19 Jan 2014

কপাল


প্ল্যান্ কষছি বসে বসে । কপালের উপরে হাতুড়ির একটা ঘা দিতে চাই । 

একটা-ই মাত্র ঘা দিতে হবে কিন্তু । শিল্পবিন্যাসগত ভাবে একটা ঘা । এমন সুপরিকল্পিতভাবে যে এক ঘায়ে কপালটা তিনটে সমান টুকরোয় ভেঙ্গে ফেলতে হবে । ব্যস্ । কিন্তু কেন ঘা দিতে চাই সেটা এখুনি জানতে এসো না কারণ কপালটা তোমার নয় , আমার-ই কপাল ।

যাই হোক, এই সমান তিনটে টুকরো নিয়ে একটা টেবিলের উপরে সাজিয়ে বসতে হবে । সাথে একটা পেন, তিনটে সাদা পাতা , একটা দেশলাই বাক্স , একটা ছুরি আর একটা চকলেট বোম । রাত তিনটের দেয়ালঘড়ি অবাক হয়ে এই ক্ষুদ্র গবেষণার আয়োজন দেখবে । সেকেন্ডের কাঁটা কৌতুহলে স্তব্ধ হয়ে যাবে , তার কাঁধের উপর দিয়ে মিনিটের কাঁটা ঘাড় উঁচিয়ে চোখ বড় বড় করে দেখবে , ঘন্টার কাঁটা তখনো আড্রিনালিনের কড়া হুকুমে নড়াচড়া করার জো পাবে না । 

প্রথম টুকরোটা হাতে তুলে নিয়ে আন্দাজমত ওজন মাপতে হবে । তারপর দেশলাই বাক্স খুলে একটা কাঠি বের করে ফস্ করে জ্বালিয়ে তার থেকে আধ মিলিমিটার দূরে রেখে ধরতে হবে আর টুকরোটা জ্বলন্ত কাঠির স্পর্শে পুড়তে থাকবে । এইভাবে পুড়তে থাকবে তিল তিল করে আর আমি একমনে পর্যবেক্ষণ করে যাবো এই পুড়তে থাকা টুকরোটার দিকে । যা সব উপসর্গ দেখা দেবে সেগুলো একেকটা নোট্ করে রাখবো প্রথম সাদা পাতায় । হেডিং-এ নাম লিখে রাখবো - 
'পোড়া কপাল' । 

কপাল পোড়ার গন্ধে সারা ঘর ম-ম করবে । নাক একবার বুকভরে টেনে গন্ধের মর্ম বুঝবো । গবেষণার প্রথম ধাপের গন্ধ । চোখ বুজে থাকবো কিছুক্ষণ । চোখের কোণ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়বে । কালি হয়ে যাওয়া হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছে দেবো জল ।


পুরো ছাই হয়ে যাওয়া টুকরোটা ডাস্টবিনে ফেলে দ্বিতীয় টুকরোটা নেবো পরবর্তী ধাপের জন্যে । চকোলেট বোমের সাথে টুকরোটাকে ভালো করে শক্তপোক্তভাবে বেঁধে দেবো আর পাঁচহাত দূরে রাখা একটা টুলের উপরে রেখে দেবো । দেশলাই বাক্স থেকে আরেকটা কাঠি বের করে জ্বালিয়ে, বোম-টার পলতের মুখে ফুলকি ধরিয়ে আবার যথাস্থানে আসবো ধীরে সুস্থে । এটা দীপাবলীর উৎসব নয় যে দৌড়ে আসতে হবে । এটা একটি সিরিয়াস নিরীক্ষা তাই সবকিছু-ই ধীরে সুস্থে করতে হবে । টুকরোটা তখুনি ফাটবে । সারা ঘর কেঁপে উঠবে , আমিও কি কেঁপে উঠবো তা জানি না , তবে ওই টুকরোটা ফেটে গুচ্ছ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র টুকরো হয়ে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে । আমি উবু হয়ে বসে গুনবো কটা টুকরো হল আর প্রত্যেকটার সাইজ-ও মাপবো । এই ফলাফল দ্বিতীয় সাদা পাতায় লিখে রাখবো আর টাইটেলে লিখে দেবো - 
'ফাটা কপাল' । 

