10 Jun 2014

'অসভ্য চোখ'-এর রিভিউ


সাবাড় করে ফেললাম একটা গোটা উপন্যাস - 'অসভ্য চোখ' । লেখিকা সায়ন্তনী পূততুন্ড । বইটি শেষ করার পর আপনা থেকে মুখ ফস্কে বেরিয়ে এলো - 'সাবাশ!!!' 

একটু গুছিয়ে বলি - এই সাবাশাত্মক রহস্যোপন্যাসের কভারে চিত্রিত স্নানরতা একটি মেয়ের উন্মুক্ত 'ফসসা' পিঠ দেখে আমার চোখ অসভ্য হওয়ার আগে-ই আমার ডানহাতটি যেন 'অসভ্য' হয়ে এগিয়ে গেছিলো তার দিকে । সেখান থেকে শুরু করে শেষ পাতা অবধি নিজের চোখ একটানা অসভ্যতামি করে যাচ্ছিলো । এমন মাল্টি-ডাইমেনশনাল্ ঝকঝকে প্লটের প্লেট হাতে নিয়ে বেশ অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকতে হয়েছিলো এই পাঠককে । সাথে মুখ ফসকে বেরিয়ে আসা সেই স্বয়ংক্রিয় রি-অ্যাকশন । 

রসেবশে রহস্য - কিছুদিন বাদে বাদে বাথরুমের বা বেডরুমের জানালা দিয়ে দেখা একজোড়া 'অসভ্য চোখ' কার যে হতে পারে সেই নিয়ে রহস্য । কিন্তু তা বলে রহস্যের জট পাকিয়ে বা খোলার সাধারণ গল্প নয় । বরং এন্ড-টু-এন্ড একটা ইউনিক পিস যা শেষ অবধি টেনে নিয়ে যায় এবং শেষে এসে রহস্যের জট খুলে গেলেও রীতিমত বিস্ময়ের শক্ খাইয়ে ছাড়ে । সাথে 'পিকুল'-এর গোয়েন্দাগিরি নাকি হারানো-ভালোবাসা-ফিরে-পাওয়ার-ধান্দাগিরি - এ নিয়ে হাসির বুম-বুম-ব্যাং । 

এক্কেরে রসে ডুবিয়ে বশ মানিয়ে নেয় । 

ফ্রেশ ফ্রায়েড ফ্রাস্টু - লেখিকার ভাষায় "ফ্রাস্টুই ফ্রাস্টু চেনে" আধ নিমিষের মধ্যে পাঠকদের দলাপাকানো জীবন-কে লিফ্টে চড়িয়ে স্কাই-লাইন বিল্ডিং-এর ছাদে নিয়ে যায় যেখানে ফ্রাস্ট্রেশন খালি ধোঁয়া ছাড়ে । বেমক্কা-ধাক্কার হাক্কা নুডলস্ খেয়ে নিজে ছক্কা হয়ে যাওয়ার মুহূর্তগুলো আমরা কেউ কি ভুলতে পারি ? ভুলতে চাই বা ভুলে-ও যাই হয়তো কিন্তু ফের কমন বেদনাদায়ক ফোস্কার মত ফিরে আসে । স্মৃতির উৎকট ভিড় ঠেলেঠুলে । আলোচ্য উপন্যাসজুড়ে 'ফ্রাস্টু' এমন ফ্রেশ আর ফ্রাই করে লিখেছেন লেখিকা যে নিজেদের নিংড়ে নিয়ে পড়তে হয় । বার বার । এই নিংড়ে নেওয়াটা কষ্টদায়ক নয়, বরং জমে থাকা 'ফ্রাস্টু' ক্ষণিকের জন্যে ঝেড়ে ফেলার মত অসীম আনন্দদায়ক ।  

তোমাদের ফ্রাস্টু আমাদের অতিথি আর আমাদের ফ্রাস্টু তোমাদের এক গ্লাস নুনচিনির ঠাণ্ডা শরবত ।  

যৌগিক অঙ্কে যৌনতা - যৌনতা বলতে আমরা কেবল চরম উগ্রতা বুঝি ? যৌনতাড়নায় ক্ষিপ্রতা ? নাকি যৌনতৃপ্তির এলোমেলো উস্কানি ? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কথাটি প্রযোজ্য হলেও লেখিকার দৃষ্টিভঙ্গী 'যৌনতা' নামের এই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে আরো স্বাভাবিক পরিবেশতুল্য করে পরিবেশন করেছে আমাদের সভ্যাসভ্য চোখের সামনে । এটি একটা জটিলতম অঙ্কের ফর্মুলা থেকে একটা সহজতম এবং সংক্ষিপ্ত অথচ সূক্ষ্মতম রাস্তা বের করা যা শুধু গণিতবিদ নিজে কেন আজকের কিংকর্তব্য-জ্ঞাত গণতন্ত্র-ও সাগ্রহে গ্রহণ করতে এক পায়ে খাড়া । নির্দ্বিধায় । বিনা যুক্তিতে । উপন্যাসটি তার যোগ্যতম অ্যাসেট । 

মেপে মেপে যৌগিক অঙ্কে বাজিমাত করা যৌনতৃপ্তিদায়ক গল্পচিত্রণ লুকিয়ে আছে যা আদ্যোপান্ত পাঠকনির্ভর । 

খিস্তির খাসখবর - আজও খিস্তির বাজার বেশ সরগরম । দৈনন্দিনতার এই বাজারের উপরে গভর্মেন্টের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই । মূলতঃ খিস্তি একটি নিরাকার ক্ষেপণাস্ত্র । মৌখিক হাতিয়ার লক্-লকে জিভের "এক ছোবলেই ছবি" আমি তুমি সব্বাই । এটা সাত-সত্যি যে যেখানে যাও না কেন , সেখানে দুই কান পাতার আগে-ই তা এফোঁড় ওফোঁড় । কি ? কান গরম ? সেটি আছে , তবে লেখিকার এই কলমের জোয়ার বেশ উপভোগ্য এবং সময়োপযোগী । কোথাও ভাঁটা পড়ে নি খিস্তির প্রতি কিস্তিমাতে , পড়ার কথা-ও নয় । 

