অশান্তির পশ্চিমবাংলার মাথার উপরে শান্তিপূর্ণ এক অবর্ণনীয় মেঘরাজ্য ।
হাতে মলিন হয়ে যাওয়া খসখসে অস্কারমূর্তি । তার গায়ে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঘষতে ঘষতে নীললোহিত মানিকবাবুর সামনে আক্ষেপ করছে, "এ জীবনে কিছু করতে পারলাম না মানিকদা", আর মুখ থেকে ভকভক করে গন্ধ ঝাড়ছে । গন্ধ বেরোলে একরকম, গন্ধ ঝাড়লে আরেকরকম । সেন্টিমেন্টস্ ঠিকঠাক চেপে রাখতে পারলে শুধু গন্ধ বেরোবে, নচেৎ বিলকুল ঝাড় খেতে হবে । এটা হয়তো নীললোহিত বোঝে না, কিন্তু মানিকবাবু জানে বলে দশহাত দূরে বসে আছে আর নীলের প্রলাপ শোনার ভান করে আছে । ফাঁকে ফাঁকে ঘড়ি দেখছে । চারদিকে একবার চেয়ে দেখে মুখে পাইপ ধরলো ।
"কি দাদা, কার জন্য অপেক্ষা করছো ?", আট নম্বর পেগ মারলো ঢুলুঢুলু নীলু ।
"শরদিন্দুদা এখনো আসছে না যে । চিন্তা হচ্ছে", টানটান হয়ে বসলো মানিকবাবু ।
"সেকি ? তার আসার কথা নাকি ?", নয় নম্বর পেগ নেবে কিনা ধন্দে পড়ে নীলু ।
"তোকে তো বলেছিলাম । এর মধ্যে ভুলে গেলি শালা ?", বিরক্তির সুর তুলে উঠে আড়মোরা ভাঙ্গে ছয়ফুটী ।
- আরে এই দিব্যি আছি, আবার এর মধ্যে তাকে টানার কারণটা কি বুঝলাম না !
- আছে কারণ । এই রাজ্যে আর ল্যাদ মারা যাচ্ছে না, এবার কিছু একটায় লেগে পড়ার দরকার । তুই আগে দেখ 'খাগড়াখড়ের রহস্য' বা 'মঙ্গলকোট রহস্য' নিয়ে জমিয়ে লিখতে পারিস কিনা ! 'মিশর রহস্য'টা যা দিয়েছিস নীলু ! তোকে স্যালুট...
- ধুর বাল ! কাকাবাবু ওইসব পছন্দ করে না । সন্তু তো বাচ্চা তার পক্ষে এইসব জঙ্গিবাজদের ঝামেলায় না জড়ালেই ভালো ।
- তাহলে 'সন্তু কোথায়, কাকাবাবু কোথায়' এই গল্পের মত করে লিখে ফ্যাল 'পুলিশ কোথায়, সি.আই.ডি. কোথায়' !
- ইয়ার্কি হচ্ছে ? কাকাবাবুকে ছাড়ো ! সন্তুকে ছাড়ো !
- ভাই নীলু, এই মেঘের রাজ্যে বসে চারপাশের ঘটনা তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছি না বা শুনছি না । সবই স্বর্গীয় ব্যাপার । খবরের কাগজের কোনো আলাই-বালাই নেই এরাজ্যে । নতুন করে লেখার মত কিছু নেই । অভিজ্ঞতা চাই । এখানে শালা শুধু শান্তির ফোয়ারা । টোটাল বোরিং লাইফ লাইক হেল !! আচ্ছা কেমন হয় যদি লিখিস 'দিদি হেরে গেলেন ?', আমি সিওর তুই বোমা ফাটিয়ে দিবি এটা লিখে, যেমন সেদিন ফাটালি 'কাকাবাবু হেরে গেলেন?' লিখে...
- ওহো রক্ষে করো দাদা ! দিদিকে ছাড়ো ! আর আমাকেও ছাড়ো ! বর্ধমান নিয়ে বর্তমানের গাঁড় মারাতে এসো না ! আর এই সুন্দর মেঘরাজ্যে বসে বোমা ফাটানোর শখ নেই !
"কেন নীলু ? দিদি পয়লা নাম্বার খচ্চর !!! আর ওকে ছাড়তে বলছিস ? এত বড় স্পর্ধা হলো তোর কোত্থেকে ? জানিস তখনকার আই.পি.এস. অফিসার নজরুল ইসলামের 'মুসলমানদের কি করণীয়' বইয়ের বিক্রি পুরো বন্ধ করে দিলো, ইসলামকে অপদস্থ করতেও দ্বিতীয়বার ভাবে নি । এমন আকাটমূর্খের কাজ করতে দেখি নি আর কোনো মুখমন্ত্রীকে আমি যতদিন ছিলাম ওই সবুজ মর্ত্যে বিরানব্বই সাল অবধি",
বলে মানিকবাবু মুখ বাড়িয়ে একঝলক দেখে নিলো মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা কয়েক হাজার ফুট নিচের সবুজাভ দৃশ্য । মায়াবী দৃশ্য । চাপের নস্টালজিক কেস ! উফফ !
"পড়ে গেলুম, পড়ে গেলুম", বলতে বলতে কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে নীলু নীচে একটু ঝুঁকে দেখে নিলো তার প্রিয় "সবুজ দ্বীপ", কিন্তু সেই দ্বীপের অকালকুষ্মাণ্ড ফিমেল "রাজা"র দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্যতা দেখে প্রথমে তার চোখমুখ উল্টে গেলো, পরক্ষণে গল গল করে বমি করে ফেললো । মেঘে মেঘে বমিতে ছেয়ে গেলো ।
- ওরে হারামচোদা ! তোর হলো টা কি ?
