিল্য দেখনদারি । এদের বুঝতে হবে কোনো বিশ্বাস বা ব্যবস্থা বা রীতিনীতি একদিনে তৈরী হয় না । এর জন্য দরকার একটা সঠিক আর সুপরিকল্পিত চিন্তাভাবনা যেটা নিজেদের স্বার্থে না হলেও সমাজের স্বার্থে করতে হবে । 'অবৈধতা' নামের জিনিসটা এখনো নিষিদ্ধ ধর্মনির্বিশেষে সারাদুনিয়া, যা বৈধ নয় তাকে নিয়ে ছিনিমিনি করা একান্ত বোকামি বা স্বীয়-পশ্চাতে-লাথ-মারার মত পাকামো ছাড়া আর কিছু নয় । অভিজিতের পদত্যাগের দাবি কতদূর গড়াতে পারলো এরা কেউ জানে ? নাকি জেনেও ভুলে গিয়ে নেক্সট চ্যাপ্টারে লাফ মারছে ? 

এর চেয়ে খবরে 'কোচি'কাঁচাদের চুমুবাদী ছবি একঝলক দেখে ফিক করে হেসে মাথা নেড়ে ওদের চুমু-কে বাদ দেওয়া ছাড়া গত্যান্তর নেই ।

No comments:

Post a Comment