27 Jun 2014

মিথ্যা বলা


ভাট বকার আগে আমি নিজেকে একজন মিথ্যুক বলে পরিচয় দিতে চাই কিনা সেটা বলা খুব মুস্কিল । তবে এখন যে জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি , বেঁচে আছি , টিকে আছি এবং খাচ্ছি-দাচ্ছি-ঘুমোচ্ছি-আবার উঠছি, তার পেছনে চারপাশের লোকের মিথ্যা শুনে পচে গলে নিজে-ই মিথ্যা বলার কায়দা রপ্ত করার অবদান প্রচুর । এর জন্যে কেউ না হলেও নিজে নিজেকে সাম্মানিক পুরষ্কার দিই । ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা বলে নিজের দুই পা কে সচল করে অগ্রসর করাটা-ই সেই স্বঘোষিত পুরষ্কার ।
শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ কথা বলার সময় প্রতি ১০ মিনিটে অন্তত একটি মিথ্যা কথা বলেন। তিনি আরো বলেন মিথ্যা বলা সহজ কাজ নয়, সত্য বলার চেয়ে এতে ৩০ ভাগ সময় বেশি লাগে। - See more at: http://www.bengalinews24.com/it-and-technology/2013/06/01/5983#sthash.rGTh3a3w.dpuf

প্রসঙ্গতঃ মিথ্যা বলার অধিকার সবার-ই আছে এমন বিশ্বাস করি আমি । সবসময় সত্যি কেন বলবো ? শুধু সত্যের মধ্যে আমরা ধর্ম খুঁজতে যাবো বা কেন ? মিথ্যার মধ্যে কি কোনো ধর্ম থাকতে পারে না ? কোনো শিল্প কি নেই ? কিন্তু আমরা আমাদের জীবনকে নিজেদের মত করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে আসি নাকি ভাসিয়ে দিতে আসি কিনা এইসব পরের কথা । অনেক অনেক অনেক পরে আসছে এইসব । কারণ জীবন শুরুতে তৈরী হয় না আমাদের হাতে , তৈরী হয় পারিবারিক বা পারিপার্শ্বিকের হাত ধরে । তারপরে-ই সেটা নিয়ে টানাটানি করি নিজেদের অস্তিত্ব খোঁজার তাগিদে । নিজেদের আইডেন্টিটি ক্রিয়েট করার সুপ্ত তাড়নায় । নিজেদের সুখকে স্থায়িত্বদান করার লোভে । এই কুম্ভীপাকে সিদ্ধ হতে গিয়ে আমরা কতবার মিথ্যার ছাতা খুলে নিজেদের মাথা বাঁচিয়ে আসছি । এখনো । মার্ক টোয়েন-ও বলে গেছেন - "যদি সত্যি কথা বলো, তাহলে কিছু মনে রাখার দরকার নেই ।" - আহা ভারী খাঁটি কথা এবং যুক্তিসঙ্গত-ই বটে । তবে উক্তিটি 'মিথ্যা বলা'র প্রেক্ষিতে দেখতে গিয়ে দেখা যায় আমাদের কিনা অনেক প্ল্যান সেট করতে হয় , অংক কষতে হয় , মনে রাখার মত অনেককিছু ভাবতে-ও হয় যার জন্যে সময়জ্ঞানের প্রয়োজন আছে ।  আলবাৎ আছে বস । আর যদি তাই থাকে সেটা-ই পরিশ্রমের । লক্ষ লক্ষ নিউরোনের মধ্যে বাহিত হয় স্নায়বিক শ্রম এবং রয়েছে তার উপরে বুদ্ধিদীপ্ত সুনিয়ন্ত্রণ । এই অসম্ভব কাজ সম্ভব করে দেখাতে পারে যারা, তাদের কাছে নতজানু হয়ে যাই আমি । মিথ্যা বলার পেছনে যুক্তি বা অযুক্তি , কারণ বা অকারণ কোনোটা-ই আমার কাছে ম্যাটার করে না । অন্যদিকে সত্যি কথা বলার মানে কিছু প্ল্যান নেই , নেই কোনো মাথা ঘাটাবার কাজ কিম্বা নামতা মুখস্থ করার মত কোনো ফর্মুলা নেই । কাজে এর কোনো দাম নেই । একেবারে অ-পদার্থ একটি ।