বৃষ্টির খবর তো আমরা পাই বা না পাই , খিস্তির খাসখবর নিয়ে উপন্যাসটি সহাস্যে হাজির পাঠকদের সামনে । একশো পার্সেন্ট গ্যারান্টি ।

রোম্যান্সের রোমিওপনা - যুগ যুগ ধরে রোম্যান্স বয়ে চলছে । আহা ! অনায়াস । অবাধ । এখানেও তার ব্যতিক্রম হয় নি । রোমিও-জুলিয়েট এর মত দু'জোড়া কাপল্ এই গল্পের মুখ্যচরিত্র । 'বিশু' ও 'লাটু' আর 'বাবন' ও 'লাটুর মা' - এদের মধ্যে "পেম" আমার মত রোম্যান্সভোগী পাঠকের কাছে বেশ টাটকা-ফাটকা । শুধু তাই নয় , এদের ব্যাকগ্রাউন্ডের ভিন্নতা নিয়ে দুই বিপরীতধর্মী মানুষের মধ্যে যেভাবে রোম্যান্সের মোচড় দিয়ে লিখেছেন লেখিকা তাতে হেসেকেঁদে না পড়ে উপায় নেই । প্রেমিকদের রোমিওপনা একেক সময়ে তাক লাগিয়ে দেয় যা কিনা ব্যর্থপ্রেমিক-কাম-পাঠকদের জন্যে নতুন করে আবার প্রেম করার পন্থা নেওয়ার বাজি রাখে । জুলিয়েট-রাও সমানে সমানে টক্কর দিতে ওস্তাদ । অন্ টপ্ অফ্ অল্ দিস্ দেয়ার'স্ আ রিয়াল লাইফ গেম । 

ভাইসব, এই 'পেম'-গেম মিস করলে-ই শেম অন ইউ ! টোটালি !

কৌতুকের কত্তাগিরি - এই ফিল্ডে লেখিকাকে স্যালুট দিতে হবে তার মিডফিল্ডার স্কিলের দৌলতে । গোটা গল্প জুড়ে কৌতুকরস পরিপূর্ণতা পেয়েছে । স্বতঃস্ফূর্ত । দাপুটে । ঝুড়ি ঝুড়ি ফ্রি-কিক । তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত লেখায় কৌতুক যেন বার বার কর্তা সেজে সারাবাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । একহাতে ইংলিশ ভাষায় ইঞ্জিরিপনার ফুলঝুরি , অন্যহাতে শব্দভাষার সুনিয়ন্ত্রিত চয়নকাঠি । কথায় কথায় মারণাস্ত্র হয়ে ওঠা হাস্যবোমা এই উপন্যাসের আসল কাঁচামাল । 

এই টনিক বাড়ির গিন্নিদের মুড অ্যান্টি-ডুম করার জন্যে যথার্থ  চিচিংফাঁক ।

গ্রামীণ সারল্য - আলোচ্য প্লটটি "নবগ্রাম" বলে একটা গ্রাম নিয়ে তৈরী যেখানে চরিত্ররা একেকটা সারল্যের রূপ । গ্রামজুড়ে যে গল্প লিখেছেন লেখিকা সেখানে সরলতার বহুরূপীসত্তা যেন বার বার ফুটে আসছে । অন্ধকার হলে শহরে আলো জ্বলে ওঠে রাস্তাঘাটে ফুটপাথে, এমনকি কয়েকটা বেঁচে থাকা গাছের ডালপালায় । সব-ই কেমন একটা কৃত্রিম-ডিম লাগে । কিন্তু গ্রামের মধ্যে একটা সহজাত অন্ধকারকালীন হার্দ্য লুকিয়ে থাকে, সাথে গা ছমছম করা আমগাছ , ফাঁকামাঠের গরিমা - এগুলোর প্রাণস্পন্দন এই গল্প পড়তে পড়তে অনুভব করা যায় । সাথে চরিত্রদের সারল্য নানার্থে নানা-রঙে নানা-রসে নানাভাবে ঘুরে ফিরে আসে । 

শহুরে পাঠক-পাঠিকাদের কাছে একটি সুখপাঠ্য যা পড়লে গ্রামে-গঞ্জে বেড়ানোর টিকিট কাটা নিশ্চিত । 

সিলিং ফ্যান্-টাসি - যেমন মিস্ট্রি তেমনি ফ্যান্টাসি । পরস্পরের সমানুপাতিক । সুপার-ডুপার ফ্যান্টাসিক । জুতোর হিল রেললাইনে আটকে পড়ে আছে আর ট্রেন দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে, যখন প্রায় গায়ের উপরে ট্রেন ... তারপর ? - এইরকম টুকরোটাকরা অসম্ভবভাবাপন্ন ছবি নির্মাণ করেছেন লেখিকা বেছে বেছে যা পড়তে গিয়ে ফ্যান্টাসির ফাঁদে-ই পড়তে হয় । গল্পশেষে সেই ঘোর নিয়ে চিৎ হয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে চোখ রাখতে বাধ্য হবে । এমনকি যেকোনো ফ্যান্টাসিভোগী পরিচালক মাথার উপরে সিলিং ফ্যান চালিয়ে এই স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসে দেখতে পারেন সিনেমা বানাতে চাইলে । 

বক্স-অফিস হিট বাঁধা !

No comments:

Post a Comment