22 Aug 2016

আমি কি বাঙালী?


পুজো আসছে । তার আগেভাগে পুজোর মেজাজ শুরু হয়ে গেছে অনেকের । কটা দিন বাকী সেই কাউন্টডাউন থেকে । বইবাজারে পূজাবার্ষিকী ম্যাগাজিনের বিক্রি দেখে । গড়িয়াহাটে অটোর দৌরাত্ম্যকে ছাপিয়ে ওঠা কেনাকাটারত ভিড়ের দৌরাত্ম্য দেখে । পাড়ায় কারো ফ্ল্যাটে দল বেঁধে গানের রিহার্সাল থেকে । কারো আবার বিরক্তিপ্রকাশ, "পুজো আসছে ? সে অনেক দেরী, দেড়মাস মত ।"

কিছুদিন হলো আমার মায়ের যুগ্মপরিচালনায় ছোটোদের নাটকের পরিচর্যা শুরু হয়ে যায় ।


গতকাল মা হঠাৎ আমার কাছে এসে বসলো । মায়ের মুখের বলিরেখা প্রতিবছরে একটু একটু করে স্পষ্ট হয় । এবারেও লক্ষ্য করলাম বাড়তি কিছু বলিরেখা যা পুজোর মেজাজের সাথে বেশ মানিয়ে গেছে । আমি উইকএন্ডের শর্টটার্ম মুড একপাশে সরিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে দেখলাম । মা আমার চোখে চোখ রেখে বললো,
"তুই কি বাংলা লাইনগুলো ইংলিশ হরফে লিখতে পারিস ?"


আমি নড়েচড়ে বসলাম, "কী বললে ?"


মা রিপিট করলো । আমি তাচ্ছিল্যের মুখভঙ্গি করে বললাম,
"হ্যাঁ, আমরা তো তাই করি হোয়াটসঅ্যাপে, ফেসবুকে ।"


মা শুনে মুখের বলিরেখা আরেকটু এক্সটেন্ড করে জানতে চাইলো,
"চার পাতা এরকম বাংলা সংলাপ ইংলিশ হরফে লিখে দিতে পারবি ?"


প্রায় আঁতকে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম, "কেন, কার আবার লাগবে ?"


খাঁটি বাঙালি হবার সুবাদে আমার শুদ্ধ বাঙালিত্বে কে যেন ধারালো জিনিস দিয়ে খোঁচা মেরে দিচ্ছিলো ।


উত্তর এলো, "রিও-এর ।"


আহ্ ! চলছে রিও অলিম্পিক । পদকতালিকায় ভারত লাস্টবেঞ্চার হলেও আবেগের ঝড়বৃষ্টির দাপটে আমাদের সবার মন একেবারে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে ফার্স্ট । কাদের জন্যে সেটা আর বললাম না ।


যেটা বলতে চাইছিলাম সেটা হলো পুজোর মুখে বাঙালিয়ানার মোড়কে থাকা মনটাকে ছুরি বসিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলো আমাদের পাড়ার রায়চৌধুরী ফ্যামিলির অবাঙালিত্ব । ওদের যে ১৩ বছরের সুদর্শন কিশোর আছে, তার ডাকনাম 'রিও' । দেখতে শুনতে বেশ সুন্দর, ফর্সা, লম্বা ছিপছিপে যা সাধারণ বাঙালী গড়পড়তার থেকে অনেক দূরে ।


'রিও'র বাবা-মা দুজনেই খোদ কলকাতার সাউথ পয়েন্টার । ওর মা অর্থাৎ আমাদের বৌদি যাকে অন্যতম হাসিখুশি সুন্দরী মনে করি সে আমার মাকে কবে একদিন বলেছিলো,
"স্কুলে রিও-এর ফার্স্ট ল্যাঙ্গোয়েজ ইংলিশ, সেকেন্ড হিন্দি, থার্ড ফ্রেঞ্চ ।"


যে ফ্যামিলিতে কারো ফ্রেঞ্চকাট নেই, কেউ হিন্দিভাষী নয়, কেউ ইংলিশে ফটাফটায় না পাড়ার কারো সাথে, সেই ফ্যামিলিচিত্রে একটা দাগ কেউ কেটে দিলো । কার বা এমন ডিসিশন বাংলা ভাষাকে পুরো অবহেলা করার সেটা এই রিও অলিম্পিকের ভারতের সোনাপদকলাভের স্বপ্ন আর পুজোর পুরোদস্তুর মেজাজের মাঝখানে এসে আমার মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়ালো ।


"ওদের এতো কিসের পাকামি ? বাংলায় বলতে পারলেই হলো ? থার্ডেও বাংলা রাখলো না ? ফোর্থ ল্যাঙ্গোয়েজ বলে যদি কিছু রাখতো, তাতেও বুঝি চাইনিজের হিজিবিজি কাটতো ? আলবাৎ কাটতোই ।"
মায়ের সামনে রাগের চোটে কথাগুলো বলতে বলতে মনে হলো চতুর্থ স্থানাধিকারী বাঙালী জিমন্যাস্ট দীপা কর্মকারের কপাল ঢের ভালো অবহেলিত বাংলা ভাষার থেকে । রিও অলিম্পিকের মাঝে এই বাঙালী 'রিও' রায়চৌধুরীর ভবিষ্যৎ কেরিয়ার আমার কাছে একটু হলেও ধন্দে ফেলে দিলো ।


স্টারমার্কে যতবার যাই, ততবার ওই একটা বই কিনবো কিনবো করেও আর কেনা হয় না । এবারে ভাবছি গিয়ে বইটা কিনে পড়বো । বইটা হলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'আমি কি বাঙালী?'

No comments:

Post a Comment