- কিছু হয়নি গো দাদা ! শরীরখারাপ লাগছিলো তাই । তা 'চো' কেন ? 'জা' বলতে আটকাচ্ছে কেন তোমার ? যাইহোক আসলে দিদির সাথে আমার সখ্যতা ভালোই ছিলো আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার মুহূর্ত অবধি । আজকাল মেয়েটার মাল্টিডাইমেনশনাল ফাজলামি দেখে আর সহ্য করা গেলো না । অথচ বাম জমানায় ফাজলামির ধরণ এক বা দ্বিমাত্রিক ছিলো, তার বেশি করে নি ।
- তোর মুণ্ডু ! অনেক ছড়িয়েছিলো বামপন্থীর নেতারাও । তোর ওই ইয়েটার কি নাম ? নসলিমা না কি যেন ? বাংলাদেশী মাগীটা !!
- ইটস্ তস্ ! নট নস্ ! আর খবরদার আমার সামনে মেয়েটার নাম উচ্চারণ করবে না ! প্লীঈঈঈঈজ !
- ওক্কে স্যার ! গট ইট ! জানিস নিশ্চয় তার একটা বই 'দ্বিখণ্ডিত' ব্যান করে দিয়েছিলো খোদ কমিউনিস্ট বুদ্ধদেব । সেও একটা রামবুদ্ধু ! ওই বুদ্ধদেব থুড়ি বুদ্ধুজীবীর একবারও মনে হলো না যে একজন লেখক বা লেখিকার বাকস্বাধীনতা একটা শৈল্পিক বিপ্লব আনতে পারে । চিত্রনাট্যে হোক, সিনেমায় হোক বা সাধারণ মানুষের জীবনে হোক যা দেখে গণতন্ত্র একটা আলটিমেট স্টেজে এসে পৌছাতে পারে । কিছু আপত্তিকর তথ্য থাকলেই কোর্ট তো আছে তাকে আইনত নিষিদ্ধ করার জন্য । তা না করে নিজেরা ব্যান্ করে দিলো সিপিএম পার্টি । হতচ্ছাড়ার দল সব ! কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া তো দূরের কথা । কিসের সিক্যুলারিজম্ হলো ? কোথাকার সাম্যতত্ব এটা ? তুই বল !
- থাক না ! এই ভালো আছি এখানে এসে । একই সিক্যুলার গর্ভ থেকে প্রসূত হিন্দু-মুসলিম নিয়ে সেই কবে থেকে চলছে । চলবে । কিন্তু তার সাথে আমার বা তোমার বইয়ের কোনো রক্তসম্পর্ক নেই । অন্য টপিকে এসো । ভালো কথা, তুমি তো একখানা বই লিখতে পারো । তোমার ফেলুদার সিরিজের প্রচুর ভক্ত মরে গিয়ে এখানে এসে গায়ে হাওয়া দিচ্ছে আর বোরড হচ্ছে । কয়েকখানা জমিয়ে লিখে দাও না তাদের জন্য ।
- মন্দ বলিস নি, ভাই ! দেখি কি লিখি ? ভাবছি 'বোমার কেল্লা' লিখলে কেমন হয় ? হা হা হা !
- প্লীজ বি সিরিয়াস মানিকদা ! বোমা দিয়ে কেল্লা কেউ বানায় ? ওভাবে বোমা ফেললেই কেল্লা ফতে হবে তার কোনো মানে নেই ! সোনা দিয়ে বানানো তবুও ঠিক ছিল...
- তা ঠিক ! মেঘের নীচে দেখ যখন তখন বোমা ফাটছে ! বাজি ফাটাচ্ছে না হামলাবাজি চলছে কোনটা ? সেটা এই গগনভেদী বোর-রাজ্যে বসে বোঝা বড় দায় ! তবে এটা ঠিক যে বোমাটোমা নিয়ে ফেলুদা এত দৌড়ঝাঁপের সামিল হতে চাইবে না । জটায়ুকে বার বার বোমাতঙ্কে মুচ্ছোচরিত্র বানিয়ে তোলা ভীষণ মিনিংলেস । তোপসে একা একা কি করবে ? জমবে না বোমাবাজি নিয়ে লিখলে ।
- বোমাচরিত তো লিখতে পারো ! অন্যরকমের হবে দাদা । এইসব ফেলুদা ছাড়ো !
"মাফ করবি আমায় ! তার জন্যে সতীনাথদা আছে । কিন্তু জানি না ওর মেঘের ঠিকানা, খোঁজ করে মিট করবো একদিন । তা আর কি কি অপশন আছে ? আয় এদিকে, আমার পাশে বস", বলে সেন্টমাখা রুমাল বের করে নাকে চেপে ধরলো মানিকবাবু ।
নীলুর অবস্থা এক্কেরে নট নড়ন-চড়ন ! অতিকষ্টে নিজেকে টেনেটুনে মেঘের বুকে আঁচড় কাটতে কাটতে তার প্রিয় মানিকদার কাছে গিয়ে বসলো ।
"হোয়াট অ্যাবাউট 'ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের যীশু' যদিও 'টিনটরেটোর যীশু' থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে", একটানা বলে নাকে আবার রুমালচাপা দিলো মানিকবাবু ।
কথাটা শুনে নীলুর মুখ পুরো গুহা । "আহা কি দুর্গন্ধ আকাশে বাতাসে", বেসুরে গাইতে গাইতে কিছু পরী এলোপাথারি পাক খেতে থাকে, বাকি পরীরা মেঘের তলায় গিয়ে গা-ঢাকা দেয় । এদের কেউই নীরা নয় সেটা বুঝতে পেরে মুখ বন্ধ করে নীলু কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিলো ।
- কি বললে দাদা ? কাইন্ডলি রিপিট !