নিচে একটি উদাহরণ দিই ( এটি আমার নিজের বানানো তাও চেনা গণ্ডির সাথে ১০০% মিল দ্রষ্টব্য ) :-

***

- "ইউ শাট আপ্ ! ইউ লায়ার !"
- "যাঃ কলা ! আমি কি মিথ্যা বললাম শুনি ?"
- "প্লিজ্ স্টপ ইট । আমার সহ্য হয় না মিথ্যা , নিতে পারি না মিথ্যা । তুই এতো মিথ্যুক যে কল্পনা করা যায় না !!!"

কলেজ-ফেরতা পিঙ্কি নিজের বাড়ির মাত্র ১ কিমি দূরে তার বয়ফ্রেন্ড-কাম-'মিথ্যাবাদী'র সামনে ঘন্টা তিনেক ধরে সমস্ত ঘৃণা ওগরাতে লাগলো, শেষে পায়ে হেঁটে মাত্র ১৫ মিনিটে বাড়ি ফিরলো । ফিরে মায়ের মুখে পড়লো । মায়ের উদ্বিগ্ন প্রশ্ন - "কি হলো এতো দেরী কেন ?" তার জবাবে মেয়েটির মিথ্যাতুর উক্তি - "আরে বাস পাচ্ছিলাম না তিন ঘন্টা ধরে । কি করি বলো মা ?" তাতে মায়ের সন্দেহের একটা দানা ফট্ করে ফুটলো , বাকি দানাগুলো তখনো স্তিমিত । তাই কিছু না বলে মা চলে গেলো বেডরুমে ।

বেডরুমে তখন মেয়েটির বাবা মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রেখে ঠোঁটের কোণে মাঝে মাঝে হাসি এনে এক ভার্চুয়াল-কাম-বান্ধবীর সাথে এস.এম.এস. করছিলো । খেয়াল ছিলো না কখন যে পাশে এসে বসেছিলো তার ২৪ বছরের বিবাহবন্ধনীভূত স্ত্রী ।

- "এই শুনছো ?"
- "হু"
- "পিঙ্কি যে অনেক দেরী করে বাড়ি ফিরলো সেটা একবারও মনে হলো না তোমার ?"
- "কারোর প্রেমে-টেমে থেমে গেলে তো ঘেমে যাবে সাত-তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে গিয়ে !!"
- "কি যাতা বকছো তুমি ? সেই কখন থেকে কার সাথে কথা বলছো শুনি এদিকে তাকাও তো !"
- "আরে ! বলো বলো শুনছি তো । অফিসের কাজ নিয়ে জরুরী কথাবার্তা চলছে কালকের মিটিং আছে না ? তাই । কাল সকাল সকাল ভাত বেড়ে দিও ডার্লিং !"
- "বাজে কথা কম বলো । তোমার মুখ দেখে মোটে-ই তা মনে হয় না । এনিওয়ে জানো জিগ্যেস করলাম ওর আজকের দেরী হওয়ার কারণ, কিন্তু কিছু-ই বললো না যে ?!"
- "কিছু বলে নি মানে ? আমি তো ওর গলা শুনতে পেয়েছি কি যেন একটা বললো পাস না কি টাস নিয়ে ..."
- "ওহ আমি শুনি নি আসলে ব্যস্ত ছিলাম রান্নাঘর মোছার কাজে । দাঁড়াও আসছি ।" এই বলে বেডরুম থেকে বেরিয়ে গেলো মহিলাটি যে নিজে একজন যেমন মিথ্যাজর্জরিতা তেমন মিথ্যার্জিতা ।

