25 Sept 2014

সহজ চিন্তার রহস্য


অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো কাজটা । শুধু 'ঝুঁকিপূর্ণ' বললে খালাস করতে চাই না, আকাশ বা মাটির দিকে না তাকিয়ে কাজটার সঙ্গে পরিচিত হতে চাই অন্তত একবার । এটাকে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা আমার মত সাধারণ একজন মানুষের উচ্ছ্বসিত ভিক্ষা বলতে পারো । একটা শিক্ষাভিক্ষা । এই শিক্ষা যাবতীয় শিক্ষা নয়, একটা সুপরিকল্পিত শিল্পের সংস্পর্শে আসার শিক্ষা । আভিজাত্যহীনতায় মোড়া একটা পরিকল্পনা যেটাকে অনেকে সন্দেহের চোখে দেখেছিলো বা তির্যক মন্তব্য করেছিলো কিভাবে একটা চূড়ান্ত সাফল্য এনে দেয়, তার সুশিক্ষা । এই ধরণের শিক্ষার ভিক্ষা পেলে বা শিক্ষালাভ হলে আমার মত লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীর লাভ । এমন বিরল শিক্ষালাভ আদৌ সম্ভব কিনা ভাবছি, কারণ এটাই বিজ্ঞানের অন্তঃপুরের রহস্য । 

কেন বলছি সেটা পরে আসছি । তার আগে আমিও সবার মত খুব গর্বিত এবং মঙ্গলযানের কক্ষপথীয় সাফল্যের পেছনে যে টিম কাজ করেছে, তাদের প্রত্যেকের জন্য রইলো আন্তরিক অভিনন্দন । চন্দ্রযানের পর এরকম আরো সাফল্য এসে আমাদের তথা গোটা ভারতের মুখ উজ্জ্বল করুক । যাইহোক, আসল কথায় আসি এবার । মহাকাশ ও তার প্রতিবেশীর শত্রুভাবাপন্ন অবস্থান বুঝে আঁক কষে প্ল্যান করা চাট্টিখানি কথা নয় । আবার এইরকম একটা প্ল্যান বা কয়েকটা সাব-প্ল্যান একত্রিত করে কাজে লাগালেই যে সফল হবে তার কোনো নিশ্চয়তাও নেই । এই ব্যর্থতা বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘাঁটলে প্রচুর পাওয়া যাবে, এমনকি চিন বা জাপানও ব্যর্থ হয়েছে মঙ্গলযান উৎক্ষেপণে । এখানে কিন্তু খোদ ভারতের ইসরো টিম সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলো প্রথম চেষ্টাতেই । গত ৫ই নভেম্বর থেকে ২৪শে সেপ্টেম্বর - ৩২২ দিনের যাত্রা শেষপর্যন্ত সবার মন জয় করে । এর কিছুদিন আগেও নাসার মত বিশ্বখ্যাত সংস্থা তাদের মাভেন (MAVEN) মঙ্গলাভিযানে সফল হয়েছে যদিও তুলনায় আরো কম সময়ের মধ্যে । কিন্তু এখানে সময়ের মাপটা বড় কথা নয়, সাফল্য শেষ কথা ।  