- বস্ ! জানিস তো আল্লাহ আর যীশু একই । ফান্ডামেন্টালি । কনসেপচুয়ালি ! সব ধর্মের মূলে রয়েছে একজন মাত্র । ভারতের মত সিক্যুলার দেশও এক্সেপশনাল নয় । কিন্তু সমস্যাটা ধর্মপ্রাণ উগ্রপন্থীদের নিয়ে । নিজেদের আল্লাহকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে আর বাকি ধর্মানুরাগীদের খালি জুতোপেটা করেও শান্তি পায় না, রেপ করেও ঠাণ্ডা হয় না, উল্টে যেখানে সেখানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে । তাই ফেলুদাকে যদি ট্যাকটিক্যালি ধর্মপ্রচারক করা যায়, তাহলে সবাইকে একই করে দেবে । আফটার দ্যাট নো মোর গোয়েন্দাগিরি ! আর গোয়েন্দা পোষাচ্ছে না রে নীলু । সত্যি বলছি !
- ফেলুদা ধর্মপ্রচার করতে যাবে আর শেষে গুলি খেয়ে মরবে ? বোঝো কাণ্ড ! একটা আইডিয়া দিই ?
- শুট !
- তোমার ওই 'যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে'-এর শেপে 'যত কাণ্ড পশ্চিমবাংলাতে' লেখা হোক যখন সেই কবেকার কংগ্রেস শাসনে, বাম জমানায়, তৃণমূলের পচা শিকড়ে পশ্চিমবাংলাতে একটার পর একটা...'
- 'সাবাশ ভাইয়া ! এ তো পারফেক্ট অপশন দিলি ! এটা ভাবি নি...'
অমনি বাজখাঁই গলা এলো, "কিরে বেটা তোরা ? করছিস কি ? নীলু তো পুরো হেগে গেছে দেখছি ! হা হা হা ! সেকি বে ? মানিক তোর নাকে ওটা কি...হা হা হা ! হচ্ছে টা কি ভাইসব?"
আমুদে লোকটির আগমনে দুজনে খাঁড়া । মানিকবাবু স্টিল স্ট্যাচু । নীললোহিত নড়বড়ে স্ট্যাচু । যেন এখুনি পড়ে গিয়ে খান খান হয়ে যাবে । সম্বিৎ ফিরতেই হাত বাড়িয়ে দিলো মানিকবাবু, "শরদিন্দু স্যার এলেন ! এতক্ষণে ?"
- আর বলিস না মানিক । রাস্তায় যা মেঘের জ্যাম ছিলো । এত মেঘ যাচ্ছিলো রাস্তায় রাস্তায় । বোধ হয় ডিপ্রেশন হচ্ছে কারুর ! কি রে নীলু ? তোকে দেখে মনে হচ্ছে ফুলটু ডিপ্রেসড ! তোর জন্যে মেঘজ্যামে আটকে গেছিলাম । খুলে বল কি ব্যাপার ?
নীলু তার আলুথালু চেহারায় হাসির ঢেউ খেলিয়ে বললো, "ওই আর কি ? আমি এত ছোটবড় গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ কবিতা কিশোরসাহিত্য রহস্যগল্প লিখে মরলাম, বাট নো ইন্টারন্যাশনাল রিকগনিশন ফর মি । অথচ মানিকদা অস্কার পেয়ে বিশ্বনামা হয়েছে"
অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো শরদিন্দুবাবু । "আমি শালা কিছুই পেলাম না তো ! তাও দিব্যি আছি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে । আর তুই নাকে কেঁদে ভাসিয়ে দিলি নিজেকে ! সাধে কি বলি বাল তোকে ! গ্রো আপ ম্যান ! চিয়ার্স ! দে আমায় কয়েকটা মেরে দিই যা বাকি আছে", বলে উশখুশ করে বসে পড়লো দুজনের সামনে ।
- দাদা, আমরা কিছু বই লিখবো ভাবছি স্বর্গবাসীদের জন্য । কিন্তু সেরকম অভিজ্ঞতা নেই এখানে আসার পর, তাই আমাদের আগেকার সৃষ্টিসব নাড়াচাড়া করছি যদি কিছু আইডিয়া পাওয়া যায়...
"বাহ্ ! অতি উত্তম ! আমি তো শালা এরকম ভাবি নি তোদের আসার আগে ! তো কি ভাবছিস বল শুনি", নরম তুলতুলে একটুকরো মেঘে আয়েশ করে নিলো প্রবীণতম ব্যক্তিটি ।
- ওই যে পশ্চিমবাংলায় যা যা হয়ে আসছে সব একসাথে লিপিবদ্ধ করবো ভাবছি দাদা । প্লাস সাথে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো মিশিয়ে বা বিষিয়ে । সেখানে ফেলুদার শৈশবকাল থেকে বার্ধক্যকাল অবধি বাংলার রাজনৈতিক হালচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করাবো । এসবের পেছনে যত রহস্যের জট সবকটাই একেকটা খুলে ফেলে দেবে ফেলুদা ছোটবেলা থেকে । যা কেন্দ্রীয় সংস্থা এন.আই.এ. কেও তাক লাগিয়ে দেবে ।
"ওরে বাবা রে ! অসম্ভব ! অসম্ভব ! আ ভেরি পজিবলি ইম্পজিবল স্টেপ !", বোলতা মারার ভঙ্গিতে বললো শরদিন্দুবাবু ।
"একটা পেয়াঁজের খোসা খুলতে থাকবি, শেষে দেখবি কিছুই নেই ! ধুর ওভাবে হয় নাকি মানিকসোনা ?! নীলু তো 'সেই সময়', 'প্রথম আলো' আর 'পূর্ব-পশ্চিম' এই তিনটে মহাগ্রন্থ লিখে ফেলেছে বেঁচে থাকতে থাকতে । কত লোকের পেট ফুলেছে ওই তিনটে খেয়ে । নাহ ! মানিক তুই অন্যকিছু একটা ভাব !"
