15 Jun 2014

'অসভ্য চোখ'-এর রিভিউ 2


সাবাড় করে ফেললাম সায়ন্তনী পূততুন্ডের একশো ছত্রিশ পাতার রহস্যোপন্যাস - 'অসভ্য চোখ' ।  শেষ করার পর আপনা থেকে মুখ ফস্কে বেরিয়ে এলো - 'সাবাশ!!!' 

একটু গুছিয়ে বলি - এই সাবাশাত্মক ঢেঁকুর তোলার আগে সুক্তো-তরকারি-ডাল-মাছ-ডিম-চাটনি-ইত্যাদিকার পদের প্লট ( প্লেট বললে হয়তো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ শোনায় ) আমাকে আদ্যোপান্ত ফালাফালা করে দিয়েছিলো । কিসে আবার ? হেলাফেলা ভাষায় । বাংলাসাহিত্যের আধুনিকতায় এটি অবশ্যই নবতম সংযোজন নয় । এর আগেও অনেকে বাংলাভাষার চিরাচরিত চামড়া কেটে ছিঁড়ে ভিতরের মাংস খুবলে নিয়ে সাদা হাড়গোড় পর্যন্ত দেখিয়ে গেছেন । ঠিক যেন বং কালচার-ভালচারদের ধুতি-শাড়ি খুলে নিয়ে শুধু ওয়ান-টু-পিস পরিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে কেটেকুটে পুরো ন্যাড়া-ট্যাঁরা করার জন্য বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায় । ভাষার এই ট্যাক্স-ফ্রি অত্যাধুনিকতায় লেখক বা লেখিকা যতটা নিটোল , পাঠক-পাঠিকা ততটাই টোল ফেলে । 

আসলে আধুনিক জীবনযাপন যে পাল্টে গেছে, জীবনযাপনের যেসব ‘অনিয়ম’ বা 'নিয়মের ব্যতিক্রম' নজরে পড়ে, সেগুলো আমরা দেখি আর পড়ি কিন্তু বাপ-মায়ের নেড়ে দেওয়া কড়া কলকাঠির চাপে সামাজিক বা নৈতিক স্বীকৃতি দিই না বা দিতে পারি না , উল্টে ব্রাহ্মণধর্মী ভাষায় খালি ছ্যা ছ্যা করি । প্রসঙ্গতঃ মনে পড়ে যায় আমার ছেলেবেলার একটা ঘটনার কথা । ডিনার করছিলাম বাবা-মার সাথে । হঠাৎ মায়ের দিকে নির্বোধের মত প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলাম - "মা, গান্ডুর মানে কি?" শুনে বাবা বেশ গুছিয়ে বিশাল একটি বিষম খেলো , মায়ের চোখদুটো টেনিসবলের সাইজে অ্যাম্প্লিফ্যায়েড্ হলো । সাথে "অ্যাই চোওওপ্ , একদম চুউউপ" । কিছু বুঝে ওঠার আগে ওইপাশের ঘর থেকে হাজির ফাইটিং-দেহি ঠাকুরমা । আমার তখন বুঝতে আর বাকি থাকলো না যে ওই 'গান্ডু' শব্দটি নিষিদ্ধ যা শুধু বাংলা অভিধান কেন, যে সমাজে বা পরিবেশে বড় হই আমরা তার কোথাও লিপিবদ্ধ করার যোগ্য নয় । শুধু বন্ধুদের মধ্যে lip-বদ্ধ । 



যাইহোক, খিস্তির জোয়ারে সাঁতরে পার করে এসেছি স্কুল-কলেজ জীবন । 'অসভ্য চোখ'-এ লেখিকা শুধু ভাষায় ডিসটর্ট করে যান নি, গোটা রহস্যগল্প জুড়ে ন্যারেটিভে অতিবিপ্লবীয়ানা অবলম্বন করে এসেছেন যা কোনো ফ্যান্টাসিভোগী পরিচালক লুফে নিলে আশ্চর্যবোধ করবো না । তবে এখানে লাটুর মত মুখ্যচরিত্র সাধারণ মানবিকপ্রবৃত্তি যেমন - লোভ, ঘৃণা, প্রেম, রিপুর তাড়না, বাঁচার ইচ্ছা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি এমন সবকিছুর দ্বারা তাড়িত দৈনন্দিনতার কুম্ভীপাকে সিদ্ধ হচ্ছি আমরা তোমরা - সেই সবকটাকে চাপিয়ে গেছে একটি আলাদা ধাঁচের স্বতন্ত্র ও লক্ষ্যাভিমুখী চরিত্র হিসেবে । বাঙালির তথাকথিত সমাজে যেখানে নারীর চিন্তা-অনুভূতি-মতামতের গুরুত্ব অনেক ক্ষেত্রে খুবই কম বা নগণ্য, সেখানে লাটুর মত চরিত্র ভিতরের কাঁচা দগদগে ক্ষতস্থান যেন ব্যান্ডেজ-তুলো খুলে খুলে দেখিয়ে যাচ্ছে । এমন একটি নারীচরিত্র যার মা দীর্ঘকালের বেশ্যাবৃত্তি ছেড়ে মস্তানির দলবল নিয়ে জীবনযাপন করছে , যার চোখের সামনে নিজের বাবা খুন হয়ে যাওয়া, যার শারীরিক গঠন নারীমহলের কাছে ঈর্ষনীয় অথচ ম্যাচোগিরি করে সারা পাড়া জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানোর মত আন্-সেনসেরড্ ও আন্-এডিটেড্ জীবন । সাথে 'পেম' নিয়ে রিয়াল লাইফ গেমের শিকার হতে না হতে অবশেষে বিশুর মত অপেক্ষাকৃত নিষ্প্রভ চরিত্রের সাথে বিয়ের গাঁটছড়া বেঁধে আমাদের সবার মুখে হাসি ফুটিয়েছে । এমন একটার পর একটা মশলাপ্রদ ঘটনা আর কটা গল্পোন্যাসে পড়েছি ঠিক মনে নেই আমার । 