৩২২ দিন । ৩২২ দিন লাগলো মঙ্গলগ্রহের কক্ষপথে পৌছাতে । অথচ চারপাশে দেখি আমরা ঘন্টায় ঘন্টায়, দিনে দিনে, মাসে মাসে কতকিছু হারিয়ে ফেলি, কতকিছুর মুখোমুখি হই, কত বাধাপ্রাপ্ত হই । মাস ঘুরতে না ঘুরতে জলের কল খারাপ হয়ে যায়, টিউবলাইট পাল্টাতে হয় বা শর্ট-সার্কিট হয়ে যায় । এক ঝোড়ো হাওয়ায় বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে যাওয়ার মত ঘটনা আর নতুন নয় । আবার বাইরের রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে কতবার রিকশা-অটো-বাসের সাথে ধাক্কা খেতে হয়, বা হঠাৎ করে ইঞ্জিন বসে যাওয়া, চাকায় ফুটো হয়ে যাওয়াও একেকটা মাথাব্যথা । দৈনন্দিনতার এমন ঝুটঝামেলার ছবির নানা রং দেখতে আমরা অভ্যস্ত । মাটির বুকে বা মাটি থেকে বড়জোর কয়েকশো কিলোমিটারের দূরত্বের মধ্যে অনেককিছু বিপত্তি ঘটে যায় সেটা বলাই বাহুল্য । আর এই পৃথিবীর সৃষ্টি তো একদিনে হয় নি, লেগেছে কোটি কোটি কোটি কোটি... থাক বলে লাভ নেই । বরং বাইবেলের সুত্র ধরে চোখদুটো শিরোধার্য করে অবিশ্বাসের সুরে বলি - পৃথিবীতে আলো, বাতাস, সর্বশেষে প্রাণের সৃষ্টি করতে স্বয়ং 'ঈশ্বর'-এর সময় লেগেছে মাত্র '৬ দিন' । এর পেছনে এখনো কোনো সুগঠিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই বা থাকলেও কেউ আজও একমত হতে পারে নি । যাইহোক, তারপর তো ধীরে ধীরে তৈরী হয় মানবসভ্যতা, মানুষের হাত ধরে আসে বিজ্ঞান । সেই বিজ্ঞানের জোরে একেকটা রহস্যের জট খুলতে থাকে, নতুন নতুনআবিষ্কার করে, আরো আরো দিশার আলো এনে দেয় । এভাবে একদিন শুরু হয় মহাকাশবিজ্ঞান । ব্ল্যাকহোল বা হিগস বোসন কণার মত কালজয়ী আবিষ্কার আমাদের অনেকের জানা । আবার সেগুলো নিয়ে প্রচুর তর্কবিতর্কও রয়েছে যেহেতু বিজ্ঞান নিজেই একটা রহস্য । 

বিজ্ঞান রহস্যের জট খুলতে যেমন ওস্তাদ, তেমনি পিছপা হয় না নতুন নতুন রহস্য তুলে সামনে হাজির করতে । যেমন ধরা যাক, আমাদের মঙ্গলযান । খরচ পড়েছিলো মাত্র ৭ কোটি ৩০ লক্ষ ডলার । আর সবচে' বিতর্কিত বস্তু হলো এর অটোনমি (Autonomy) যা একটা ইলেক্ট্রনিক ব্রেন । সেটা পৃথিবীর পরিমণ্ডলের বাইরে, মাধ্যাকর্ষণ বা কক্ষপথ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর থেকে মঙ্গলযানের সমস্ত কলকব্জা প্রায় ৭০০ কিলোমিটারের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে রাখে । অনিয়ন্ত্রিত শূন্যতার উপর নিয়ন্ত্রণ । আর এই নিয়ন্ত্রকের মধ্যে রয়েছে মাত্র ১৫ কিলোগ্রামের একটা বৈজ্ঞানিক যন্ত্র যা কয়েকটা বিশেষ যন্ত্রপাতির সমষ্টিমাত্র । সেটা বিভিন্ন প্যারামিটারের কাজ করে যেমন অবস্থান নির্ধারণ, তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রণ, গতিবিধির উপর নজর, দিকনির্দেশ পাল্টানো, রঙিন ছবি তোলা, পৃথিবীতে বার্তা দেওয়া ইত্যাদি জরুরী সব কাজ । এটা নিয়ে অনেকে ভ্রু কুঁচকে গেছিলো, এর কার্যক্ষমতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলো । তোলাটাই স্বাভাবিক, কারণ পৃথিবী থেকে মঙ্গলগ্রহ পর্যন্ত যাওয়ার জন্য তো লাগবে অনেক অনেক জটিল, শক্তিশালী ও সুনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রবিশেষ যা শেষপর্যায় অবধি প্রায় নিঁখুতভাবে কাজ করতে পারবে । তাই ইসরো টিমের দায়িত্বে থাকা মম্ (Mars Orbiter Mission) তথা মঙ্গলযানের প্রজেক্ট ডিরেক্টর সুব্বা অরুনানের তত্বাবধানে থাকা প্রজেক্ট টিম কাজটা অসাধ্য সাধন করতে পেরেছে । অরুনানবাবুর কথায় এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে "complex mathematics and simple thinking", যা অন্যান্য দেশের মঙ্গলাভিযানের কাহিনী থেকে আলাদা করে দেয় । একটা সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তাভাবনার মূলস্রোত যেভাবে এগোতে পারে পৃথিবীর মায়া কাটানোর পর থেকে শুরু করে মহাকাশের সমস্তরকমের বাধাবিপত্তির সম্ভাবনা মাথায় রেখে, সেটা একটা বিরাট কীর্তি বললে কম বলা হবে । আর ভাগ্যও সহায়তা করেছে এটা বলতে বাধা নেই আমার, কারণ মহাকাশের মত একটা নিবিড় অসীম শূন্যতার মধ্যে যে কতকিছু থাকে সেটা অজানা, হিসেবের বাইরে । সেটা জানতে তো বছরের পর বছর উপগ্রহ পাঠাচ্ছে নাসাসহ বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংস্থা । আকাশের তলায় এই পার্থিব ছবির সাথে কোনো মিল নেই মহাকাশের অপার্থিব ছবির । এ ছবি একদম নিকষ কালো, রয়ে আছে অজস্র নানা সাইজের গ্রহ-উপগহ-নক্ষত্রের আনাগোনা । এমন ছবির বুকে পড়ে বেহিসেবী আচঁড় কাটা । কখন কবে কোথায় কিভাবে কোনমুহূর্তে কি এমন ঘটতে পারে তার কোনোটাই আমাদের হাতে নেই, বিজ্ঞানের হাতে নেই, সর্বোপরি আমাদের গর্বের ইসরোর নেই । তো কি করেছে ওরা ? কি এমন করেছে যা এতকিছুর সম্ভাবনার মধ্যে দিয়ে গেলো ? এত কম বাজেটে কি করে যে প্রোজেক্টটা খেল খতম করে দেখাতে পারলো ? 