মানিকবাবু চুপ । নীলু প্রায় অচেতন সাথে তার ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক খেলছে বার বার ।
আঠেরো শতকের প্রভাবশালী লেখক উপরে চোখ তুলে আপন মনে ভাষণ দিতে থাকে,
"আর ফেলুদা বেচারাকে টানছিস কেন এই মার্কেটে ? ও কি পারবে এতকিছু করতে যা ওই ন্যাশনাল গোয়েন্দা গ্রুপটা এখনো টানছে । অবশ্যই ভালোই এগোচ্ছে যেভাবে একটার পর একটা সূত্র ধরে তদন্ত করছে, দেখা যাক শেষ অবধি কি দাঁড়ায় !"
"আর একদিকে বাংলার পুলিশ বা সি.আই.ডি. যা দেখিয়ে গেলো তাদের উপরে সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে । অন্যদিকে এন.আই.এ.-এর মত একটা ফ্রেন্ডলি টিমের উপরে ভরসা রাখা গেলেও শেষপর্যন্ত পেরে উঠবে কিনা সন্দেহ আছে । তার কারণ নোংরা রাজনীতির উর্দ্ধে কেউ যেতে পারে নি কেউ এখন অবধি । এরাও শেষে চাপে পড়ে ফেল মারবে কিনা আমার আশঙ্কা । সি.বি.আই. তো এখনো চালিয়ে যাচ্ছে সারদাকাণ্ড নিয়ে । কিভাবে যে কাজ করছে এরাই ভালো জানে । সেই ভেবে লাভ নেই আমাদের । বাদ দে"
"দ্যাখ্ রহস্যসন্ধান করতে গেলে রাজনীতির ফাঁদে পা না ফেলা ভালো, এতে লাভ হবে না বই ক্ষতিটা বেশি হবে । আর ওই দিদিকে আমি দেখি নি শালা ! যত নষ্টের গোড়ায় ওই পুঁচকে মেয়েটা । অপেক্ষায় আছি কবে এখানে আসে, এলে উচিৎ শিক্ষা দেবো আমরা । এর বেশি বলতে গেলে আমার রুচিতে বাধছে"
"ভাই, এমন কিছু লেখ তোরা যেটা ইতিহাসের মত লম্বা লম্বা যেন না হয় । রহস্যের গন্ধ পেলে ঝাঁপিয়ে পড়লে হবে না । ধৈর্য ধরে, মাইন্ড ফ্রেশ রেখে, ছক কষে, সূত্র মিলিয়ে একেক করে এগোতে হবে । থাকবে না অন্য কারোর হস্তক্ষেপ । চলবে নিজের বুদ্ধিতে আর বিশ্লেষণী ক্ষমতায় । কোনো সংস্থার সাহায্যের প্রয়োজন নেই । শুধু একজন হাবাটাবা লোককে দিয়ে হালকাফুলকা কিছু কাজ চালিয়ে নেওয়া যথেষ্ট । নিজেকে গোয়েন্দা ভেবে বুক ফুলিয়ে বা যার তার নাকে আইডেন্টিটি কার্ড ঠেকিয়ে আল্টিমেটলি নিজের পায়ে কুড়ুল মারা যাবে না"
"অবশ্যই কোনো পলিটিক্যাল বা টিপিক্যাল কমিক রোল রাখা যাবে না, ফালতু বকর বকর করে মাথার ঘিলুর সব পোকাকে মেরে ফেলে এরা । শুধু শুধু হাসির খোরাক বানিয়ে চিন্তা করার সময় নষ্ট করে দেয় । কোনো চক্রান্তের গন্ধ পেলে সেখানে নিজেকে জড়িয়ে ফেললে হবে না । দূরে থেকে নিজের প্ল্যানে অনড় থাকবে । অচেনা কেউ তেল মারতে এলে বুঝে সুঝে নিজের যুক্তি দিয়ে কিম্বা ডিপ্লোমাটিক্যালি এড়িয়ে যাবে । কেউ বাধা দিতে এলে জানাবে নিজের শখের কথা । জীবিকা নয় । নেশা নয় । পিওর প্যাশন নিয়ে এগিয়ে যাবে..."
"হুম !", মানিকবাবু মুখের পাইপ অনেকটা টানলো । একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে সে বললো, "সত্যান্বেষী !!!"
ঘুমের মধ্যে নীলুর ঠোঁট নড়ে উঠলো, "সত্যান্বেষী !!!"