কপাল ফাটার শব্দে চমকে গিয়ে কেউ এসে বন্ধদরজায় নিশ্চয়-ই ঘা দেবে , সমানে ঘা পড়বে , সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে এই আত্ম-ঘা-লভ্য গবেষণায় বুঁদ হয়ে থাকবো । বাইরের ঘা আর ভিতরের ঘা - এই দুইয়ের মধ্যে যে একটা যুদ্ধ চলবে সেটা কোথাও না হলেও একটা ইতিহাস গড়ে তুলবে আমার কালিমাখা জামায়, বোতামখোলা বুকে । ঝন্-ঝন্ করে যুদ্ধের দামামা বাজবে সেই বুকে । রক্তপাতহীন যুদ্ধ । এক যন্ত্রণাহীন বুক আমার । 

বাইরের ঘা একটু স্তিমিত হলে-ই লাস্ট টুকরোটা নিয়ে চোখের সামনে তুলবো আর ভাববো - এটা কিভাবে খুলবো । কতরকম ভাবে খোলা যায় যেমন কমলালেবুর খোসা ছাড়ানোর মত, ইলেকট্রিসিটি বিলের খাম খোলার মত, ছুরি দিয়ে কেটে ভিতরেরটা বাইরে আনার মত বা কত কি । কিছু বুঝতে না পেরে প্রথমে টুকরোটার বাইরের চামড়ায় আমার হাতের ভোঁতা নখগুলো দিয়ে আঁচড় কেটে দেবো । ছাল অনেকখানি উঠে যাবে কিন্তু আঙ্গুলগুলো ব্যথায় কঁকিয়ে উঠবে । এতে কাজের কাজ কিছু না হলে টেবিল থেকে ছুরিটা হাতে নিয়ে টুকরোটার গায়ে মাঝ বরাবর একটা লাইন কেটে দেবো , রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরোবে , পড়বে মুখে নাকে ঠোঁটে রক্তের ছিটেফোঁটা , চশমার কাঁচেও লাগবে কিছু রক্তের প্যাটার্ন্ । মাঝে একবার উঠে আয়নার সামনে গিয়ে নিজের সুদর্শন চেহারার ( ইয়েস, অবশ্যই অনেক ভদ্রাভদ্রমহিলা সভ্যাসভ্য মেয়েরা বলে আমার মধ্যে নাকি একটা দর্শন আছে যা কেবল সু-সু করে হিসি করে ) রূপ দেখবো আর ফিক্ করে হাসবো । ধবধবে সাদা দাঁতের ঝিলিক দেখাবে । সত্যি-ই 'সোন্দোর' দেখতে আমাকে ? নাহ্ ! নিজেকে দেখার অত সময় থাকবে না গবেষণাকালীন । এইসব ভাবলে নাকি কাজের ক্ষতি হয় । এদিকে টুকরোটা থেকে রক্ত পড়া থামলে-ই টুকরোটা দুইহাতে চেপে ধরে দুইদিকে প্রাণপনে টান মারবো । খানিক চেষ্টার পর খুলে যাবে । কিন্তু ? কি দেখতে পাবো  ? কিছু-ই না । রক্তমাংস ছাড়া । নিজের রক্তমাংসের একটা পূর্ণাঙ্গ টুকরোর দুইটি অংশমাত্র বিশেষ । পাশাপাশি রেখে দেবো তৃতীয় সাদা পাতার উপরে , লেখার মত কিছু থাকবে না । ফাঁকা থাকবে । সাদা থাকবে । হয়ত কয়েকটা রক্তের দাগ । শুধু পাতার হেডিং-এ লিখে রাখবো - 
'কপাল খুলে গেছে' । 

তারপর পেনটা ছুঁড়ে ফেলে দেবো । একরাশ বিরক্তিতে । কিছু তো ফলাফল পাবো না খুলে গেলে । শূন্যফল । সুনসান করবে আমার কপাল । আমার জীবনভাগ্য । জীবনটা-ই ব্যর্থ কপাল খুলে গেলে-ও । পোড়া রক্তমাংসের ব্যর্থতার মাঝে-ই একটা ফাটা গোপাল আমি ।

এই প্ল্যানছক তোমাকে দিলাম তুমি আগে ট্রাই মেরে দেখো । কারণ তুমি আমার প্রিয় গিনিপিগ ।

No comments:

Post a Comment