এইগুলো আসলে রহস্য । রহস্যের মাথায় রয়েছে জটিল অঙ্ক যা মহাকাশের মত লিমিটলেস বস্তুর সাথে মোকাবিলা করার জন্যে অত্যাবশ্যক । এটা ছাড়া দুরত্ব, সময়, তাপমাত্রা, দুই গ্রহের গ্রাভিটির তারতম্য এবং অন্যান্য ডিপেন্ডেন্সির ফর্মূলা বের করা সম্ভব নয় । সাথে রইলো "simple thinking"-এর মত এক আশ্চর্য ক্ষমতা । একটা সহজ চিন্তা মানে কতটা সহজ হতে পারে সেটা একটু খতিয়ে দেখা হোক । মম-এর অরুনান এর আগে চন্দ্রযানের সাথে যুক্ত ছিলেন আর সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন । তাই মঙ্গলযানের ক্ষেত্রেও প্রায় একই কাঠামো লেগেছিলো পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়িয়ে শূন্যে নিক্ষেপ করার জন্য । কিন্তু এর আগে কোনোদিন ৩৫০০০ কিলোমিটারের বেশি দূরে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহের সাথে যোগাযোগ করে নি বা এব্যাপারে একরকম অনভিজ্ঞ বলা যেতে পারে । অনভিজ্ঞতার মত একটা ঝুঁকি নিয়ে এত বড় চ্যালেঞ্জ নিতে গেলে যে 'সহজ চিন্তা' লাগে, একটা কমন সেন্স চাই বা একটা সাধারণ ভাবনা যার মধ্যে যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে । সম্ভাব্য সুবিধা-অসুবিধা মাথায় রেখে এগিয়ে যাওয়া । ধরা যাক গাড়ির কথা একটা গাড়ি তৈরী করার জন্য ইঞ্জিন শেষ কথা নয়, এর সাথে রয়েছে রাস্তার অবস্থা বুঝে চলা, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা, দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য নানারকম সেফটি এন্ড সিকিউরিটির মত নতুন নতুন ডিজাইন । প্রতিটা ডিজাইনের পেছনে রয়েছে অনেক চিন্তাভাবনা । শেষপর্যন্ত গাড়িটা বাজারে নামে । আমরা কিনি নিজেদের সুবিধার্থে আর নানা সমস্যায় পড়ে কমপ্লেইন করি । এটা তো হওয়ার কথা । গাড়ির মধ্যে মানুষ থাকে । মানুষের নিয়ন্ত্রণে চলে গাড়ি । হয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে, নাহয় নিয়ন্ত্রণে থাকতে থাকতে কিছু যন্ত্র বিকল হয়ে যায় অনেকসময় । এর পেছনে থাকে আবার প্রচুর খরচা । এসব আকছার হয় বলে আমরা যথেষ্ট সচেতন, তাই নানা সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে চিন্তাভাবনা করি গাড়ি কেনার আগে । অর্থাৎ একটা গাড়ির সংস্থা থেকে শুরু করে একজন কাস্টমার হাজারো চিন্তা করে ।