"ইয়েস ! আ কমপ্লিট আনবায়াসড ক্যারেক্টার । চাইলে আমি আবার লিখতে বসবো । তোদের জ্ঞান দিতে দিতে মনে হলো এবার কিছু একটা লিখি । তাই ওটাই লিখবো, তবে নতুন করে লিখবো উইথ সেম টাইটেল । সত্যান্বেষী ।", গ্লাসে মদ ঢালতে ঢালতে বললো আশাবাদী বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেব ।
হাতে মলিন হয়ে যাওয়া খসখসে অস্কারমূর্তি । তার গায়ে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঘষতে ঘষতে নীললোহিত মানিকবাবুর সামনে আক্ষেপ করছে, "এ জীবনে কিছু করতে পারলাম না মানিকদা", আর মুখ থেকে ভকভক করে গন্ধ ঝাড়ছে । গন্ধ বেরোলে একরকম, গন্ধ ঝাড়লে আরেকরকম । সেন্টিমেন্টস্ ঠিকঠাক চেপে রাখতে পারলে শুধু গন্ধ বেরোবে, নচেৎ বিলকুল ঝাড় খেতে হবে । এটা হয়তো নীললোহিত বোঝে না, কিন্তু মানিকবাবু জানে বলে দশহাত দূরে বসে আছে আর নীলের প্রলাপ শোনার ভান করে আছে । ফাঁকে ফাঁকে ঘড়ি দেখছে । চারদিকে একবার চেয়ে দেখে মুখে পাইপ ধরলো ।
"কি দাদা, কার জন্য অপেক্ষা করছো ?", আট নম্বর পেগ মারলো ঢুলুঢুলু নীলু ।
"শরদিন্দুদা এখনো আসছে না যে । চিন্তা হচ্ছে", টানটান হয়ে বসলো মানিকবাবু ।
"সেকি ? তার আসার কথা নাকি ?", নয় নম্বর পেগ নেবে কিনা ধন্দে পড়ে নীলু ।
"তোকে তো বলেছিলাম । এর মধ্যে ভুলে গেলি শালা ?", বিরক্তির সুর তুলে উঠে আড়মোরা ভাঙ্গে ছয়ফুটী ।
- আরে এই দিব্যি আছি, আবার এর মধ্যে তাকে টানার কারণটা কি বুঝলাম না !
- আছে কারণ । এই রাজ্যে আর ল্যাদ মারা যাচ্ছে না, এবার কিছু একটায় লেগে পড়ার দরকার । তুই আগে দেখ 'খাগড়াখড়ের রহস্য' বা 'মঙ্গলকোট রহস্য' নিয়ে জমিয়ে লিখতে পারিস কিনা ! 'মিশর রহস্য'টা যা দিয়েছিস নীলু ! তোকে স্যালুট...
- ধুর বাল ! কাকাবাবু ওইসব পছন্দ করে না । সন্তু তো বাচ্চা তার পক্ষে এইসব জঙ্গিবাজদের ঝামেলায় না জড়ালেই ভালো ।
- তাহলে 'সন্তু কোথায়, কাকাবাবু কোথায়' এই গল্পের মত করে লিখে ফ্যাল 'পুলিশ কোথায়, সি.আই.ডি. কোথায়' !
- ইয়ার্কি হচ্ছে ? কাকাবাবুকে ছাড়ো ! সন্তুকে ছাড়ো !
- ভাই নীলু, এই মেঘের রাজ্যে বসে চারপাশের ঘটনা তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছি না বা শুনছি না । সবই স্বর্গীয় ব্যাপার । খবরের কাগজের কোনো আলাই-বালাই নেই এরাজ্যে । নতুন করে লেখার মত কিছু নেই । অভিজ্ঞতা চাই । এখানে শালা শুধু শান্তির ফোয়ারা । টোটাল বোরিং লাইফ লাইক হেল !! আচ্ছা কেমন হয় যদি লিখিস 'দিদি হেরে গেলেন ?', আমি সিওর তুই বোমা ফাটিয়ে দিবি এটা লিখে, যেমন সেদিন ফাটালি 'কাকাবাবু হেরে গেলেন?' লিখে...
- ওহো রক্ষে করো দাদা ! দিদিকে ছাড়ো ! আর আমাকেও ছাড়ো ! বর্ধমান নিয়ে বর্তমানের গাঁড় মারাতে এসো না ! আর এই সুন্দর মেঘরাজ্যে বসে বোমা ফাটানোর শখ নেই !
"কেন নীলু ? দিদি পয়লা নাম্বার খচ্চর !!! আর ওকে ছাড়তে বলছিস ? এত বড় স্পর্ধা হলো তোর কোত্থেকে ? জানিস তখনকার আই.পি.এস. অফিসার নজরুল ইসলামের 'মুসলমানদের কি করণীয়' বইয়ের বিক্রি পুরো বন্ধ করে দিলো, ইসলামকে অপদস্থ করতেও দ্বিতীয়বার ভাবে নি । এমন আকাটমূর্খের কাজ করতে দেখি নি আর কোনো মুখমন্ত্রীকে আমি যতদিন ছিলাম ওই সবুজ মর্ত্যে বিরানব্বই সাল অবধি",
বলে মানিকবাবু মুখ বাড়িয়ে একঝলক দেখে নিলো মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা কয়েক হাজার ফুট নিচের সবুজাভ দৃশ্য । মায়াবী দৃশ্য । চাপের নস্টালজিক কেস ! উফফ !
"পড়ে গেলুম, পড়ে গেলুম", বলতে বলতে কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে নীলু নীচে একটু ঝুঁকে দেখে নিলো তার প্রিয় "সবুজ দ্বীপ", কিন্তু সেই দ্বীপের অকালকুষ্মাণ্ড ফিমেল "রাজা"র দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্যতা দেখে প্রথমে তার চোখমুখ উল্টে গেলো, পরক্ষণে গল গল করে বমি করে ফেললো । মেঘে মেঘে বমিতে ছেয়ে গেলো ।
- ওরে হারামচোদা ! তোর হলো টা কি ?
