13 Jan 2014

মিলন'দার বক্তব্য


কবিতা কী ও কেন -
*************
ইদানীং দেখছি কেউ কেউ কবিতার যতটা সম্ভব অপব্যাখ্যা করছেন । কবিতায় কবি যেমন তাঁর মনের অবস্থা বর্ণনা করেন তেমনই কিছু অবচেতনও প্রভাব ফেলে । আমি কবিতা লিখি কারণ না লিখে আমার উপায় নেই । যদিও ফেসবুকে কবিতা না- লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি , কেবল প্রকাশিত কবিতাই দেবো মাঝে মাঝে । একবার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম --

"কবিতা কেন লিখি সেটা বোঝানো সত্যিই কষ্টকর। আসলে কবিতা আমার কাছে 'শারীরবৃত্তীয় জৈবনিক প্রক্রিয়া'র মত। কবিতা পায়, তাই লিখি।
যে কথাগুলো সরাসরি বলতে পারিনি কখনও সেই অনুভূতিই আমাকে দিয়ে লেখায় । চরম যন্ত্রণার সময় কলম হৃদয়কে প্রাধান্য দেয়, কি এক ঘোরে সে উঠে আসে হাতে ।
কবিতা লেখার পিছনে আমার অনেক কারণই আছে। হতাশা,যন্ত্রণা,অপ্রাপ্তি,বিষাদ আবার কখনও প্রতারনা নানা কারনেই লেখনী সক্রিয় হয়। সেই অর্থে ভাবিনি কখনও যে কেন লিখি ।
বেশীর ভাগ সময়েই কোনো একটা শব্দ বা বাক্য মাথায় ঘুণপোকার মত ঘুরঘুর করে , মাঝরাতে ঘুম ভেঙে হঠাৎ কোনো শব্দ পিঁপড়ের মত কামড়ায়! হাতের কাছে খাতা,পেন থাকলে সেটা লিখে রাখি। বেশীর ভাগ সময়েই হারিয়ে যায়। সেই হারিয়ে যাওয়া শব্দগুলোকে বড্ড মিস করি। আসলে কবিতা আমার কাছে উচ্চারিত চারণ।"

কবিতা লেখার প্রস্তুতি --
****************
কবিতা জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা নয় যে একে সাময়িক প্রস্তুতিতে ফেলা যায় । কবিতা একটা নিরবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া । "যাবৎ বাঁচি , তাবৎ শিখি "।
তবে কবির কবিতার প্রাথমিক ব্যাকরণ জানা উচিৎ । ছন্দ ,মাত্রা , অলংকার ... এই বিষয়গুলোতে স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন । তবে সেটা জানলেই যে কবিতা লেখা যায় তেমনও নয় । কবিকে হতে হয় শিল্পীর মত । দৈনন্দিন যাবতীয় কিছুকে কাছ থেকে দেখার চোখ, অনুভব করার ক্ষমতা থাকা দরকার ।

কিছু কঠিন শব্দ , তাত্ত্বিক শব্দ প্রয়োগ করলেই কবিতা হয়না । কবিতা তখনই সার্থক যখন তা পাঠককে একাত্ম করে । আবার অতিসরল কিছু বাক্য-বন্ধই কবিতা নয় । উদারন হিসেবে বলা যায় .......
"মূঢ়তার অপনোদনের শান্তি,
শুধু এই –
ঘৃনা নেই, নেই তঞ্চকতা,
জীবনজাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু।" -- --এই লাইনগুলোতে ভাষা যথেষ্ট কঠিন তাও আমরা আমৃত্যু মনে রাখবো । কেন ? কারন - এটা আমাদের ভাবায়,আবেশ আনে, অনুভূতির গোড়ায় ধাক্কা দেয় ।

আবার, 'অ্যান্টেনায় কাক / আমি তো অবাক ' এই সোজা বক্তব্যটি কি আদৌ কবিতা ? না , কারন অ্যান্টেনায় কাক বসাই স্বাভাবিক এতে অবাক হবার কিসসু নেই ।
মোদ্দা কথা হল লেখনীকে থামতে দিতে নেই , লিখতে লিখতেই সরে । কবিতা লেখার জন্য ভালোমানুষ হওয়ার প্রয়োজন । অনুভব করার ক্ষমতা বাড়াতে হবে । ঘরে বসে থেকে কবিতা লেখা প্রায় অসম্ভব , পরিধি বাড়াতে হবে,মিশতে হবে জনারণ্যে । একটা শব্দের জন্য করতে হতে পারে অন্তহীন পদচারণ । আমি নিজে নতুন কিছু শব্দের জন্য নানা মানুষের সাথে মিশেছি দিনের পর দিন । যারা বস্তা সেলাই করেন তাঁদের সাথে মিশে গেছি তবেই পেয়েছি 'আয়নাতালি','ফড়িয়া' এমন সব অনাভিধানিক শব্দরাশি ।

কাদের কবিতা ভালো, কাদের খারাপ --
*************************
এইভাবে বলা মুশকিল । আমি লেখা খারাপ হচ্ছে এটা বলার কে ? কবিতা, কবির কাছে সন্তানের মতো । আমি যে নজরে খারাপ বলছি সেটাই সঠিক এটা বলার মতো ক্ষমতা আমার নেই । তবে একটা কথা বলতে পারি-- কবিতা মানেই কিছু কঠিন শব্দ প্রয়োগ নয় । কবিতা আসলে কবিতাই । কালের গর্ভে টিকবে কিনা সেটা পাঠকের ওপর নির্ভরশীল ।

আসলে কবিতা নিজেই একটা ধাঁধাঁ । পল ডিরাক বলেছিলেন - " In science one tries to tell people, in such a way as to be understood by everyone, something that no one even knew before. But in poetry it's the exact opposite"

কবিতা কিছু স্পেস তৈরি করে মাত্র । পাঠক কবিতার সাথে যদি একাত্ম হন তাহলেই সেটা কবিতা হিসেবে সার্থক । যারা ভাবেন কবিতা মানেই দুর্বোধ্য হতে হয় তাঁরা যখন মুক্তমঞ্চে কবিতা পড়েন তখন পাঠযোগ্য কবিতাই বেছে নেন । কবি ফল্গু বসু বলতেন - দুর্বোধ্য কথাটির অর্থ - ' দূরে গিয়ে বোধ্য ' আবার এটাও ভাবা উচিৎ গল্প বা উপন্যাসে যেমন প্রচুর জায়গা থাকে ব্যাখ্যার ঠিক তেমনই কবিতার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো । যত কম শব্দ ব্যয় করা যায় ততই ভালো । মজনু মোস্তফা বলতেন - 'মেদ পুরুষভোগ্য , কবিতা নয়' । পাঠক যদি শিক্ষিত হন ( তথাকথিত আকাদেমিক শিক্ষায় ) তবে মাঝে মাঝেই কবিতার অদ্ভুত ব্যাখ্যা করেন আর যদি তিনি কবিতা লেখেন দুএকটি তবে তো কথাই নেই ।

কবিতা লিখে তার ব্যাখ্যা দেওয়ার কোনও দায় কবির কোনোকালেই নেই । শিক্ষিত পাঠক আজ বড় প্রয়োজন যিনি কবিতাকে লালন করবেন মননে, ছদ্ম-আধুনিকতায় নয় ।।

No comments:

Post a Comment