***

উদাহরণটি তেমন কিছু নতুন না হলেও নিত্য-ই যা আমাদের চারপাশে দেখি , শুনি আর পড়ি । কিন্তু এর গোড়ায় এখনো ঝুলছে "মিথ্যা বলা মহাপাপ" । এই সর্বজনবিদিত ঝুলন্ত আলজিভ আসলে একটি সর্বসেরা মিথ যাকে আমরা 'অ্যা' 'অ্যা' করে আদ্ধেক সমর্থন করি পেছনে লুকিয়ে থেকে , আর বাকি আদ্ধেকটা-ই মিথ্যা । এই মিথ নিয়ে অ্যা-অ্যা করা আর মিথ্যা বলা কি এমন আলাদা ? একসাথে জুড়ে দিলে-ই তো বিন্দাস । একটি আস্ত খণ্ড মিথ্যা যার উপরে কাঁচি চালিয়ে কুচি কুচি করে কাটলে-ই বেরিয়ে পড়ে হাজারো মিথ্যারত্ন । সেই রত্নের লোভে পড়ে কিনা মানুষ ?! রত্নলাভ করলে-ই মিথ্যাবাদী ? যত্ন করে রত্ন সংগ্রহে রাখলেই মিথ্যুক ? আর কাঁচি চালানোর পরে পড়ে থাকে শুধু কি ছেঁড়া সত্যটুকু ? এতটা-ই মলিন , দীন , নিষ্প্রভ যে সত্যের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয় মানুষ ? সত্যের এই দীনতা বা মলিনতা আমরা কজন বা আঁকড়ে ধরে থাকি ? থাকতে-ও পারি না । আবর্জনায় ছুড়ে দিই , নর্দমায় ফেলে দিই । সত্য আজকাল বর্জ্যপদার্থ যা আমরা ত্যাগ করি প্রতিমুহূর্তে । একেকটা মুহূর্ত কখনো কখনো আশ্চর্যরকমের দীর্ঘতর হতে থাকে, কারণ সেগুলো কিনা ভীষণভাবে মিথ্যাসাপেক্ষ ?! 

এমনকি স্যার রবার্ট ফেল্ডম্যান তার বিখ্যাত বই 'The Liar in Your Life' -তে বলেছেন যে শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ কথা বলার সময় প্রতি ১০ মিনিটে অন্তত একটি মিথ্যা কথা বলে । তিনি আরো বলেন - মিথ্যা বলা সহজ কাজ নয়, সত্য বলার চেয়ে এতে ৩০ ভাগ সময় বেশি লাগে । রাখলাম ওনার দীর্ঘ গবেষণার ফসল । তোমরা আমরা সকলে জানি বা না জানি অবশ্য-ই কিন্তু মানি । আর যারা মানে না বা মানতে চায় না , হয় তাদের ঘাড় শক্ত সাড়াশি দিয়ে ধরে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত, না হয় তাদের সেই 'মিথ্যা বলা মহাপাপ'-নামক এক অন্ধকারকুপের মধ্যে যাবজ্জীবন কাম্য । কিন্তু এখানে আমার মূলবক্তব্য মিথ্যাচার নিয়ে নয় , মিথ্যা বলার কারণজনিত আলোচনামূলক নয় এমনকি আদ্ধেক-গ্লাস-পূর্ণ-না-খালি মার্কা অর্ধসত্যমিথ্যা নিয়ে যুক্তিতর্কবিতর্কভিত্তিক নয় । এতে আমার মিথ্যা বা সত্যি বলা ছেঁড়া গেছে । বালছেঁড়ার চেয়েও বড়ো অযৌক্তিক । নিষ্প্রয়োজন । বরং আমার বক্তব্য মূলতঃ মিথ্যা বলাটা-কে আনুষ্ঠানিকভাবে সেলিব্রেট করা নিয়ে । মিথ্যা বলার মধ্যে যে এক শৈল্পিক সত্য লুকিয়ে তাকে সামাজিক সম্মান জানিয়ে আহ্বান জানানো-ই জরুরী । 

সুতরাং এসো আমরা পাল্টাই আমাদের নীতিবাক্য এবং সেটি হয়ে যাক *মিথ্যামেব জয়তে*

No comments:

Post a Comment