- কিছু হয়নি গো দাদা ! শরীরখারাপ লাগছিলো তাই । তা 'চো' কেন ? 'জা' বলতে আটকাচ্ছে কেন তোমার ? যাইহোক আসলে দিদির সাথে আমার সখ্যতা ভালোই ছিলো আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার মুহূর্ত অবধি । আজকাল মেয়েটার মাল্টিডাইমেনশনাল ফাজলামি দেখে আর সহ্য করা গেলো না । অথচ বাম জমানায় ফাজলামির ধরণ এক বা দ্বিমাত্রিক ছিলো, তার বেশি করে নি ।
- তোর মুণ্ডু ! অনেক ছড়িয়েছিলো বামপন্থীর নেতারাও । তোর ওই ইয়েটার কি নাম ? নসলিমা না কি যেন ? বাংলাদেশী মাগীটা !!
- ইটস্ তস্ ! নট নস্ ! আর খবরদার আমার সামনে মেয়েটার নাম উচ্চারণ করবে না ! প্লীঈঈঈঈজ !
- ওক্কে স্যার ! গট ইট ! জানিস নিশ্চয় তার একটা বই 'দ্বিখণ্ডিত' ব্যান করে দিয়েছিলো খোদ কমিউনিস্ট বুদ্ধদেব । সেও একটা রামবুদ্ধু ! ওই বুদ্ধদেব থুড়ি বুদ্ধুজীবীর একবারও মনে হলো না যে একজন লেখক বা লেখিকার বাকস্বাধীনতা একটা শৈল্পিক বিপ্লব আনতে পারে । চিত্রনাট্যে হোক, সিনেমায় হোক বা সাধারণ মানুষের জীবনে হোক যা দেখে গণতন্ত্র একটা আলটিমেট স্টেজে এসে পৌছাতে পারে । কিছু আপত্তিকর তথ্য থাকলেই কোর্ট তো আছে তাকে আইনত নিষিদ্ধ করার জন্য । তা না করে নিজেরা ব্যান্ করে দিলো সিপিএম পার্টি । হতচ্ছাড়ার দল সব ! কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া তো দূরের কথা । কিসের সিক্যুলারিজম্ হলো ? কোথাকার সাম্যতত্ব এটা ? তুই বল !
- থাক না ! এই ভালো আছি এখানে এসে । একই সিক্যুলার গর্ভ থেকে প্রসূত হিন্দু-মুসলিম নিয়ে সেই কবে থেকে চলছে । চলবে । কিন্তু তার সাথে আমার বা তোমার বইয়ের কোনো রক্তসম্পর্ক নেই । অন্য টপিকে এসো । ভালো কথা, তুমি তো একখানা বই লিখতে পারো । তোমার ফেলুদার সিরিজের প্রচুর ভক্ত মরে গিয়ে এখানে এসে গায়ে হাওয়া দিচ্ছে আর বোরড হচ্ছে । কয়েকখানা জমিয়ে লিখে দাও না তাদের জন্য ।
- মন্দ বলিস নি, ভাই ! দেখি কি লিখি ? ভাবছি 'বোমার কেল্লা' লিখলে কেমন হয় ? হা হা হা !
- প্লীজ বি সিরিয়াস মানিকদা ! বোমা দিয়ে কেল্লা কেউ বানায় ? ওভাবে বোমা ফেললেই কেল্লা ফতে হবে তার কোনো মানে নেই ! সোনা দিয়ে বানানো তবুও ঠিক ছিল...
- তা ঠিক ! মেঘের নীচে দেখ যখন তখন বোমা ফাটছে ! বাজি ফাটাচ্ছে না হামলাবাজি চলছে কোনটা ? সেটা এই গগনভেদী বোর-রাজ্যে বসে বোঝা বড় দায় ! তবে এটা ঠিক যে বোমাটোমা নিয়ে ফেলুদা এত দৌড়ঝাঁপের সামিল হতে চাইবে না । জটায়ুকে বার বার বোমাতঙ্কে মুচ্ছোচরিত্র বানিয়ে তোলা ভীষণ মিনিংলেস । তোপসে একা একা কি করবে ? জমবে না বোমাবাজি নিয়ে লিখলে ।
- বোমাচরিত তো লিখতে পারো ! অন্যরকমের হবে দাদা । এইসব ফেলুদা ছাড়ো !
"মাফ করবি আমায় ! তার জন্যে সতীনাথদা আছে । কিন্তু জানি না ওর মেঘের ঠিকানা, খোঁজ করে মিট করবো একদিন । তা আর কি কি অপশন আছে ? আয় এদিকে, আমার পাশে বস", বলে সেন্টমাখা রুমাল বের করে নাকে চেপে ধরলো মানিকবাবু ।
নীলুর অবস্থা এক্কেরে নট নড়ন-চড়ন ! অতিকষ্টে নিজেকে টেনেটুনে মেঘের বুকে আঁচড় কাটতে কাটতে তার প্রিয় মানিকদার কাছে গিয়ে বসলো ।
"হোয়াট অ্যাবাউট 'ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের যীশু' যদিও 'টিনটরেটোর যীশু' থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে", একটানা বলে নাকে আবার রুমালচাপা দিলো মানিকবাবু ।
কথাটা শুনে নীলুর মুখ পুরো গুহা । "আহা কি দুর্গন্ধ আকাশে বাতাসে", বেসুরে গাইতে গাইতে কিছু পরী এলোপাথারি পাক খেতে থাকে, বাকি পরীরা মেঘের তলায় গিয়ে গা-ঢাকা দেয় । এদের কেউই নীরা নয় সেটা বুঝতে পেরে মুখ বন্ধ করে নীলু কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিলো ।
- কি বললে দাদা ? কাইন্ডলি রিপিট !