আর ওদিকে মঙ্গলযানের মত একটা 'অসম্ভব' কাজটা সম্পন্ন করতে কোনো জলজ্যান্ত মানুষকে পাঠাতে হয় নি, পাঠানো হয়েছে একটা উপগ্রহ মাত্র যার নিয়ন্ত্রণের ভার পড়ে শুধু অটোনমাস সিস্টেমের উপরে । যার প্রাণ নেই, যার রক্ত নেই, ফুসফুস নেই, মলমূত্র ত্যাগ করার মত জৈবিক ক্রিয়াশীল নয় । আদ্যোপান্ত একটা নির্জীব বস্তু যার মধ্যে আগে থেকেই পরিকল্পনামাফিক 'কৃত্রিম প্রাণ' সঞ্চারণ করে রেখে গেছে টিম । এবং সেই প্রাণ হাতে করে বস্তুটি শুরু করে তার কালজয়ী যাত্রা । পৃথিবীতে রয়ে যায় উদ্বিগ্ন মানুষ, ঘন ঘন বাথরুমে যাওয়া বিজ্ঞানীরা, ঘুমটুম ভুলে যাওয়া বার্তাগ্রহণের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা । নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা উপগ্রহ চলতে থাকে মিনিটে, ঘন্টায়, দিনে, সপ্তাহে, মাসে আর একটার পর একটা ধাপ পেরিয়ে যেতে থাকে বিনা বাধায় । শেষে বাজিমাত করে ফেলে । অনেকে নিশ্চয়ই বলবে যেকোনো কিছু একটা ঘটে যেতে পারতো মহাকাশে যেমন একটা গ্রহ হঠাৎ তার কক্ষপথ ছিঁড়ে ছিটকে বেরিয়ে দিকশূন্য হয়ে ছুটতে থাকলো আর তার পথে পড়লো আমাদের মঙ্গলযানটি । ব্যাস । কাজ ভণ্ডুল । তা তো হয় নি কপাল ভালো বলে । আর বাকি থাকলো ৩২২ দিনের মত একটা সময়ব্যাপী নির্বিঘ্ন ঘটনা । শুধু যাওয়া আর যাওয়া । অটো-রিকশা-বাসের ধাক্কার সম্ভাবনা নেই ধরে নিয়ে চলা । একরকম শূন্যতায় ভর করে স্বনিয়ন্ত্রিত অভিযান । এটার জন্য লেগেছিলো স্রেফ 'সহজ চিন্তা' ?! হতেই পারে । উপগ্রহের কার্যক্ষম যন্ত্রপাতিবিশেষ সিম্পল নয়, এদের কাজের প্রকৃতি অকৃত্রিম নয়, কিন্তু এইসব সম্ভব হয়েছে একমাত্র 'সহজ চিন্তা'-এর ফলে । আ ট্রুলি এমেজিং রেজাল্ট ফ্রম আ ভেরি সিম্পল অ্যাপ্রোচ । যত সহজ চিন্তা, তত সফল কাজ । এটা একটা বড় শিক্ষা হয়ে থাকবে আমার সবার মনে । আমরা চেষ্টা করবো কতটা সহজে কঠিন কঠিন কাজ করে ফেলতে পারা । নিজের সাধারণ মেধাকে পুঁজি করে দৈনন্দিনতার জটিলতাকে কাটিয়ে উঠতে পারা । 

এর পাশাপাশি জটিলতার মোকাবিলার নামে সহজপন্থাকে অবলম্বন করার মধ্যে রহস্য লুকিয়ে থাকুক । 

No comments:

Post a Comment