15 Jun 2015

মোট ২০৬টা হাড়


জীবনবিজ্ঞানের দৌলতে আমাদের সবার জানা প্রাপ্তবয়স্কমানুষের দেহে মোট ২০৬টা হাড় । ক্লাসটিচার যখন বলে ২০৬টা হাড়, তখন আমরা সাথেসাথে নিজেদের ইউনিফর্মের আড়ালে যে ছালচামড়ামোড়া কাঁচাবয়সী শরীরের দিকে তাকাই আর একটু গা টিপে দেখি হাড়টাড় শক্ত অথচ আন্দাজে হাড়গোড় গুনে গুনে দেখা পাগলামির চুড়ান্ত নিদর্শন ভেবে মুচকি হাসি । বাড়িতে প্রাইভেট টিউটরের কাছে যখন ফের একই সংখ্যা নিয়ে পড়া হয়, তখন ক'জন বা প্র্যাকটিকালি হাড় গোনার কথা ভাবি ?! আমাদের থিওরিটিক্যাল দৌড় ওইখানে শেষ যখন পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তরে ২০৬ লিখে স্কোর হিসেবে একের মধ্যে এক নিশ্চিত করে নিই । 

৩২টা দাঁত থাকে জানি বলে বা জানতে পারলে অনেকেই জিভের ডগা দিয়ে নিজে নিজের বিকশিতদন্ত ছুঁয়ে দেখেছি । ৩৬টা না ৩৩টা না ৩২টার কম পাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে । ঠিক ঠিক ৩২টা দাঁত বের করতে লাগামছাড়া জেদী হতেও দেখেছি অনেকের মধ্যে । সফল না ব্যর্থ হলো তা নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামায় না, বরং পাঠ্যবিষয়ানুসারে সত্যি সত্যি যে ৩২টা দাঁত হয়, সেই কৌতুহলের বশে গুনতে যাওয়া অস্বাভাবিক নয় । কিন্তু দাঁত সংখ্যায় কম, সহজলভ্য, দৃশ্যমান,পাশাপাশি ইঁটের মত সাজানো থাকে বলে চট করে গোনা যায় । হাড়ের বেলা তা কোনোভাবে সম্ভব নয় একমাত্র জীবিত থাকা অবস্থায় । কিন্তু কঙ্কাল হাতের কাছে পেলে সেটা নিশ্চয়ই সম্ভব । রবিনসন স্ট্রিটকাণ্ডের প্রসঙ্গ এখানে আনার চেষ্টা করছি বইকি তবে যেকোনো সহজবোধ্য বিষয় হাতের কাছে পেলে তা নিয়ে লেগে পড়ার স্বাভাবিক কৌতুহল আর না-দেখা-কেবল-শোনা গোছের বিষয় খতিয়ে দেখার ইচ্ছা - এই দুটোর মধ্যে বিস্তর ফারাকটা একবার মনে করানোর ট্রাই করছি । 

মিউজিয়ামে দেখেছি সংরক্ষণে রাখা মানুষের আদিকঙ্কালকুল । আর্টস্ ফ্যাকাল্টিতে দেখেছি কঙ্কালকে সামনে দাঁড় করিয়ে তার ছবি ক্যানভাসে এঁকে দেওয়ার প্র্যাকটিস । ল্যাবে দেখেছি এককোণে রাখা কঙ্কালের উপস্থিতিতে অন্যান্য যাবতীয় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকা । মুভিতে দেখেছি ভিস্যুয়াল এফেক্টসহ মাল্টিমিডিয়ার হাত ধরে আসা কঙ্কাল নিয়ে হরেকরকম অদ্ভূতুড়ে স্টোরিলাইন । বইতে দেখেছি অলৌকিক গল্পের প্লটে কঙ্কালদের ধরে আনার লেখকদের বাধ্যবাধকতা । স্কেয়ারি হাউজে দেখেছি ঝুলে থাকা কঙ্কালের হঠাৎ করে হাড়হিম করা দাপাদাপি (চমকমিশ্রিত বিদকুটে দর্শনজনিত ভয়ও পেয়েছি) । মলে দেখেছি কঙ্কালের কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে পোজ মারা । এতকিছু সত্ত্বেও কঙ্কালে যে আদৌ ২০৬টা হাড় আছে, সেটা গুনে দেখেছি একবারও ? গোনার কথা মাথায় আনি ক'জন ? ২০৬ না তার কম না তার বেশি সেটা গুনতে যাওয়াকে আমরা কৌতুহলের মধ্যে ফেলবো ? নিছক ছেলেমানুষি বা "মাথাখারাপ নাকি? খেপেছিস?" মার্কা গাল পেড়ে খাওয়া অ্যাভয়েড করি বলে গুনি না ? উল্টে যে সত্যিই গোনে বা গুনতে যাওয়ার চেষ্টাটুকু করে তাকে সাইকো বলে গালি দিতে আমরা বেশিরভাগ অভ্যস্ত ।

বস্তুত সাইকো বা মানসিক বিকৃতির শিকার - এই তকমা পেয়ে আসা একজন শিক্ষিত মধ্যবয়সী গত ছয়মাস ধরে একটা মানুষের কঙ্কালকে পাশে শুইয়ে কাটিয়েছেন, খাইয়ে এসেছেন, কাপড় পরিয়ে এসেছেন পরিবারের সসদস্যজনিত সম্মানটুকু বজায় রেখে । উনি যা করেছেন, তা সাধারণ মানুষের পক্ষে শুধু বদহজম নয়, শকথেরাপিস্টদেরও রীতিমত শক খাইয়ে দিতে ওস্তাদ । গুনে গুনে ছয়টা মাস মানে প্রায় ২৬ থেকে ৩০টা সপ্তাহের সময় ছিলো ওনার হাতে । আমার প্রশ্ন - উনি কি কঙ্কালের হাড়গুলো গুনে দেখেছেন ? ২০৬টা কিনা তার প্রমাণ দেখার জন্য একদিনও চেষ্টা করেছেন ? ছেলেমানুষি বা "মাথা খারাপ হয়েছে ? খেপেছিস ?" গোছের পাগলামিটুকু করেছেন ? খুব সম্ভবতঃ করেন নি, কারণ ওনার উদ্দেশ্য 'ভিন্নধর্মী' ছিলো ।

কিন্তু একজন স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক সেটা বুঝি তার একমাত্র 'উদ্দেশ্য' বা 'ধর্ম' দিয়ে নির্ধারিত হয় ? যদিই বা হয়, তাহলে আমরা এখনো 'ধর্ম'-এর ঊর্ধ্বে আসতে পারি নি, না ?

No comments:

Post a Comment