- বস্ ! জানিস তো আল্লাহ আর যীশু একই । ফান্ডামেন্টালি । কনসেপচুয়ালি ! সব ধর্মের মূলে রয়েছে একজন মাত্র । ভারতের মত সিক্যুলার দেশও এক্সেপশনাল নয় । কিন্তু সমস্যাটা ধর্মপ্রাণ উগ্রপন্থীদের নিয়ে । নিজেদের আল্লাহকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে আর বাকি ধর্মানুরাগীদের খালি জুতোপেটা করেও শান্তি পায় না, রেপ করেও ঠাণ্ডা হয় না, উল্টে যেখানে সেখানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে । তাই ফেলুদাকে যদি ট্যাকটিক্যালি ধর্মপ্রচারক করা যায়, তাহলে সবাইকে একই করে দেবে । আফটার দ্যাট নো মোর গোয়েন্দাগিরি ! আর গোয়েন্দা পোষাচ্ছে না রে নীলু । সত্যি বলছি !
- ফেলুদা ধর্মপ্রচার করতে যাবে আর শেষে গুলি খেয়ে মরবে ? বোঝো কাণ্ড ! একটা আইডিয়া দিই ?
- শুট !
- তোমার ওই 'যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে'-এর শেপে 'যত কাণ্ড পশ্চিমবাংলাতে' লেখা হোক যখন সেই কবেকার কংগ্রেস শাসনে, বাম জমানায়, তৃণমূলের পচা শিকড়ে পশ্চিমবাংলাতে একটার পর একটা...'
- 'সাবাশ ভাইয়া ! এ তো পারফেক্ট অপশন দিলি ! এটা ভাবি নি...'
অমনি বাজখাঁই গলা এলো, "কিরে বেটা তোরা ? করছিস কি ? নীলু তো পুরো হেগে গেছে দেখছি ! হা হা হা ! সেকি বে ? মানিক তোর নাকে ওটা কি...হা হা হা ! হচ্ছে টা কি ভাইসব?"
আমুদে লোকটির আগমনে দুজনে খাঁড়া । মানিকবাবু স্টিল স্ট্যাচু । নীললোহিত নড়বড়ে স্ট্যাচু । যেন এখুনি পড়ে গিয়ে খান খান হয়ে যাবে । সম্বিৎ ফিরতেই হাত বাড়িয়ে দিলো মানিকবাবু, "শরদিন্দু স্যার এলেন ! এতক্ষণে ?"
- আর বলিস না মানিক । রাস্তায় যা মেঘের জ্যাম ছিলো । এত মেঘ যাচ্ছিলো রাস্তায় রাস্তায় । বোধ হয় ডিপ্রেশন হচ্ছে কারুর ! কি রে নীলু ? তোকে দেখে মনে হচ্ছে ফুলটু ডিপ্রেসড ! তোর জন্যে মেঘজ্যামে আটকে গেছিলাম । খুলে বল কি ব্যাপার ?
নীলু তার আলুথালু চেহারায় হাসির ঢেউ খেলিয়ে বললো, "ওই আর কি ? আমি এত ছোটবড় গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ কবিতা কিশোরসাহিত্য রহস্যগল্প লিখে মরলাম, বাট নো ইন্টারন্যাশনাল রিকগনিশন ফর মি । অথচ মানিকদা অস্কার পেয়ে বিশ্বনামা হয়েছে"
অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো শরদিন্দুবাবু । "আমি শালা কিছুই পেলাম না তো ! তাও দিব্যি আছি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে । আর তুই নাকে কেঁদে ভাসিয়ে দিলি নিজেকে ! সাধে কি বলি বাল তোকে ! গ্রো আপ ম্যান ! চিয়ার্স ! দে আমায় কয়েকটা মেরে দিই যা বাকি আছে", বলে উশখুশ করে বসে পড়লো দুজনের সামনে ।
- দাদা, আমরা কিছু বই লিখবো ভাবছি স্বর্গবাসীদের জন্য । কিন্তু সেরকম অভিজ্ঞতা নেই এখানে আসার পর, তাই আমাদের আগেকার সৃষ্টিসব নাড়াচাড়া করছি যদি কিছু আইডিয়া পাওয়া যায়...
"বাহ্ ! অতি উত্তম ! আমি তো শালা এরকম ভাবি নি তোদের আসার আগে ! তো কি ভাবছিস বল শুনি", নরম তুলতুলে একটুকরো মেঘে আয়েশ করে নিলো প্রবীণতম ব্যক্তিটি ।
- ওই যে পশ্চিমবাংলায় যা যা হয়ে আসছে সব একসাথে লিপিবদ্ধ করবো ভাবছি দাদা । প্লাস সাথে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো মিশিয়ে বা বিষিয়ে । সেখানে ফেলুদার শৈশবকাল থেকে বার্ধক্যকাল অবধি বাংলার রাজনৈতিক হালচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করাবো । এসবের পেছনে যত রহস্যের জট সবকটাই একেকটা খুলে ফেলে দেবে ফেলুদা ছোটবেলা থেকে । যা কেন্দ্রীয় সংস্থা এন.আই.এ. কেও তাক লাগিয়ে দেবে ।
"ওরে বাবা রে ! অসম্ভব ! অসম্ভব ! আ ভেরি পজিবলি ইম্পজিবল স্টেপ !", বোলতা মারার ভঙ্গিতে বললো শরদিন্দুবাবু ।
"একটা পেয়াঁজের খোসা খুলতে থাকবি, শেষে দেখবি কিছুই নেই ! ধুর ওভাবে হয় নাকি মানিকসোনা ?! নীলু তো 'সেই সময়', 'প্রথম আলো' আর 'পূর্ব-পশ্চিম' এই তিনটে মহাগ্রন্থ লিখে ফেলেছে বেঁচে থাকতে থাকতে । কত লোকের পেট ফুলেছে ওই তিনটে খেয়ে । নাহ ! মানিক তুই অন্যকিছু একটা ভাব !"