ভাষায় বিলকুল চকমকি আবির্ভাবের মাঝে এটা একমাত্র অনস্বীকার্য যে জীবনের আবর্জনারূপ পোকামাকড়-গু-মুতের মধ্যে থেকে দুই পায়ে ভর করে দাঁড়ানো মানুষ সেই আবর্জনা দিয়েই আক্রমণ করে একে ওকে । তার উপরে আমাদের সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে লেখিকা বলে গেছেন - "ফ্রাস্টুই ফ্রাস্টু চেনে" । ফ্রাস্টু খাওয়ার মত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারটিকে অবলীলাক্রমে উপস্থাপন করেছেন যা আধ নিমিষের মধ্যে আমাদের দলাপাকানো জীবন-কে লিফ্টে চড়িয়ে নিয়ে যায় স্কাই-লাইন বিল্ডিং-এর ছাদে যেখানে পায়চারী করে শুধু ফ্রাস্ট্রেশন । বেমক্কা-ধাক্কার হাক্কা নুডলস্ খেয়ে নিজে ছক্কা হয়ে যাওয়ার মুহূর্তগুলো আমরা কেউ কি ভুলতে পারি ? ভুলতে চাই বা ভুলে-ও যাই হয়তো কিন্তু ফের কমন বেদনাদায়ক ফোস্কার মত ফিরে আসে । স্মৃতির উৎকট ভিড় ঠেলেঠুলে । কিন্তু লেখিকার হাত ধরে 'ফ্রাস্টু'-এর এমন ফ্রেশ আর ফ্রায়েড আগমন কি জমে থাকা ফ্রাস্টু ঝেড়ে ফেলার মত ক্ষণিক আনন্দের নাকি ফের ফ্রাস্টু খাওয়ার ভয় ভাগাভাগি করিয়ে নেওয়ার নাকি স্মৃতির সিঁড়ি ভেঙ্গে আছাড় খেয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠার - এ বিষয়ে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে এখনও উপনীত হতে পারিনি । শুধু এটুকু বলতে পারি যে তোমাদের ফ্রাস্টু আমার অতিথি আর আমার ফ্রাস্টু তোমাদের এক গ্লাস নুন-চিনি-জলের ঠাণ্ডা শরবৎ । 

কিন্তু রোম্যান্সের রোমিওপনা , কৌতুকের কত্তাগিরি আর খিস্তির খাসখবর নিয়ে লেখিকা যেভাবে রহস্যগল্প দিয়ে অ্যাড্রিনালিনের দোদুল্যমান বন্ধব্যাগ এফোঁড়-ওফোঁড় করেছেন তাতে অভিনবত্বের দাবি রাখতে পারে নি বিন্দুমাত্র । এরকম ঝুড়ি ঝুড়ি নজির রয়েছে বা হলি-বলি-টলিউডীয় লেখা পড়ে নি এমন পাঠক কে বা আছে ?! তাই কিছুটা এন্টারটেনিং হলেও বেশ কয়েকবার হতাশার ধোঁয়ার রিং ছাড়াতে বাধ্য । নেই জীবনদর্পণের ছিটেফোঁটা , মানুষের স্বাধীন চিন্তাভাবনার উপরে সুপ্রভাব ফেলার মত গভীর আর দার্শনিক কথা নেই, আছে শুধু হাসির বুম-বুম-ব্যাং-বিস্ফোরক যার চোটে উড়ে যায় চেনা বর্ণপরিচয়ের চৌবাচ্চা । একজন স্নানরতা যুবতীর বাথরুমের জানালা দিয়ে উঁকি মারা সেই একজোড়া চোখের রহস্য নিয়ে ঘটনা দিব্যি হাসিয়ে কাঁদিয়ে নিয়ে গেছিলো অজস্র ছবির মধ্যে দিয়ে , এই বৈচিত্র্যময় প্লটের উপরে লেখিকার নিয়ন্ত্রণ সত্যি লক্ষণীয় এবং প্রশংসনীয় বটে । প্লাস্ শেষে অসভ্য চোখজোড়া যার তার আসল পরিচয় ফাঁস করে যা কিস্তিমাত করেছেন তাতে নতজানু না হয়ে উপায় নেই । এ যেন চমকের জাস্ট বাপ নয় এক্কেরে সাতপুরুষ । শুধু আশাতীত বললে কম বলা হবে, আশার পূর্বজন্মেও এই 'আশা' ছিলো না । এমন আচমকা অ্যাকশনের প্রতি আমার ঢেঁকুর-সুলভ অমন স্বয়ংক্রিয় রি-অ্যাকশনটুকু ।

No comments:

Post a Comment