মানিকবাবু চুপ । নীলু প্রায় অচেতন সাথে তার ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক খেলছে বার বার ।
আঠেরো শতকের প্রভাবশালী লেখক উপরে চোখ তুলে আপন মনে ভাষণ দিতে থাকে,
"আর ফেলুদা বেচারাকে টানছিস কেন এই মার্কেটে ? ও কি পারবে এতকিছু করতে যা ওই ন্যাশনাল গোয়েন্দা গ্রুপটা এখনো টানছে । অবশ্যই ভালোই এগোচ্ছে যেভাবে একটার পর একটা সূত্র ধরে তদন্ত করছে, দেখা যাক শেষ অবধি কি দাঁড়ায় !"
"আর একদিকে বাংলার পুলিশ বা সি.আই.ডি. যা দেখিয়ে গেলো তাদের উপরে সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে । অন্যদিকে এন.আই.এ.-এর মত একটা ফ্রেন্ডলি টিমের উপরে ভরসা রাখা গেলেও শেষপর্যন্ত পেরে উঠবে কিনা সন্দেহ আছে । তার কারণ নোংরা রাজনীতির উর্দ্ধে কেউ যেতে পারে নি কেউ এখন অবধি । এরাও শেষে চাপে পড়ে ফেল মারবে কিনা আমার আশঙ্কা । সি.বি.আই. তো এখনো চালিয়ে যাচ্ছে সারদাকাণ্ড নিয়ে । কিভাবে যে কাজ করছে এরাই ভালো জানে । সেই ভেবে লাভ নেই আমাদের । বাদ দে"
"দ্যাখ্ রহস্যসন্ধান করতে গেলে রাজনীতির ফাঁদে পা না ফেলা ভালো, এতে লাভ হবে না বই ক্ষতিটা বেশি হবে । আর ওই দিদিকে আমি দেখি নি শালা ! যত নষ্টের গোড়ায় ওই পুঁচকে মেয়েটা । অপেক্ষায় আছি কবে এখানে আসে, এলে উচিৎ শিক্ষা দেবো আমরা । এর বেশি বলতে গেলে আমার রুচিতে বাধছে"
"ভাই, এমন কিছু লেখ তোরা যেটা ইতিহাসের মত লম্বা লম্বা যেন না হয় । রহস্যের গন্ধ পেলে ঝাঁপিয়ে পড়লে হবে না । ধৈর্য ধরে, মাইন্ড ফ্রেশ রেখে, ছক কষে, সূত্র মিলিয়ে একেক করে এগোতে হবে । থাকবে না অন্য কারোর হস্তক্ষেপ । চলবে নিজের বুদ্ধিতে আর বিশ্লেষণী ক্ষমতায় । কোনো সংস্থার সাহায্যের প্রয়োজন নেই । শুধু একজন হাবাটাবা লোককে দিয়ে হালকাফুলকা কিছু কাজ চালিয়ে নেওয়া যথেষ্ট । নিজেকে গোয়েন্দা ভেবে বুক ফুলিয়ে বা যার তার নাকে আইডেন্টিটি কার্ড ঠেকিয়ে আল্টিমেটলি নিজের পায়ে কুড়ুল মারা যাবে না"
"অবশ্যই কোনো পলিটিক্যাল বা টিপিক্যাল কমিক রোল রাখা যাবে না, ফালতু বকর বকর করে মাথার ঘিলুর সব পোকাকে মেরে ফেলে এরা । শুধু শুধু হাসির খোরাক বানিয়ে চিন্তা করার সময় নষ্ট করে দেয় । কোনো চক্রান্তের গন্ধ পেলে সেখানে নিজেকে জড়িয়ে ফেললে হবে না । দূরে থেকে নিজের প্ল্যানে অনড় থাকবে । অচেনা কেউ তেল মারতে এলে বুঝে সুঝে নিজের যুক্তি দিয়ে কিম্বা ডিপ্লোমাটিক্যালি এড়িয়ে যাবে । কেউ বাধা দিতে এলে জানাবে নিজের শখের কথা । জীবিকা নয় । নেশা নয় । পিওর প্যাশন নিয়ে এগিয়ে যাবে..."
"হুম !", মানিকবাবু মুখের পাইপ অনেকটা টানলো । একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে সে বললো, "সত্যান্বেষী !!!"
ঘুমের মধ্যে নীলুর ঠোঁট নড়ে উঠলো, "সত্যান্বেষী !!!"
"ইয়েস ! আ কমপ্লিট আনবায়াসড ক্যারেক্টার । চাইলে আমি আবার লিখতে বসবো । তোদের জ্ঞান দিতে দিতে মনে হলো এবার কিছু একটা লিখি । তাই ওটাই লিখবো, তবে নতুন করে লিখবো উইথ সেম টাইটেল । সত্যান্বেষী ।", গ্লাসে মদ ঢালতে ঢালতে বললো আশাবাদী বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেব ।
No comments:
Post a Comment